image

বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে বিএনপি

image

নানা কারণে আগে থেকেই বিএনপির উপর দলটির নেতৃত্বাধীন বিশদলীয় জোটের শরিক দলগুলোর তীব্র ক্ষোভ ছিল। ইতোমধ্যেই সেই ক্ষোভকে কেন্দ্র করেই জোটের দীর্ঘদিনের সঙ্গী বিশেষ করে জিয়া পরিবারের বিশ্বস্ত কয়েকটি দল জোট থেকে বের হয়ে গেছে। সর্বশেষ বের হল আন্দালিব রহমান পার্থর বিজেপি। 

অবস্থাদৃষ্টে দেখা যাচ্ছে, বিএনপির ভুল রাজনীতি বা নেতাদের মিথ্যা অহংবোধ এবং সঠিক সমন্বয়ের অভাবে ধীরে ধীরে জোট শরিকরা বিশদল থেকে বেরিয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে খুব বেশি দেরি নেই, যখন দেশের বর্তমান রাজনৈতিক মাঠে সবচেয়ে বেশি বিপর্যয়ে পড়া বিএনপি সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়বে।

জোট সূত্রে জানা যায়, অতীতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট থেকে ৬টি রাজনৈতিক দল বেরিয়ে যায়। সর্ব প্রথম ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের পর বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিশদলীয় জোট ছাড়ে ন্যাপ ভাসানী। এরপর শেখ শওকত হোসেন নিলুর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল পিপলস্ পার্টি-এনপিপি জোট ত্যাগ করে। এরপর ২০১৬ সালের ৭ জানুয়ারি মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী, মুফতী ফয়জুল্লাহ, আবুল হাসনাত আমিনীর নেতৃত্বাধীন ইসলামী ঐক্যজোট কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করে। ২০১৮ সালের ১৬ অক্টোবর জেবেল রহমান গানি ও গোলাম মোস্তফা ভুইয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ জোট ত্যাগ করে। একই দিন খোন্দকার গোলাম মোর্ত্তজার নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এনডিপি জোট থেকে বের হয়। 

সর্বশেষ সোমবার রাতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিশদলীয় জোট ছেড়ে বেরিয়ে যায় ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থর নেতৃত্বাধীন বিজেপি।

সূত্র জানায়, বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিশদলীয় জোট থেকে একের পর এক রাজনৈতিক দল বেরিয়ে গেলেও জোটের সংখ্যাতাত্ত্বিক পরিধির কখনও কমতি হয়নি! যত দলই জোট ছেড়ে যাক সংখ্যার দিক দিয়ে বিশ দল সব সময়ই বিশ দলই থেকেছে! যা বিএনপি নামের বৃহৎ রাজনৈতিক দলটির নেতৃত্বকে সাধারণের কাছে হাসির পাত্রে পরিণত করেছে। কিন্তু দলের নেতাদের এতে কখনও বোধোদয় হয়নি।

জানা যায়, ২০১৪ সালে তৎকালীন সরকারের একতরফা নির্বাচনের পর প্রথম জোট ছাড়ে ন্যাপ ভাসানী। সেই শূন্যস্থান পূরণ করা হয় গাইবান্ধা জেলা কল্যাণ পার্টি সহ-সভাপতি এ্যাডভোকেট আজহারুল ইসলাম চৌধুরীকে দিয়ে। তাকে সভাপতি করে বিএনপি ওইদিনই আরেকটি ন্যাপ ভাসানী তৈরি করে বিশ দলের সংখ্যা ও পরিধি ঠিক রাখে। এরপর শেখ শওকত হোসেন নিলুর নেতৃত্বে ন্যাশনাল পিপলস্ পার্টি-এনপিপি জোট ত্যাগ করলে তার বহিষ্কৃত মহাসচিব এ্যাডভোকেট ফরিদুজ্জামান ফরহাদকে দিয়ে নতুন এনপিপি বানানো হয়। সেপ্টেম্বর মাসে এনপিডিপির সেক্রেটারি আলমগীর মজুমদার ও ইসলামিক পার্টির সেক্রেটারি এমএ রশিদ প্রধানের নেতৃত্বে দল দু’টির একটি করে অংশ জোট থেকে বেরিয়ে যায়।

২০১৬ সালের ৭ জানুয়ারি মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী, মুফতী ফয়জুল্লাহ, আবুল হাসনাত আমিনীর নেতৃত্বাধীন ইসলামী ঐক্যজোট কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করলে সেখানেও বিএনপির পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি হয় নতুন ‘ইসলামী ঐক্যাজোট’। যার নেতৃত্ব দেয়া হয় ইসলামী ঐক্যজোটেরই মাঝারি পর্যায়ের নেতা মাওলানা আবদুর রকিবকে। 

