image

লায়ন্স স্কলারশিপ ট্রাস্টের উদ্যোগ, ওদের বিবর্ণ জীবনে এখন শুধু আলো

image

দৈনিক আজাদী’র সৌজন্যে ডেস্ক রিপোর্ট : বিবর্ণ জীবনের গল্প শুনাচ্ছিলো তারা। কেউ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়ে। কেউবা ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। আবার কেউ কেউ পড়ছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। চোখের আলো নেই। পড়ছে মনের আলোতে। ইংরেজি সাহিত্যের মতো কঠিন বিষয় রপ্ত করতে মরিয়া তারা। আবার কেউবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে বিজনেস এডমেনিস্ট্রেশনে। চুয়েটে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে কেউ। কিন্তু সবারই জীবন থমকে যাওয়া। কারো পিতা নেই। কারো পিতা পঙ্গু। কারোবা অসুস্থ। আবার কারো পিতা ছোটবেলায় পুরো পরিবারকে জলে ভাসিয়ে হাত ধরেছে অন্যজনের। অথচ তারা পড়ছে। আর এদের লেখাপড়ার ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে লায়ন্স স্কলারশিপ ট্রাস্ট। লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যশনাল ডিস্ট্রিক-৩১৫বি৪ এর একটি স্থায়ী প্রকল্প। এই ট্রাস্টের বৃত্তি নিয়ে অতি দরিদ্র পরিবারের কিছু মেধাবী সন্তান জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। গতকাল শুক্রবার এই বৃত্তিপ্রদান অনুষ্ঠানে জীবনে নানা চড়াই উৎরাই পার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে আসা শিক্ষার্থীরা নিজেদের বিবর্ণ জীবনের গল্প বলছিল। নিজেদের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে তারা শোনাচ্ছিল পাজরভাঙ্গা নানা শব্দমালা। জাকির হোসেন রোডস্থ লায়ন্স ফাউন্ডেশনের হালিমা রোকেয়া হল ভর্তি বিভিন্ন লায়ন্স ক্লাবের সদস্যরা। শহরের সিংহহৃদয় মানুষগুলো জড়ো হয়েছেন অনুষ্ঠানটিকে ঘিরে। বৃত্তির টাকা তুলে দেয়ার পর তাদের অনুভূতি বলতে দেয়া হলে হল জুড়ে শুরু হয় চোখের জল মোছা। কষ্ট! এত কষ্টও মানুষের হয়। এত কষ্টের সাগর মহাসাগর পাড়ি দিয়ে অদম্য মেধাবী বাচ্চাগুলো এতদূর আসতে পেরেছে। বাকি পথও তাদের সাথে থাকবেন লায়ন্স ক্লাবের সদস্যরা।

অন্ধ আবদুর রাজ্জাকের চোখতো নেই। কোন ভরসার জায়গাও নেই। লালমনিরহাটের আহের আলীর পুত্র রাজ্জাকের তিন ভাই এক বোন। বাকি দুই ভাই দিনমজুর। রাজ্জাকেরও কথা ছিল দিনমজুর হওয়ার। কিন্তু কেমন কেমন করে যেন রাজ্জাক নিজের গল্পটা একটু অন্যরকম করে সাজিয়ে নেয়। এসএসসি পাস করে পাড়াপড়শির সহায়তা নিয়ে। নানা জনের সাহায্য সহায়তায় এইচএসসিও পাস করে। কিন্তু আর না। সামনে যাওয়ার আর কোন পথ নেই। রাজ্জাকের চোখ নেই। মনেই অন্ধকার দেখতে শুরু করে। ভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে সুযোগ জুটে যায়। কিন্তু ভর্তি হওয়ার মতো টাকা তার হাতে নেই। নেই দিনমজুর ভাই কিংবা মা বাবার হাতেও। পরিচিত একজনের কাছ থেকে হাওলাত নিয়ে সাহস করে ভর্তি হয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরবর্তীতে ডাচ বাংলা ব্যাংকের বৃত্তি পেয়ে সেই ঋণ শোধ করে রাজ্জাক। পরবর্তী গল্প শুধু যুদ্ধের। সংগ্রামের। বেঁচে থাকার। রাজ্জাক এবার লায়ন্স স্কলারশিপ ট্রাস্টের বৃত্তি পেয়েছে। এই টাকা দিয়ে তার লেখাপড়ার পথ সুগম হবে।

