image

উচ্ছেদ: দখল-বেদখল, অদল-বদল

image

চট্টগ্রাম মহানগরী তথা দেশের প্রায় সকল শহর গ্রাম-বন্দরে সরকারী সম্পত্তি যুগ যুগ ধরে প্রভাবশালী থেকে শুরু করে চুনোপুঠিরাও নিজেদের দখলে নিয়ে ভোগ করে যায় অবলীলায়। এ দখল প্রক্রিয়া কিন্তু একদিনে হয়না। শুরুতে অল্প অল্প করে দখল অতপর পুরোটাই গিলে ফেলে অস্থিত্বই মুছে ফেলে সরকারী নিশানার। একপর্যায়ে মনে হয়না একদা এখানে একটা খাল-নদী,সড়ক কিংবা খোলা মাঠ ছিল। ব্যক্তির ভূ-সম্পত্তিতেই রূপ নেয় দলখকৃত এলাকা। কিন্তু “যার বিয়ে তার খবর নেই, পাড়া প্রতিবেশীর ঘুম নেই” এ প্রবাদের মতো যখন যে কর্তৃপক্ষের জায়গা দখল হয়, তখন সে কর্তৃপক্ষ নাকে সরষে’র তেল দিয়ে ঘুমিয়ে থাকেন। যেন, সরকারের সম্পত্তি গেলে তাদের কি, এমনটাই ভাব। পাড়া প্রতিবেশী বলতে, সাধারণ জনগণ কিংবা বিভিন্ন সংগঠন এসব দখলের প্রতিবাদ কিংবা দখলমুক্ত করার দাবী জানালেও কর্তৃপক্ষের ঘুম সহজে ভাঙেনা। দখল করার সুযোগই যদি দেওয়া না হতো, তাহলে উচ্ছেদ’র প্রশ্ন আসতো কখনো।

আসা যাক উচ্ছেদ প্রসঙ্গে। চট্টগ্রামে এখন চলছে কর্ণফুলীর তীরে সদরঘাট থেকে বারিক বিল্ডিং পর্যন্ত উচ্ছেদ কার্যক্রম। উচ্ছেদকারী সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে ইতোমধ্যে ৪দিনে প্রায় ৭একর জায়গা দখলমুক্ত করা হয়েছে (শুক্রবার পর্যন্ত হিসেব মতে)। এ উচ্ছেদ প্রক্রিয়ায় নগরবাসী উচ্ছ্বসিত। তারা সাধুবাদ জানিয়েছে সরকারের এ পদক্ষেপকে এবং নগরবাসী আশা করেন, এ উচ্ছেদ কার্যক্রম স্থায়ী হবে। উচ্ছেদ হওয়ার কিছুদিন পর আবারো এ জায়গা দখল হবেনা এমনটাই প্রত্যাশা নগরবাসীর। মাননীয় ভুমিমন্ত্রী ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের মুখে এরকম দৃঢ় প্রত্যয়ী বক্তব্যই তাদের এ আশা সঞ্চারের মুল জায়গা। যুগের পর যুগ সরকারী এত বিশাল সম্পত্তি যারা ভোগ দখল করেছে তারাও বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেছে উচ্ছেদ কার্যক্রম থামিয়ে দিতে। কিন্তু ভূমিমন্ত্রী তথা সংশ্লিষ্টদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় এ যাত্রায় ভেস্তে গেছে তাদের সকল অপচেষ্টা। ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ঘোষণা দিয়েছেন, আর ১ইঞ্চি জায়গাও দখল করতে দেয়া হবেনা। শুভ উদ্যোগ। দখলমুক্ত করা জায়গায় নগরী তথা কর্ণফুলীর সৌন্দর্য্য বর্ধনে নান্দনিক স্থাপনা তৈরী করার ইচ্ছার কথাও তিনি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন। নইলে উচ্ছেদ’র পর আবারো সে খালি জায়গা দখলমুক্ত হবেনা এমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবেন না।

