image

সাহিত্যের দিনমজুর মাহবুব-উল-আলম : ১৮৯৮-১৯৮১

image

গভীর মানবিক বোধের প্রাণবন্ত কথাসাহিত্যিক এবং সত্যসন্ধ লেখকের প্রতিকৃতি মাহবুব-উল-আলম। জন্ম ১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দের ১ মে চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার ফতেয়াবাদ গ্রামের মৌলভিবাড়িতে। পিতা মৌলভি নসিহুদ্দীন, মা বেগম আজিমুন নিসা। পিতা-মাতার চার সন্তানের মধ্যে মাহবুব-উল-আলম দ্বিতীয়। পূর্বে এই পরিবার ফতেপুর গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। ফতেয়াবাদ এম ই স্কুল থেকে ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে এন্ট্রান্স পাশ করেন। কিছুদিন চট্টগ্রাম কলেজে আই.এ. ক্লাসে অধ্যয়ন করেন। এসময় রেঙ্গুন প্রবাসী ব্যবসায়ী সৈয়দ সুলতান আহমদ ফকির-এর মেয়ে জোলেখা বেগমকে বিয়ে করেন। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বাঙালি পল্টনে যোগদান করে মেসোপটেমিয়ায় (আধুনিক ইরাক) গমন এবং যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে মাঝামাঝি সময়ে বাঙালি পল্টন ভেঙ্গে দেয়া হলে তিনি দেশে ফিরে আসেন। যুদ্ধফেরত মাহবুব-উল-আলম পুলিশের চাকরিতে যোগদান না করে সাব-রেজিস্ট্রার পদে যোগ দেন। হন পরিবারের প্রথম সরকারি চাকুরি। তিনি চট্টগ্রাম সদর, রাউজান, হাটহাজারী, কাটিরহাট, কাজীরহাট, ফটিকছড়ি, পটিয়া, বাঁশখালী, কক্সবাজারের সাব-রেজিস্ট্রার এবং সিলেট, খুলনা, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লা জেলায় ডিস্ট্রিক-রেজিস্ট্রার আবার কোথাও ইন্সপেক্টর অব রেজিস্ট্র্রেশন পদে দীর্ঘ সময় কাজ করেন।  ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। কথাসাহিত্যিক মাহবুব-উল-আলমের প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় কালিকিংকর চক্রবর্তী সম্পাদিত সাপ্তাহিক জ্যোতি পত্রিকায় ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে রেঙ্গুন থেকে প্রকাশিত মাসিক যুগের আলোয় ‘জয় পরাজয়’ ও ‘বুড়ি’ নামে দু’টি গল্প রচনা করে মাহবুব-উল-আলম-এর বাংলা কথাসাহিত্যে আত্মপ্রকাশ ঘটে।১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর তাঁর সম্পাদনায় চট্টগ্রাম থেকে সাপ্তাহিক     জমানা পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের শেষ দিকে তিনি চিটাগাং জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর সভাপতি নির্বাচিত হন। এর কিছুদিন পর জমানা দৈনিক হিসেবে প্রকাশিত হয়। তাঁর তৃতীয় পুত্র সাংবাদিক মাইনুল আলম-এর প্রচেষ্টায় জমানা পত্রিকার কয়েক সংখ্যা ইংরেজি সংস্করণ সেই সাথে বছর দুয়েক মাসিক উর্দু সংস্করণও প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটি নিয়মিতভাবে ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছিল। মাহবুব-উল-আলমের প্রকাশিত উপন্যাস মোমেনের জবানবন্দী (১৯৪৬), উপন্যাসোপম বড় গল্প মফিজন (১৯৪৬), কিংবা স্মৃতিকথা পল্টন জীবনের স্মৃতি (১৯৪০) উল্লেখযোগ্য সাহিত্য কীর্তি। তাঁর অন্যান্য গ্রন্থ হলো : গল্প সংকলন তাজিয়া (১৯৪৬), পঞ্চ অন্ন (১৯৫৩), গাঁয়ের মায়া, ব্যঙ্গ নাটিকা আন্তর্জাতিক গরু সম্মেলন ও দিশারী; ব্যঙ্গ রচনা গোঁফ সন্দেশ (১৯৫৩), রং-বেরঙ। জাতিসংঘের ইউনেস্কোর কমিশন পাওয়া দেশ পরিচয়মূলক পুস্তিকার মধ্যে রয়েছে : বার্মা (১৯৫৯), সিলোন (১৯৫৯), ইন্দোনেশিয়া (১৯৫৯), তুর্কী (১৯৬০), সৌদি আরব (১৯৬০), পূর্ব-পাকিস্তানের পক্ষী (১৯৬০)। মাহবুব-উল-আলম প্রথম জীবনে সাহিত্যচর্চায় নিবেদিত থাকলেও ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে স্ত্রীর মৃত্যুর পর মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী তাঁকে চট্টগ্রামের ইতিহাস রচনায় উদ্বুদ্ধ করেন। একে একে তিনি রচনা করেন বর্মার হাঙ্গামা (১৯১৮), চট্টগ্রামের ইতিহাস নবাবী আমল, চট্টগ্রামের কতিপয় পরিবার, চট্টগ্রামের অলি-দরবেশ, চট্টগ্রামের গোলেজার বেগম হাইস্কুল, আধুনিক মুসলিম স্ত্রী শিক্ষা আন্দোলন, দিদারুল আলম জীবন কথা ইত্যাদি। জীবনের শেষ দিকে রচনা করেন ১৯৯৪ পৃষ্ঠার চার খণ্ডের বিশাল গ্রন্থ বাঙালার মুক্তিযুদ্ধের ইতিবৃত্ত এবং তিন  খণ্ডের চট্টগ্রামের ইতিহাস। তাঁর জীবনের সর্বশেষ রচনা যা অসমাপ্ত রয়েছে বুদ্ধিজীবীর মুখে ছাই।নৈতিকতার বোধসম্পন্ন মানবিকতার ও আধুনিকতার আবাহনের কথাসাহিত্যক, সাংবাদিক, ইতিহাসবিদ মাহবুব-উল-আলম ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে ৭ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৮৩ বছর। তাঁকে ফতেয়াবাদস্থ পারিবারিক গোরস্থানে সমাহিত করা হয়। সাহিত্যকর্মের অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৫), পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট প্রদত্ত প্রাইড অব পারফরমেন্স পুরস্কার ও স্বর্ণপদক (১৯৬৫), এবং বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে একুুশে পদক প্রদান করে। বাংলা একাডেমি তাঁকে ফেলো সম্মানে (১৯৭৯) সম্মানিত করেন। বাংলা একাডেমি ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে মাহমুদ শাহ্ কোরেশী রচিত মাহবুব-উল-আলম জীবনী গ্রন্থ প্রকাশ করে।

সম্পাদনায় : আইউব সৈয়দ, উপদেষ্টা সম্পাদক, সিটিজি সংবাদ.কম