অন্ধ রাজ্জাক যখন মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তব্য রাখছিল তখন অনুষ্ঠানের প্রায় সকলেই চোখ মুছছিল। রাজ্জাকের কষ্ট শুধু অর্থের নয়। দৃষ্টিরও। সে চোখে দেখে না। এতে করে অন্য কেউ একজন পড়ে শোনালে রাজ্জাক শুনে শুনে মুখস্ত করে। একটি ল্যাপটপ থাকলে রাজ্জাককে অন্য জনের উপর নির্ভর করতে হতো না। ল্যাপটপ থেকে শুনে শুনে রাজ্জাক পড়া মুখস্ত করতে পারতো। একই কষ্ট বিশ্বনাথ রায় নামের অপর এক ছাত্রের। সেও অন্ধ। সেও রাজ্জাকের মতো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে পড়ে। তাকেও অন্যের মুখে শুনে শুনে পড়া মুখস্ত করতে হয়। তারও বড় অসুবিধা। একটি ল্যাপটপের অভাবে তারও পড়াশোনার অনেক কষ্ট। তাৎক্ষণিকভাবে সাবেক গভর্নর লায়ন কবির উদ্দীন ভুঁইয়া এবং লায়ন আদর্শ কুমার বড়ুয়া এই দুই ছাত্রকে দুইটি ল্যাপটপ কিনে দেয়ার ঘোষণা দেন। বৃত্তির টাকার বাইরে এই দুইটি ল্যাপটপ দুই ছাত্রের অধ্যয়নের বড় একটি অন্তরায় দূর করে দিল।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস তৃতীয় বর্ষে পড়ছে সারা জয়ীমা শওকত। মেধাবী এই ছাত্রীর বাড়ি চাঁদপুর। চমেক হাসপাতালের হলে থেকে লেখাপড়া করে। লায়ন্স স্কলারশিপের বৃত্তির টাকাটা তার বড় বেশি কাজে লাগে বলেও জানালো। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস ক্লাসে গতবছর ভর্তি হওয়া হাটহাজারীর মেয়ে সারজিনার বাবা মারা যাওয়ার পর চোখে মুখে অন্ধকার দেখছিল। লায়ন্স স্কলারশিপের টাকাটা তারও বড় বেশি কাজে লাগে। অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে সারজিনা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। কথা বলতে পারছিল না। আর একই সাথে বাকরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল পুরো হল। চট্টগ্রামে লায়নিজমে যুক্ত সিংহহৃদয় মানুষগুলো যেন নিজেদের উজাড় করে অসহায় মেধাবী ছাত্রছাত্রীগুলোর জন্য ভালোবাসা বিলাচ্ছিল। এক ছাত্রতো বলেই দিল, লায়ন সদস্যরা যেভাবে ভালোবাসা দেন, সেভাবে সবাই এগিয়ে আসলে তার এবং তার মতো অনেকের জীবনের গল্প পাল্টে যেতো। রিকশাওয়ালা, বাসের কন্ট্রাক্টর কিংবা দিনমজুর হওয়ার অবস্থা থেকে তারাও জীবন সাজানোর স্বপ্ন দেখতো।

লায়ন সদস্যরা গতকাল দুহাত উজাড় করে নিজেদের সামর্থের সবটুকু দিয়েছেন লায়ন্স স্কলারশিপ ট্রাস্ট্রের জন্য। এই ট্রাস্ট যাতে ভবিষ্যতে আরো অনেক অনেক বেশি অসহায় ছাত্রছাত্রীর পাশে দাঁড়াতে পারে সেজন্য নানাজন নানাভাবে সহায়তা করেছেন। দৈনিক আজাদী সম্পাদক সাবেক গভর্নর এবং স্কলারশিপ ট্রাস্টের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য লায়ন এম এ মালেক তিনজন ছাত্রের বৃত্তির পুরোটা নিজে নিয়ে নেন। সাবেক গভর্নর লায়ন শাহ এম হাসান নিজের নামে দুই লাখ, নিজের স্ত্রীর নামে দুই লাখ, ক্লাব থেকে এক লাখ এবং আগামী বছর থেকে আরো পাঁচজন ছাত্রকে নিজের পক্ষ থেকে বৃত্তি দেয়ার ঘোষণা দেন। সেকেন্ড ভাইস গভর্নর লায়ন ডাঃ সুকান্ত ভট্টাচার্য ট্রাস্টে দুই লাখ টাকা দেয়ার ঘোষণা দেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত বহু লায়ন সদস্য এক লাখ টাকা করে প্রদান করেন। ২০ হাজার টাকা করে এককালীন দিয়ে ট্রাস্টের আজীবন সদস্যও হয়েছেন অনেকেই। কেউ কেউ নাম প্রকাশ না করার শর্তেও টাকা দিয়েছেন।

