image

প্রশাসনে পদোন্নতিতে ‘বৈষম্যের শিকার’: অন্যান্য ক্যাডারে চরম অসন্তোষ

image

প্রশাসনে আরেক দফায় পদোন্নতির প্রক্রিয়া চলছে। অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতির প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত। চলতি সপ্তাহেই পদোন্নতির প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে। সর্বশেষ ৫ আগস্ট অনুষ্ঠিত এসএসবি বৈঠকে যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতির আলোচনা হয়েছে। এটি চূড়ান্ত হওয়ার পর উপসচিবের প্রক্রিয়া শুরু হবে। উপসচিব পদে পদোন্নতির জন্য ইতিমধ্যেই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষিসহ অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের তালিকা নেওয়া হয়েছে।
এবার যুগ্ম সচিব পদের জন্য বিবেচিত হচ্ছেন প্রশাসন ক্যাডারের ১৫তম ও ১৭তম ব্যাচের কর্মকর্তারা। অতিরিক্ত সচিব পদে দশম ব্যাচকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। তাদের সঙ্গে বিভিন্ন ব্যাচের বঞ্চিত কর্মকর্তাদেরও কিছুসংখ্যককে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। সব কিছু মিলিয়ে বিভিন্ন ব্যাচের পাঁচ শতাধিক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হতে পারে। তবে প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের এই পদোন্নতিতে নিবর্তনমূলক পদ্ধতি চালু রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন প্রশাসন ক্যাডারের বাইরের অনেক কর্মকর্তারা। তাদের অভিযোগ, বিদ্যমান বিধিমালা ডিঙ্গিয়ে প্রশাসন ক্যাডারের জুনিয়র কর্মকর্তাদের স্বার্থ রক্ষায় পদোন্নতিতে অলিখিত বিশেষ পদ্ধতি অব্যাহত রয়েছে। অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা পদোন্নতির সব যোগ্যতা ও শর্ত পূরণ করা সত্ত্বেও প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের ফিডার পদে চাকরির শর্ত পূরণ না হওয়ায় বছরের পর বছর বিধিবহির্ভূতভাবে তাদেরকে পদোন্নতি দেয়া হচ্ছে না। এমনকি পদোন্নতির উপযুক্ত তালিকায় তাদের নামও অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রশাসনে পদোন্নতির ক্ষেত্রে এই বৈষম্য নিয়ে বিভিন্ন ক্যাডারের শ’ শ’ কর্মকর্তার মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে।
প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে পদোন্নতিতে এই বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন বিভিন্ন ব্যাচের এবং ক্যাডারের কর্মকর্তারা। তারমধ্যে দেখা যাচ্ছে, বিসিএস নবম ব্যাচের আছেন ২১ জন কর্মকর্তা। অন্যান্য ক্যাডারের এই কর্মকর্তারা যুদ্মসচিব পদে পদোন্নতির জন্য অপেক্ষমান। যারা চাকরিতে যোগদান করেছিলেন আজ থেকে ২৭ বছর আগে ১৯৯১ সালে। তারা উপসচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন প্রশাসন ক্যাডারের ২০ তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ২০১৫ সালে। বিধি অনুযায়ী যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতির সব শর্তও ইতোমধ্যে পূরণ হয়েছে নবম ব্যাচ কর্মকর্তাদের। কিন্তু তা সত্ত্বেও যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতির জন্য যোগ্যদের তালিকায় নাম ওঠেনি। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, চাকরিতে তাদের চেয়ে ১১ বছরের জুনিয়র ২০ ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের উপ-সচিবদের যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতির শর্ত এখনো পূরণ হয়নি। শর্ত পূরণ হতে তাদের আরো দুই বছর সময় লাগবে। আর এই জুনিয়র কর্মকর্তাদের পদোন্নতির শর্ত পূরণের অপেক্ষায় আটকে রাখা হচ্ছে ১১ ব্যাচ সিনিয়র কর্মকর্তাদের পদোন্নতি। বর্তমানে কার্যকর ‘সরকারের উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদে পদোন্নতি বিধিমালা ২০০২’ অনুযায়ী, উপসচিব থেকে যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতির জন্য প্রশাসন ক্যাডারের কর্মচারীদের ১৫ বছরের মোট চাকরিসহ ফিডার পদে ৫ বছর এবং অন্যান্য ক্যাডারের কর্মচারীদের জন্য ২০ বছরের মোট চাকরিসহ ফিডার পদে ৩ বছরের চাকরি প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে নবম ব্যাচের কর্মকর্তাদের মোট চাকরির বয়স ২৭ বছরেরও বেশি। এরমধ্যে উপসচিব পদেও তিন বছর পূর্ণ হয়েছে। নবম ব্যাচের কর্মকর্তা হিসেবে উপসচিব পদে কর্মরতদের মধ্যেও তারা জ্যেষ্ঠ। তারপরেও পদোন্নতির ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ এই কর্মকর্তাদের। তারা জানান, ইতোমধ্যে দশম, একাদশ ও ত্রয়োদশ ব্যাচের জুনিয়র কর্মকর্তারাও যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। ওইসব জুনিয়র কর্মকর্তাদের অধীনে মানসিক কষ্ট নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় চাকরি করছেন তারা। ১৫ তম ও ১৭ তম ব্যাচের উপসচিবদেরও যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতির প্রক্রিয়া চলছে। অথচ নবম ব্যাচের এইসব উপসচিবদের চাকরি থেকে অবসর নেয়ার সময়ও ঘনিয়ে এসেছে। তারা আর মাত্র ২ থেকে ৪ বছর চাকরিতে আছেন। অথচ তারপরেও তাদের পদোন্নতির বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে না। ফলে কেউ কেউ যুগ্মসচিব হবার আগেই পিআরএল-এ চলে যাচ্ছেন। কেউ কেউ যুগ্মসচিব হয়েই পিআরএল-এ যাবেন। ২০ ব্যাচের উপসচিব পদে কর্মরত প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের চাকরির মেয়াদ আছে এখনো ১২-১৫ বছর।  আর তাদের যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব হবার অবারিত সুযোগ তো আছেই। অন্যান্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের অভিযোগ, বিদ্যমান বিধিমালায় না থাকা সত্ত্বেও নিবর্তনমূলক এ পদোন্নতি পদ্ধতি চালু থাকার কারণে নবম ব্যাচের কর্মকর্তাদের ১০ম, ১১ তম, ১৩ তম, ১৫ তম, ১৭ তম, ১৮ তম ব্যাচের অধীনে দাবিয়ে রাখা হচ্ছে। যা জ্যেষ্ঠতার চরম অপমান। বিসিএস কর্মকর্তাদের মর্যাদা ও সম্মান রক্ষার্থে এর আশু প্রতিকার হওয়া প্রয়োজন। তাদের অভিযোগ, এতো দিন ধরে দক্ষতা, যোগ্যতা, দায়িত্বপরায়ণতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেও পদোন্নতি বঞ্চিত হওয়ায় তারা পারিবারিক, সামাজিক ও দাপ্তরিকভাবে বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন। ২০০২ সালের পদোন্নতি বিধিমালায় পদোন্নতির ভিত্তি হিসেবে বলা হয়েছে, ‘পদোন্নতি প্রদানের ভিত্তি হইবে কর্মকর্তার মেধা, দক্ষতা ও জ্যেষ্ঠতা।’ আরো বলা আছে, ‘৩০ শতাংশ পদ অন্যান্য সকল ক্যাডারের উপসচিব পদে কর্মরত কর্মকর্তাদের মধ্য হইতে পদোন্নতির মাধ্যমে।’ কিন্তু বিগত দুবারে যুগ্মসচিব পদে অন্যান্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ কোটার স্থলে অতিনগন্য সংখ্যক কর্মকর্তাকে বিবেচনা করা হয়েছে। কর্মকর্তাদের অভিযোগ, এভাবে চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছর পর অতিরিক্ত সচিব বা সচিব পদে পদোন্নতির জন্য অন্যান্য ক্যাডারের কোনো কর্মকর্তাকেই আর পাওয়া যাবে না। 
একইভাবে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে যুগ্মসচিব পদে কমপক্ষে তিন বছরের চাকরিসহ মোট ২০ বছরের চাকরি অথবা দুই বছরের অভিজ্ঞতাসহ ২২ বছরের মোট চাকরি প্রয়োজন। এক্ষেত্রেও অন্যান্য ক্যাডার কমকর্তাগণকে বিধিবহির্ভূতভাবে এক বছর বসিয়ে রাখা হয়। উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রেও নিবর্তনমূলক এই পদ্ধতি চালু রয়েছে।
এবার উপসচিব হিসেবে পদোন্নতি পাচ্ছেন প্রশাসন ক্যাডারের ২৫তম ব্যাচের কর্মকর্তারা, যারা ২০০৬ সালে চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। একই পদে পদোন্নতির জন্য তালিকা চাওয়া হয়েছে অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের, যারা বেশির ভাগই ১৫তম বিসিএসের, যারা চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৯৫ সালে। অর্থাৎ প্রশাসন ক্যাডারের প্রায় ১১ বছরের জুনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে উপসচিব হিসেবে পদোন্নতি পাবেন অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা। 