ইতোপূর্বে চট্টগ্রাম নগরীতে সম্পাদিত সকল উচ্ছেদ কার্যক্রমকেই (ব্যতিক্রম দু/একটা বাদে) নগরবাসী দখলের হাত বদল কিংবা অদল-বদল বলে আখ্যায়িত করেছেন। নগরীর আইসফ্যাক্টরী রোড, সিরাজদ্দৌলা রোড, জাম্বুরী মাঠের পূর্ব সড়ক, আগ্রাবাদ এক্সেস রোড, নিমতলা বিশ্বরোড, চকবাজার, নিউ মার্কেট এলাকাসহ যত এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে দলখমুক্ত করা হয়েছিল কিছুদিন যেতে না যেতেই তা পূনরায় দখল হয়ে গেছে। এখানে কেবল কোথাও কোথাও হাত বদল হয়েছে। আগে হয়তো একজনের দখলে ছিল, পরবর্তীতে অন্যজনের। কিংবা পূর্বের দখলকারীই আবার পূনরায় নিজের আয়ত্তে নিয়েছেন। তাহলে, এত আয়োজন, রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয় করে এ উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনায় লাভটা কার? পরিকল্পনার অভাব, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য না থাকায় উচ্ছেদ অভিযানের পর খালি জায়গা পরে থাকায় পুনরায় তা দখলে নেয় সুযোগ সন্ধানীরা। এ ক্ষেত্রে পূর্বের চেয়ে বরং দীর্ঘস্থায়ী স্থাপনা তৈরী করেই দখল করা হয়। নগরবাসীর অভিযোগ, দখল করার উদ্দেশ্যে কোন কোন চক্র নিজেরা অর্থ ব্যয় করেই এ উচ্ছেদ কার্যক্রমের আয়োজন করে থাকে। অর্থ্যাৎ, দখলে থাকা গোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করে নিজেদের করে নেওয়ার জন্যও অনেকে বিনিয়োগ করে থাকেন এমন কথা জনমুখে প্রচলিত রয়েছে।

উচ্ছেদ কার্যক্রম তখনই প্রয়োজন হবেনা, যখন সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরসমূহ নিজেদের সম্পদ রক্ষায় আন্তরিক হবেন। কারণ, দখল করতে না দিলেই আর উচ্ছেদ কার্যক্রমের প্রয়োজন পড়েনা। ফুটপাত দখলমুক্ত করতে গেলে পূনর্বাসনের কথা আসে, কিন্তু কেউতো তাদেরকে এখানে ডেকে এনে বসায়নি। সরকারী জায়গা দখল করে যেখানে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন, সেখানে তারা উল্টো পূনর্বাসন দাবী করেন। এটা পুরোপুরি অযৌক্তিক ও বেআইনী। এমনতো নয়, সরকার কিংবা প্রশাসন তাদেরকে ডেকে এনে এখানে বসিয়েছেন ব্যবসা করার জন্য। তারা নিজেরাই কাউকে কাউকে ম্যানেজ করে ফুটপাত কিংবা সরকারী সড়ক দখল করে জনগণের স্বাভাবিক চলাচলকে বিঘিœত করেছেন। সরকারী দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের ম্যানেজড হওয়ার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সরকার দলীয় নেতা-পাতি নেতারাও অনেক সময় এ দখল প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত থাকেন, তাদেরকেও জনস্বার্থে এ অবৈধ কাজ থেকে সরে আসা উচিত। কখনো কখনো উচ্ছেদ চালাতে গিয়ে জানমালের ক্ষতিও হয়ে থাকে। দলখকারীদের শক্ত বাধায় আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীকেও বেগ পেতে হয়। সৃষ্টি হয় জনদূর্ভোগের। এ দায় কার?

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অব্যাহত রাখতে এবং সর্বোপরি আগামীর বাসযোগ্য নগরী গড়তে সচেতন হওয়ার এখনই সময়। নদী-নালা, বন-জঙ্গল কিংবা গাছ-গাছালি প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার প্রধান নিয়ামক। সেগুলো বিলীন করে স্থাপনা তৈরীর মাধ্যমে পরিবেশ বিপর্যের পথেই ধাবিত হচ্ছি আমরা প্রতিনিয়ত। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা হয়তো রক্ষা পেতে পারি এ অবৈধ দখলদারদের কালো থাবা থেকে। আসুন সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ হই। হাত-বদলের এ প্রক্রিয়াও যেন থামে। জনগণ দেখতে চায়, অর্থের অপচয় কিংবা লোক দেখানো ক্রেডিট নয়, প্রকৃত অর্থেই এ উচ্ছেদ দেশের স্বার্থে-দশের স্বার্থে।