"বর্তমান গণমাধ্যম একটি অপেশাদার ও মুনাফানির্ভর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান"
আমাদের বর্তমান গণমাধ্যম দিনদিন অপেশাদার ও রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির ফাঁদে পড়ে স্রেফ মুনাফানির্ভর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে। গণমাধ্যমের বর্তমান চরিত্র বোঝাতে উপরোক্ত বাক্যে ব্যবহৃত তিনটা শব্দ আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। সেগুলো হলো-
১. অপেশাদার মনোভাব
২. রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি
৩. মুনাফানির্ভর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান
আমি নিজে দীর্ঘমেয়াদি পেশাদার সাংবাদিক না হলেও একাডেমিক পরিসরের পাশাপাশি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং গণমাধ্যমের আইটেম/কনটেন্ট পর্যবেক্ষণ থেকেই আমি উপরের বাক্যটা ব্যবহারের আস্ফালন দেখিয়েছি।
আমাদের বর্তমান সংবাদপত্রের পাতার ভিতরে-বাইরে বিজ্ঞাপনের ফাঁকে খবর খুঁজে নিতে হয়। বিজ্ঞাপনের লোভে সংবাদপত্রের ন্যূনতম পেশাদারিত্ব ও মূল্যবোধটুকু এখন গায়েব। সেখানেও আবার রাজনীতি ও অপরাধ ছাড়া কোন সংবাদই চোখে পড়ে না। সংবাদপত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রথম ও শেষ পৃষ্ঠা উল্টালে মনে হয় সংবাদের উপাদান যেন শুধুই এই দুইটা। আর ভেতরের পাতাজুড়ে কেবল কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের পজেটিভ সংবাদ এবং প্রেস রিলিজ আর প্রেস রিলিজ। মজার বিষয় হচ্ছে- সংবাদের বড় এই দুই অংশ মূলত রাজনৈতিক নেতার সভা-সমাবেশের বক্তব্য নির্ভর রাজনৈতিক প্রতিবেদন ও পুলিশি ভাষ্য নির্ভর অপরাধ প্রতিবেদন। আরেকটু খোলাসা করে বললে- তারা যাই বলেন সেটাই নিউজ। অনেকটা বক্তব্যধর্মী সব নিউজ। অর্থাৎ অমুক বলেছেন, তমুক বলেছেন টাইপের। একটা নিউজ পড়লেই বোঝা যায় সেখানে রিপোর্টারের শ্রম কতটুকু। অমুক-তুমুকের বক্তব্যের ভিড়ে রিপোর্টারের নিজস্বতাই খুঁজে পাওয়াও দুরূহ। তাই রিপোর্টারের ব্যক্তিগত দায়ও কম না। কিন্তু বস/মালিকের বিপরীতে গিয়ে খুব কর্মীই কাজ করতে পারেন। যেটা সবধরণের চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
তবে এখানে বড় প্রতিবন্ধকতা মিডিয়া মালিকদের ব্যবসায়ী মনোভাব ও বিজ্ঞাপনওয়ালাদের ছড়ি ঘুরানো খড়গ। মালিকের সাথে অমুক নেতার খাতির, তমুক মালিকের আত্মীয়, সমুক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্রতি সপ্তাহে লাখ-লাখ টাকার বিজ্ঞাপন দেয়। তাই এই নিউজ করা যাবে না, ওদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দিকে রিপোর্টারদের ফিরেও তাকানো যাবে না উপরন্তু তাদের পাঠানো প্রচারণামূলক প্রেস রিলিজ ছাপানো যাতে মিস না হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। কেননা বিজ্ঞাপন দিলেই সংবাদপত্র ব্যবসা টিকে থাকবে, রিপোর্টারদের বেতন চলবে। আর ব্যবসা ভালো করার জন্য পেশাদারিত্ব-দায়বদ্ধতার কোন বালাই নেই। আবার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য রাজনৈতিক নেতাদের ম্যানেজ করতে হয়। ইদানিংকালে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের তুষ্ট করার প্রবণতাও চালু হয়েছে। আর অপেশাদারিত্ব বলতে গণমাধ্যমের দায়িত্ব যা হওয়া উচিত তা থেকে নিবৃত থাকা। এতসবের পরেও মুক্ত সাংবাদিকতা আমাদের দেশে সার্কাস মনে হয়। আমাদের গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো ভুলেই গেছে তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য কী? সাংবাদিকতা এখন কেবলই প্রচারমাধ্যম। তবুও গণমাধ্যমই মানুষের প্রত্যাশা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার শেষ আশ্রয়স্থল।
লেখক : জনসংযোগ কর্মকর্তা, চুয়েট।
Developed By Muktodhara Technology Limited