লায়ন্স স্কলারশিপ ট্রাস্টের যাত্রা শুরু হয় ২০১৫-২০১৬ সালে। লায়ন্স ডিস্ট্রিক গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর মোস্তাক হোসাইন কল দেন ‘এডুকেশন ফর এক্সিলেন্স’। কিছুদিনের মধ্যে তিনি লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনালের ডিস্ট্রিক ৩১৫বি৪ এর একটি স্থায়ী প্রকল্প গ্রহণ করেন। লায়ন সদস্যদের কাছ থেকে সংগৃহিত ৪৩ লাখ টাকা ব্যাংকে এফডিআর করে রেখে তিনি লায়ন স্কলারশিপ ট্রাস্ট গঠন করেন। ব্যাংকে জমাকৃত এফডিআর-এর মুনাফা দিয়ে প্রতিবছর মেধাবী অথচ গরীব ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তির ব্যবস্থা করেন। লায়ন্স স্কলারশিপের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করছেন তিনি। ট্রাস্টের ট্রেজারার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন লায়ন জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠান লায়ন মোস্তাক হোসাইনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন লায়ন গভর্নর মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন চৌধুরী। অনুষ্ঠানে গেস্ট অব অনার ছিলেন আইপিডিজি লায়ন মনজুর আলম মনজু, ডিজি (ইলেক্ট) লায়ন কামরুন মালেক। ভাইস গভর্নর লায়ন ডাক্তার সুকান্ত ভট্টচার্য। বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের মধ্যে সাবেক গভর্নর লায়ন এম এ মালেক, সাবেক গভর্নর লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়া, আমেরিকা প্রবাসী খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. বদরুল ইসলাম বক্তব্য রাখেন।

বক্তারা বলেন, লায়নিজমের মূল মন্ত্রই হচ্ছে মানুষের সেবা করা। লায়ন্স স্কলারশিপের মাধ্যমে আমরা সেই সেবার কাজই করছি। আমরা দান করি না, সেবার হাত প্রসারিত করি। সমাজের অসহায় মানুষগুলোকে কিছুটা সহায়তা দিয়ে জীবনযুদ্ধে পাশে দাঁড়াচ্ছি। এই যাত্রা সাবলীল করতে ট্রাস্টের ফান্ড পাঁচ কোটি টাকায় উন্নীত করার উদ্যোগ নেয়ার জন্যও বক্তারা আহ্বান জানান।

লায়ন গভর্নর নাসিরউদ্দিন চৌধুরী বলেন, এটি অহংকার করার মতো একটি প্রজেক্ট। হাজার হাজার প্রজেক্টের দরকার নেই। এই ধরনের একটি প্রজেক্টই বহু বছর আলো ছড়াবে। তিনি এই ট্রাস্টকে আরো সমৃদ্ধ করতে এগিয়ে আসার জন্য জেলার লায়ন সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

ডিজি ইলেক্ট লায়ন কামরুন মালেক বলেন, আমাদের অবস্থান থেকে আমরা সর্বোচ্চটা করার চেষ্টা করছি। আমরা এই ধরনের একটি উদ্যোগ নিতে পেরে আনন্দিত। আমাদের মন ভরে যাচ্ছে। আমাদের অন্তরে অন্য ধরনের এক পবিত্রতা অনুভব করছি। এই ধরনের কর্মকাণ্ডে শুধু মানুষই নয়, বিধাতাও খুশী হন বলেও লায়ন কামরুন মালেক মন্তব্য করেন।

দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে দশজন গরীব ও মেধাবী ছাত্রকে দৈনিক আজাদীর পক্ষ থেকে বৃত্তি দেয়ার কথা স্মরণ করে বলেন, এখন থেকে এখানেও আজাদীর পক্ষ থেকে তিনটি বৃত্তি দেয়া হবে। ভবিষ্যতে আমরা এই সংখ্যা আরো বাড়ানোর চেষ্টা করবো। আমরা আমাদের সাহায্যের হাত ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য প্রসারিত করতে চাই। আমরা আমাদের সাথে সাথে তাদেরকেও এগিয়ে নিতে চাই। আমরা হাত বাড়াতে চাই সেসব হাতের দিকে, যাদের কারো একটি হাত দরকার। লায়ন্স স্কলারশিপ ট্রাস্টের ভূয়শী প্রশংসা করে তিনি বলেন, আমাদের এখান থেকে বৃত্তি পাওয়া ছাত্রছাত্রীরাই আমাদের লায়নিজমের এম্বেসেডর হিসেবে একটি পতাকা উড়াবে। আমরা সেদিন তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলবো। ট্রাস্টের ফান্ড আরো বাড়ানোর উদ্যোগে নিজের সবটুকু দিয়ে সচেষ্ট থাকবেন বলেও এম এ মালেক উল্লেখ করেন।

লায়ন মোস্তাক হোসাইন বলেন, লায়ন্স স্কলারশিপ ট্রাস্টের মাধ্যমে আমরা ছোট্ট একটি বাতি জ্বালাতে চেয়েছি। যেই বাতি অন্ধকার দূর করবে। এই একটি বাতি থেকে একদিন হাজার বাতি জ্বলবে। পুরো দেশ আলোকিত হবে। তিনি লায়ন্স স্কলারশিপ ট্রাস্টের ফান্ড বাড়ানোর উপর গুরুত্বারোপ করে লায়ন সদস্যদের সামর্থ অনুযায়ী এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

লায়ন্স স্কলারশিপ ট্রাস্টের ট্রেজারার লায়ন জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সাবেক গভর্নর লায়ন নাজমুল হক চৌধুরী, লায়ন শাহ এম হাসান, লায়ন সিরাজুল হক আনসারি, কেবিনেট সেক্রেটারি লায়ন জাহেদুল ইসলাম চৌধুরীসহ শীর্ষ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।