সাগরপথে অবৈধভাবে ঝুঁকি নিয়ে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার জন্য আবারো তৎপর হয়ে উঠেছে রোহিঙ্গারা। মুঠোফোনে যোগাযোগ, নির্ধারিত বিকাশে টাকা পরিশোধের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট দালালের হেফাজতে ইতিমধ্যে বেশ কিছু রোহিঙ্গা পাচার হয়ে গেছে।
বৃহস্পতিবার আরো একটি ফিশিংবোটে প্রায় শতাধিক অবৈধ মালয়েশিয়াগামী পাড়ি জমাতে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এমন খবরের ভিত্তিতে উখিয়া থানা পুলিশের একটি দল উখিয়ার উপকূলীয় এলাকার মানব পাচারের নিরাপদ রুট ডেইলপাড়া গ্রামের মৃত আজিজুল হকের ছেলে আব্দুল কাদেরের বাড়িতে অভিযান চালায়। সেখানে নারী, পুরুষ, শিশুসহ ২০জন মালয়েশিয়া গমনেচ্ছুক রোহিঙ্গা নাগরিককে আটক করে।
আটককৃতরা হচ্ছে, বালুখালী ক্যাম্পের হামিদা বেগম (২০), তার মেয়ে শউকত আরা (৫), থাইংখালী ক্যাম্পের জুবাইদা (২৫) তার মেয়ে রেনেছা (৫), একই ক্যাম্পের হামিদা বেগম (২০), কুতুপালং ক্যাম্পের তাহমিনা বেগম (১৮), বালুখালী ক্যাম্পের শারমিন আকতার (১৬), কুতুপালং ক্যাম্পের ইয়াছমিন আকতার (১৮), তাজনিমারখোলা ক্যাম্পের মোঃ আমিন (২০), বালুখালী ক্যাম্পের ফয়েজুল ইসলাম (১৫), তাজনিমারখোলা ক্যাম্পের নুর কামাল (২৪), বালুখালী ক্যাম্পের মোঃ ইউনুছ (১৯), তাজনিমারখোলা ক্যাম্পের শফি আলম (২৫), বালুখালী ক্যাম্পের হেদায়েত উল্লাহ (১৫), কুতুপালং ক্যাম্পের ছলিমুল্লাহ (১৯), ইমাম হোসেন (২০), জাহিদ উল্লাহ (২৮), ছানা উল্লাহ (২০), লম্বাশিয়া ক্যাম্পের মোঃ আমিন (২০) ও বান্দরবান লামা দোলহাজারা গ্রামের আব্দুর রহিম (২০)।
আটককৃত কয়েকজন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, '২০১২ সালের দিকে তাদের নিকট আত্মীয়রা সাগরপথে মালয়েশিয়া চলে গেছে। বর্তমানে তারা সেখানে বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি কাজে নিয়োজিত। বাসাভাড়া নিয়ে তারা সুখে জীবন যাপন করছে। তারা মুঠোফোনে বারবার তাগিদ দেওয়ার কারণে বিকাশে টাকার লেনদেন করে ডেইলপাড়া গ্রামের লেং শামশুর ছেলে দালাল শাহজান, হিজোলীয়া গ্রামের জলু আহম্মদের ছেলে নুরুল্লার মাধ্যমে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য আব্দুল কাদেরের বাড়িতে ৪/৫ দিন ধরে অবস্থান করছে।'
উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ আবুল খায়ের জানান, 'এ ঘটনায় শাহজান ও নুরুল্লাসহ ৮ জনকে এজাহারনামীয় আসামি করে উখিয়া থানায় মানবপাচার আইনে একটি মামলা রুজু করা হয়েছে। যার নং-৯, তারিখঃ ৮/২/২০১৯।'
উল্লেখ্য, ২০১২ সালে সীমান্তের নাফনদী পার হয়ে প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা কুতুপালং বনভূমির জায়গায় ঝুপড়ি বেধে আশ্রয় নেয়। এ সময় জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন পুলিশ বিজিবি ও বনকর্মীরা শত চেষ্টা করেও এসব রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে পারেনি। এমতাবস্থায় তৎকালীন জেলা প্রশাসক ফজলুল বারী অনুপ্রবেশকারী এসব রোহিঙ্গাদের কোন প্রকার সহায়তা প্রদান না করার জন্য সকল এনজিও প্রতিষ্টানকে নির্দেশ দেন।
এসব রোহিঙ্গা বিভিন্ন দালালের মাধ্যমে উখিয়ার উপকুলীয় এলাকার সোনাইছড়ি বাদামতলীর, ঘাটঘর, রেজু মোহনা, ঘোয়ালিয়া, ছেপটখালী, মনখালীসহ বিভিন্ন এলাকা দিয়ে ফিশিংবোটে করে সাগরপথে মালয়েশিয়ায় অনিশ্চিত যাত্রা শুরু করে। জালিয়াপালং ইউনিয়নের প্রায় শতাধিক দালাল চক্র এসব রোহিঙ্গাদের মালয়েশিয়া পাড়ি জমাতে সহযোগিতা করে। যার ফলে মানব পাচারের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে।