প্রশাসন ক্যাডারের ৮ম ব্যাচ ও ১৩ তম ব্যাচ পর্যন্ত কর্মকর্তারা যথাক্রমে অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্মসচিব হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন। এর বিপরীতে অন্যান্য ক্যাডারের ৮ম, ৯ম, ১০ম, ১১ তম, ১৩ তম, ব্যাচের কয়েকশ কর্মকর্তা পদোন্নতির  সকল শর্ত ও যোগ্যতা পূরণ করেও পদোন্নতি পাননি  এবং উপসচিব হিসেবে জুনিয়রদের অধীনে চাকরি করছেন। 
 বর্তমানে আবার অতিরিক্ত সচিব পদে প্রশাসন ক্যাডারের ১০ ম ব্যাচ ও যুগ্মসচিব পদে ১৫ তম ও ১৭ তম ব্যাচকে বিবেচনা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। কিন্তু এ পদোন্নতির প্রক্রিয়ায়ও অন্যান্য ক্যাডারের ওইসব ব্যাচের কর্মকর্তাগণকে পদোন্নতির জন্য বিবেচনা করা হচ্ছে না। এসব ব্যাচের কর্মকর্তারা এসএসবির সদস্যদের কাছে ধর্না দিচ্ছেন। আইনগত পথ খুঁজছেন। তাদের শঙ্কা এই নিবর্তনমূলক  ও বৈষম্য সৃষ্টিকারী পদ্ধতির কারণে তারা অনেকে হয়তো যুগ্মসচিবই হতে পারবেন না। কিছু কর্মকর্তার কপালে যুগ্মসচিব হওয়া ভাগ্যে জুটলেও  সেখানেই শেষ হবে। 
২৫তম বিসিএস অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০০৪ সালে। ওই বিসিএসে উত্তীর্ণ প্রার্থীরা চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন ২০০৬ সালে। প্রশাসন ক্যাডারের মতো ওই ব্যাচের অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারাও সিনিয়র স্কেল পদমর্যাদা পেয়েছেন। ওই ব্যাচের একটি ক্যাডারে মেধাতালিকার শীর্ষে অবস্থানকারী এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা একই বিসিএসে একই প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিয়েছি। পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের যেসব শর্ত পূরণ করতে হয়েছে আমাদেরও একই শর্ত পূরণ করতে হয়েছে। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা উপসচিব হয়ে যাচ্ছেন। আমাদের ক্যাডারের যেসব কর্মকর্তা উপসচিব পদে পদোন্নতি পেতে চান তাদেরকে কমপক্ষে ১০ বছর অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
আজ যারা ২৫তম বিসিএসের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে উপসচিব পদে পদোন্নতি পাচ্ছেন তাদের বেশির ভাগই ১৫তম বিসিএসের কর্মকর্তা। ১৫তম বিসিএসে যারা প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দিয়েছিলেন তাদেরকে আজ যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে।
তথ্য (প্রফেশনাল) ক্যাডারের এক কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, আমাদের বিভাগীয় পদোন্নতিতেও জটিলতা রয়েছে। এই জটিলতার নেপথ্যে রয়েছেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারাই। কারণ প্রতিটি ক্যাডারের বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটিতে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা রয়েছেন। সব শর্ত পূরণ করা হলেও পদ ফাঁকা না থাকার অজুহাতে তারা আমাদের পদোন্নতি দেন না। কিন্তু প্রশাসন ক্যাডারের পদোন্নতিতে পদ ফাঁকা থাকার দরকার হয় না। এই যে উপসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে সেখানে কয়েক শ কর্মকর্তা পদোন্নতি পাবেন। অথচ উপসচিব পদ এক হাজার ৩২৪টি। জুন মাসের হিসাব অনুযায়ী এসব পদে এখনই কর্মরত আছেন এক হাজার ৭৫৯ জন। যুগ্ম সচিবের ৩৮৪টি পদে কর্মরত আছেন ৮০৬ জন। আর অতিরিক্ত সচিবের ১২১টি পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন ৫০৬ জন।
পদোন্নতির বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, পদোন্নতি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সব সময় পদোন্নতির কাজ করতে থাকে সংশ্লিষ্ট অনুবিভাগ। যাঁরা যোগ্যতা অর্জন করেছেন তাঁরা পদোন্নতি পাবেন। অথচ দেখা যাচ্ছে, যথাযথ যোগ্যতা অর্জন করার পরও অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের ন্যায্য পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। আর এ নিয়ে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে।
(সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজে ৬ আগস্ট ২০১৮ প্রকাশিত)