২০১৮ সালের ১৬ অক্টোবর জেবেল রহমান গানি ও গোলাম মোস্তফা ভুইয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ বিশ দলীয় জোট ত্যাগ করে। ন্যাপ জোট ছাড়ার ঘোষণা দেয়ার রাতেই নতুন আরেক ‘বাংলাদেশ ন্যাপ’ তৈরি করে বিএনপি নেতারা। বিএনপির কারখানায় তৈরি ন্যাপের কেন্দ্রীয় সভাপতি করা হয় আগের ন্যাপের ঢাকা মহানগর কমিটির এক সম্পাদক পদের জনৈক শাওন সাদেকীকে। যার আজ পর্যন্ত কোন মহাসচিব নেই বলে জানা যায়। জেবেল গাণি বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের অন্যতম সহযোগী মশিউর রহমান যাদু মিয়ার নাতি। সে হিসেবে তিনি জিয়া পরিবারের খুব বিশ্বস্ত হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

খোন্দকার গোলাম মোর্ত্তজার নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এনডিপি জোট থেকে বের হয়, যেদিন ন্যাপ বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিশদল ছাড়ার ঘোষণা দেয়; সেদিন। সেখানেও এনডিপির বহিষ্কৃত এক নেতা ক্বারী আবু তাহেরকে দিয়ে নতুন এক এনডিপি তৈরি করে বিএনপি নেতারা। 

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ন্যাপের মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভুইয়া দৈনিক জাগরণকে বলেন, ‘রাতারাতি দল তৈরি করার অপসংস্কৃতি তৈরি করেছে বিএনপি। এটার মাধ্যমে তারা বুঝাতে চায় আসলে জোট ভাঙ্গেনি। কিন্তু তারা ভুলে যায় এই অপরাজনীতি একদিন তাদের জন্যও বুমেরাং হতে পারে। এই সকল অপরাজনীতির কারণে বিএনপি ক্রমান্বয়ে বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে।’ 

বিএনপি জোটের রাজনীতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিএনপি কখনোই তার শরিকদের ক্ষেত্রে বিশ্বস্ততার পরিচয় দিতে পারেনি। এরশাদ বিরোধী ৭ দলের নেতৃত্বে বিএনপি থাকলেও সেদিন বিএনপি তার সহযোগীদের যথাযথ সম্মান করতে পারে নাই। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রথমে গঠিত ৭ দলের নেতাদের সাথেও বিএনপি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। সে দিনও তারা নতুন জোট সঙ্গী পেয়ে ভাষা সৈনিক অলি আহাদ, শফিউল আলম প্রধান, শেখ শওকত হোসেন নিলুদের ফেলে দিয়েছিল রাস্তায়। পরবর্তীতে ৪ দলীয় জোট গঠন করে নির্বাচন করলেও সরকার গঠন করে দু’দলের সমন্বয়ে। আর সেই সময়টাতেই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিস চৌধুরীর নিয়ন্ত্রণে ৪ দলীয় জোটের শরিক ইসলামী ঐক্যজোট ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টিকে খন্ড-বিখণ্ড করা হয়। পরবর্তীতে ২০০৮ সালের পর ১৮ দল ও ২০ দল গঠন করে দীর্ঘদিন শরিকরা সকল ত্যাগ স্বীকার করলেও তাদের ভুলে নতুন বন্ধুদের নিয়ে মাতোয়ারা হয়ে পড়ে বিএনপি। 

ন্যাপ মহাসচিব গোলাম মোস্তফা আরও বলেন, ‘যারা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে খুনি মনে করে ও বিশ্বাস করে, যারা ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার জন্য বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দায়ী করেছে এবং করে, যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার উপদেষ্টা থাকাকালীন সময়ে বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যে মামলা করেছে যার ফলশ্রুতিতে তিনি আজ জেল খাটছেন সেই ড. কামাল গংদের পেয়ে বিএনপি তার পুরোনো মিত্রদের অবহেলা করা শুরু করে। তার প্রতিবাদে ২০১৮ সালের ১৬ অক্টোবর বাংলাদেশ ন্যাপ জোট ত্যাগ করেছিল। ৬ মে বিজেপি সেই একই যুক্তিতে জোট ত্যাগ করে প্রমাণ করলো বিএনপি কারও বিশ্বস্ত বন্ধু নয়। তারা নিজেরদের সুযোগ ও সুবিধার জন্য তাদের পরীক্ষিত বন্ধুদেরও ফেলে দিতেও কুন্ঠিত হয় না’।