২০১৪ সালে রোহিঙ্গা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সোনার হরিণ ধরার আশায় মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ উপকূলে ভিড় জমাতে শুরু করে। উখিয়া উপজেলা মানব পাচার প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি আবুল কাশেম ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হামিদ মানব পাচার প্রতিরোধে উপকূলীয় এলাকায় ১০১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করে। তারা মানব পাচার প্রতিরোধে বাধা দিলে তৎকালীন মানব পাচারের অন্যতম হোতা সোনারপাড়া গ্রামের নুরুল কবিরের স্ত্রী রেবী ম্যাডাম তার স্কুল পড়ুয়া মেয়েকে দিয়ে আব্দুল হামিদের বিরুদ্ধে একটি নারী নির্যাতন মামলা দায়ের করেন।
এ ঘটনা নিয়ে মানব পাচার প্রতিরোধে মানব বন্ধন, সভা সমাবেশ ও আইনশৃংলাবাহিনীর ধারাবাহিক অভিযানের ভিত্তিতে মানব পাচার বন্ধ হয়ে যায়।
এনজিও গাড়িতে করে রোহিঙ্গা পাচারকালে উখিয়ায় আটক-৫ : রোহিঙ্গাদের সেবায় নিয়োজিত বিভিন্ন দেশী বিদেশী এনজিওর বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের পাচারের অভিযোগ স্থানীয় লোকজনের। এসব অভিযোগ প্রশাসন বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ গুরুত্ব তেমন দিচ্ছে না।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে এ ধরনের রোহিঙ্গা নারী পাচারের সময় একটি এনজিওর গাড়ি থেকে স্থানীয় জনতা তিন জন রোহিঙ্গা নারী ও দুই জন পুরুষকে আটক করে উখিয়া থানায় সোপর্দ করেছে। কর্মীদের কৌশলে এনজিও গুলো রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুদের বিভিন্ন ভাবে পাচার করে আসছে অনেকদিন ধরে।
গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে উখিয়া বাস ষ্টেশনে মসজিদ মার্কেট এলাকায় এনজিও হিউম্যানি টেরা নামক একটি এনজিও গাড়ি থেকে স্থানীয় লোকজন পাঁচজন রোহিঙ্গাকে আটক করে। উক্ত এনজিওর মাইক্রো বাসে তাদের কর্মীদের সাথে মিশিয়ে এসব রোহিঙ্গাদের অজ্ঞাত স্থানে পাচারের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাচ্ছিল বলে জানা গেছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী রমজান আলী সওদাগর সহ লোকজন বলেন, এলাকাবাসী দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গাদের সেবার নামে নিয়োজিত এনজিও গুলোর কর্তৃক ছদ্মবেশে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন স্থানে পাচার করে আসছে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এ ধরনের একটি এনজিওর গাড়ি মসজিদ মার্কেটের সামনে পার্কিং করলে উক্ত গাড়িতে স্থানীয় লোকজন সন্দেহ জনক ভাবে জিজ্ঞেসা করলে কুতুপালং ক্যাম্প-৩ এর করিম উল্লাহ ছেলে মোঃ জুহা (৩০),বালুখালী-১ ক্যাম্পের জি-১৬ ব্লকের কলিম উল্লাহ মেয়ের হুমাইরা (২০) একই ক্যাম্পে সোনা মিয়ার মেয়ে আরেফা বেগম (১৭), জামতলী ক্যাম্পের এ-৩ ব্লকের আয়ুবুল হকের মেয়ে নুর বেগম (১৮) ও থাইংখালী ক্যাম্পে এফ-১০ ব্লকে মোঃ খলিলের ছেলে মোঃ আলী (১৬) নিজেরা রোহিঙ্গা বলে স্বীকার করে।
এ সময় সুচুতুর এনজিও হিউম্যানি টেরা এনজিওর মাইক্রো বাস চালক দ্রুত রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষদের গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি (চট্ট মেট্টো শ ০০-১২৫) নিয়ে পালিয়ে যায়। স্থানীয় লোকজন ধারনা করছে উক্ত গাড়িতে থাকা গাড়ি চালক ও এনজিও কর্মীরা যোগসাজস করে এসব রোহিঙ্গাদের পাচার করছিল। পরে স্থানীয় লোকজন উখিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ নিকারুজ্জামান চৌধুরীকে ফোনে জানালে তিনি দ্রুত উখিয়া থানা থেকে পুলিশ পাঠিয়ে উক্ত রোহিঙ্গাদের পুলিশ হেফাজতে নিয়ে যায়।
Developed By Muktodhara Technology Limited