image

ভাষাবিদ ও অভিধানকার মুহম্মদ এনামুল হক : ১৯০২-১৯৮২

image

বাংলা ভাষা ও সাহিত্য গবেষণার আধুনিকতার অন্যতম পুরোধা ড. মুহম্মদ এনামুল হক ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দের ২০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি উপজেলার বখতপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পঞ্চদশ শতকের ধর্ম মিশনারি দরবেশ শেখ জালাল হালবীর অধস্তন নবম পুরুষই মুহম্মদ এনামুল হক। পিতা মওলানা আমিনুল্লাহ আরব বিশ্বের সাহিত্যের পণ্ডিত ছিলেন। নানুপুর মাইনর স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় তার পিতৃ বিয়োগ ঘটে। রাউজান হাই স্কুল থেকে ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে মহসিন বৃত্তিসহ প্রবেশিকা পাশ করেন। ছাত্রাবস্থায় ১৩৩৩ বঙ্গাব্দে চাচাতো বোন রশীদহ খাতুনের সঙ্গে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে আই.এ. এবং ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে আরবি ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স নিয়ে বি.এ. পাস করেন। ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্ডিয়ান ভার্নাকুলার বিভাগ থেকে বাংলায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে এম.এ এবং জগত্তারিণী স্বর্ণপদকসহ গবেষণা শিক্ষাবৃত্তি লাভ করেন। এই বৃত্তিতে তিনি অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে পিএইচ ডি. অর্জন করেন। উল্লেখ্য যে, মুহম্মদ এনামুল হক ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঐ সময়ে পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জনকারী প্রথম বাঙালি মুসলমান। অন্যদিকে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সম্মানপদ রামতনু লাহিড়ী অধ্যাপক পদের গবেষণা সহকারী (১৯৩৩-৩৫) হিসাবেও সম্মানিত। ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজ থেকে বি.টি. ডিগ্রি লাভ করে প্রথমে চট্টগ্রামের মিরসরাই-এর জোরারগঞ্জ স্কুলে, ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে হাওড়া জেলা স্কুলে, ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে মালদহ জেলা স্কুলে, ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরে তিনি ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে রাজশাহী সরকারি কলেজে বাংলার অধ্যাপক পদে যোগ দান করেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে দৌলতপুর কলেজের এবং ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ঐ বছরের ২৭ নভেম্বর পূর্ব বাংলা স্কুল টেক্সট বুক বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ব বাংলা সেকেন্ডারি এডুকেশন বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদান করেছিলেন। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা একাডেমির প্রথম পরিচালক পদে যোগদান করেন। অতঃপর বাঙলা উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক হিসেবে ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন। পরবর্তীতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে সুপার নিউমারি প্রফেসর হিসেবে পুনরায় কর্মজীবনের সূচনা করেন। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে যোগ দেন। এত দায়িত্বপূর্ণ পদাধিকারের ফাঁকে মুহম্মদ এনামুল হক এশিয়াটিক সোসাইটি, বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ, বাংলা ভাষা সমিতি, বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটির মতো সংস্থারও স্থপতির ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে আমৃত্যু ঢাকা জাদুঘরের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ছিলেন। মুহম্মদ এনামুল হক স্কুল জীবন থেকে স্বদেশ মন্ত্রে উজ্জ্বীবিত হয়ে ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশ করে আবাহন নামের গানের বই। প্রকাশক ছিলেন ত্রিপুরা চৌধুরী বইটি রাজরোষের শিকারে বাজেয়াপ্ত হয়। পরের বছর প্রকাশিত হয় নিরীক্ষাধর্মী কাব্যগ্রন্থ ঝর্ণাধারা-ফারসি চতুষ্পদীয় আবহে লেখা ৪৭টি রুবাই। তাঁর অপ্রকাশিত কবিতার বই হল প্রতিবিম্ব। তাঁর অবিস্মরণীয় কীর্তি বঙ্গে সুফী প্রভাব (১৯৩৫), আরাকান রাজসভায় বাঙ্গালা সাহিত্য (আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের সহযোগে ১৯৩৫), চট্টগ্রামী বাঙ্গালার রহস্য ভেদ (১৯৩৫), বাঙলা ভাষার সংস্কার (১৯৪৪), পূর্ব পাকিস্তানে ইসলাম (১৯৪৮), ব্যাকরণ মঞ্জরী (১৯৫২), মুসলিম বাঙ্গালা সাহিত্য (১৯৫৭), মনীষা মঞ্জুষা (১৯৭৫-১৯৮৪), বুলগেরিয়া ভ্রমণ (১৯৭৮) এবং বাংলাদেশের ব্যবহারিক বাংলা অভিধান (১৯৭৪)। সম্পাদিত গ্রন্থ : আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ সংগৃহীত ৭টি পুঁথি যোগকলন্দর, ইমরুল কায়েসের কাব্য, শেখ জাহিদে আদ্য পরিচয় (১৯৮০)। উর্দু গ্রন্থ দীন ইসলাম তরজমাও তার বিশিষ্ট কীর্তি। বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী ড. মুহম্মদ এনামুল হক ঢাকার পি.জি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ফেব্র“য়ারি ইন্তেকাল করেন। মুহম্মদ এনামুল হক-কে নিয়ে ড. মজির উদ্দীন মিয়া সম্পাদিত মূল্যায়নধর্মী জীবনী গ্রন্থ (১৯৮৪), বাংলাদেশ ভাষা সমিতি কর্তৃক প্রকাশিত মুহম্মদ এনামুল হক স্মারকগ্রন্থ (১৯৮৩), মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান সম্পাদিত এশিয়াটিক সোসাইটির স্মারকগ্রন্থ এবং মোহাম্মদ আবদুল কাইউম রচিত ড. মুহম্মদ এনামুল হক স্বতন্ত্র জীবনীগ্রন্থ (১৯৮৭) এবং ভাষাবিজ্ঞানী ড. মনসুর মুসা সম্পাদনায় ৫ খণ্ডে মুহম্মদ এনামুল হক রচনাবলী (১৯৯১-১৯৯৫) প্রকাশ করে বাংলা একাডেমি। সাহিত্য ও শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদান রাখায় মুহম্মদ এনামুল হক ১৯৬৪-তে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার, ১৯৬৮-তে সিতারা-ই-ইমতিয়াজ (পরবর্তীতে প্রত্যাখ্যান), ১৯৭৯-তে একুশে পদক, ১৯৮০-তে শেরে বাংলা সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮১-তে মুক্তধারা সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন।

সম্পাদনায় : আইউব সৈয়দ, উপদেষ্টা সম্পাদক, সিটিজি সংবাদ.কম।