ন্যাপ মহাসচিব আরও বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনেও বিএনপি ২০ দলের শরিকদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। ত্যাগী নেতা মরহুম শফিউল আলম প্রধানের কন্যাকে মনোনয়ন তো দেয়ই নাই বরং বিএনপির এক শীর্ষনেতার পিএসকে মনোনয়ন দিয়ে ১৮ দল পরবর্তীতে ২০ দল গঠনের অন্যতম নায়ক শফিউল আলম প্রধানের অবদানকে পদদলিত করেছে। তার কন্যাকে ওই নীতিনির্ধারক শীর্ষনেতা সান্ত্বনা তো দেনই নাই বরং সবার সামনে অপমানও করেন।

এই সকল ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়, বিএনপির সাথে কোন ত্যাগী রাজনৈতিক কর্মীর সম্পর্ক থাকতে পারে না। এই চরিত্র বিএনপির জন্য আরও বেশি কঠিন সময় নিয়ে আসছে। মনে মনে সান্ত্বনা পাবার জন্য বিএনপি হয়তো বলবে সমুদ্র থেকে এক ফোঁটা জল গেলে কোন ক্ষতি হয় না কিংবা তৃতীয়-চতুর্থ সারির কোন কর্মীকে দিয়ে দল বানিয়ে বলবে ২০ দল অটুট আছে। কিন্তু এটি প্রমাণিত যে বিএনপি যেমন তার বন্ধুদের আস্থা হারিয়েছে ঠিক তেমনই জনগণের মধ্যেও বিএনপি উপর আস্থা হ্রাস পাচ্ছে।

ভুইয়া বলেন, ‘সমুদ্রের কয়েক কলস জল’, ‘বটগাছের কয়েকটি পাতা’ বলে ঠাট্টা করার মধ্যে কোন দলের শক্তিমত্তা বা রাজনৈতিক চরিত্র নয় বরং এই সকল আচরণে বিএনপির দেউলিয়ত্বই প্রকাশ পায়। তাদের মনে রাখা উচিত পশ্চাৎদেশ দিয়ে যতই পাহাড় ঠেলুন, পাহাড় কিন্তু নড়বে না।’

এদিকে, সর্বশেষ গতকাল সোমবার রাতে বিএনপি জোট ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছে জিয়া পরিবারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ। একাদশ নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যানের পরও সংসদে যোগ দেয়া ও পুরনো মিত্রদের অবমূল্যায়ন করে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন নতুন জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে বেশি মাতামাতির প্রতিবাদে পার্থ জোট ছাড়ার ঘোষণা দেন। বিজেপির জোট ছাড়ার পরদিন মঙ্গলবার বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ছাড়ার হুমকি দিয়েছেন আরেক শরিক বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান। 

ঐক্যফ্রন্ট ছাড়তে বিএনপিকে আলটিমেটাম দিয়ে ইরান বলেন, ২৩ মে’র মধ্যে ঐক্যফ্রন্ট না ছাড়লে ২৪শে মে লেবার পার্টি ২০ দলীয় জোটে থাকবে কিনা সে সিদ্ধান্ত জানাবে।

ইরান বলেন, আমরা বিএনপিকে ড. কামালের ঐক্যফ্রন্ট ছাড়ার জন্য এবং কারাবন্দি বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য কর্মসূচি দিতে আগামী ২৩শে মে পর্যন্ত আল্টিমেটাম দিচ্ছি। এর মধ্যে বিএনপি সিদ্ধান্ত না নিতে পারলে ২৪ তারিখে আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত নেব।

তিনি দৈনিক জাগরণকে জানান, শুধু লেবার পার্টি নয় আরও অন্তত ৪-৫টি দলের বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। 

২০ দলীয় জোট বিএনপির পরীক্ষিত জোট দাবি করে ইরান বলেন, পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের কারণে জোটকে বাইরে রেখে ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগের একটা এজেন্ডা হচ্ছে এই ঐক্যফ্রন্ট।

এদিকে, জানা যায়, বিএনপি জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামীও বিএনপিকে দীর্ঘদিন ধরে এড়িয়ে চলার কৌশল নিয়েছে। তারা প্রকাশ্যে জোট ছাড়ার ঘোষণা না দিলেও জোটের বিষয়ে আর কোনো আন্তরিকতা দেখাবে না বলে জামায়াত সূত্রে জানা গেছে।

সূত্র : দৈনিক জাগরণ