image

বিএনপির দুই জোটে ঘুন পোকা 

image


বিগত দশ বছর প্রায় ক্ষমতায় না থেকে একের পর এক রাজনৈতিক ধাক্কাই খাচ্ছে দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। ১৪ এর নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে সংসদ থেকে হারিয়ে যাওয়া এবং এরপর ১৮ এর নির্বাচনে ভোটে অংশ নিয়েও আশানুরূপ ফলাফল না পাওয়া দলটি সিদ্ধান্তের জায়গায় অনেকটাই ছন্ন ছাড়া হয়ে গেছে। দলের প্রধান বিএনপি চেয়ারপারসনের কারাগারে বন্দি থাকা এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের লন্ডনে অবস্থান করায় যেন মাথা ছাড়া বিএনপির ভরসার স্থান দুই জোট ঐক্যফ্রন্ট আর ২০ দল।


 
তবে দুই জোট নিয়েও একাদশ সংসদ নির্বাচনে তেমন সুবিধা করতে পারেনি দেশের বৃহৎ এই রাজনৈতিক দলটি। নির্বাচনে ভোট কারচুপি সহ নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি সহ দুই জোট ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দল। তবে অভিযোগ তুললেও এর বিরুদ্ধে জোড়ালো কোনো অবস্থানে যেতে পারেনি বিএনপি এবং তার নেতৃত্বাধীন দুই জোট। বরং ভোটে বিজয়ীরা শেষ পর্যন্ত সংসদে অংশ নিয়ে জোটের মধ্যেই একধরনের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছে।

বিএনপির প্রথম ধাক্কা আসে ২০১৪ এর নির্বাচনে। ওই সময় নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে ২০ দলীয় জোটে বড় ভাঙন ধরে। ওই সময় বিএনপির এই সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করে ২০ দলের শরিকরা। অনেকেই জোট থেকে বের হয়ে নির্বাচনে অংশ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। পরবর্তী ২০১৮ সালের নির্বাচনে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেই দলীয় প্রধান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখেই নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি।

তবে নির্বাচনে যেতে ২০ দলীয় জোট নিয়ে তেমন ভরসা না থাকায় ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দেয় বিএনপি। এই জোট নিয়েই নির্বাচনের আগে ব্যাপক কর্মসূচি করে দলটি। তবে ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে ২০ দলে নানা প্রশ্ন উঠে। যদিও শেষমেশ দুই জোটকে নিয়েই বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়।

দুই জোট বিএনপির প্রতীক ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। এত কিছুর পরেও তেমন সুবিধাই করতে পারেনি বিএনপির দুই জোট। বরং নির্বাচনে বড় পরাজয়ের পর ভাঙন ধরতে শুরু করেছে দুই জোটে।

নির্বাচন শুরু থেকে প্রত্যাখ্যান করে সংসদে অংশ গ্রহণ করবে না এমন সিদ্ধান্তেই ছিল বিএনপি সহ দুই জোট। তবে প্রথম দলীয় সিদ্ধান্ত ভঙ্গ করে ঐক্যফ্রন্টের শরিক গণফোরামের নির্বাচিত দুই প্রার্থী মোকাব্বির খান ও সুলতান মনসুরের শপথ গ্রহণ তীব্র সমালোচনার জন্ম দেয়। বিএনপি থেকে এর তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়। কিন্তু এরপর বিএনপির নির্বাচিতরাও শপথ গ্রহণ করেন। শপথ গ্রহণের সিদ্ধান্ত দেন লন্ডন থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

এ ঘটনায় জনমনে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। বিএনপির এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন নিয়ে সমালোচনার মধ্যে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, অতীতে সংসদে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। কিন্তু এখন যাওয়ার সিদ্ধান্তটা সঠিক হয়েছে। তারেক রহমান সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী তাদের জন্য বর্তমান পরিস্থিতিতে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে বিএনপি নিরাশ নয়।’

বিএনপি মহাসচিব বলেন, সংসদের ভেতরে ও বাইরে আন্দোলন করতে হবে। সস্তা স্লোগান দিলে হবে না। ঘরে-বাইরে দুই দিকেই সংগ্রাম করতে হবে। পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে রাজনীতির পরিবর্তন গ্রহণ করতে হবে বলেও জানান তিনি।

তবে বিএনপির এই সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি ২০ দলীয় জোট। জোটে থাকা একাধিক শরিক জোট ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতোমধ্যেই ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেও প্রধান শরীক বিএনপি সংসদে যোগদান করায় ২০ দলীয় জোট ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি)। একই সঙ্গে জোট ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জোটের আরেক শরিক বাংলাদেশ লেবার পার্টি।

এদিকে আন্দালিব রহমান পার্থ ২০ দল ছাড়ার বিষয়ে ৩টি কারণ দেখিয়েছে। তিনি বলেন, তিনটি কারণে এই সিদ্ধান্ত। অতিমাত্রায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টমুখী হয়ে গেছে (বিএনপি), ২০ দলীয় জোটের কর্মকাণ্ড শুধু সহমত, সংহতি ছাড়া তেমন কিছুই নয়; ‘প্রহসন ও ভোট ডাকাতির নির্বাচন’ এরপর সংসদে যাওয়াটা নৈতিকভাবে ঠিক হয়নি বলে মনে করি এবং সংসদে বিএনপি যে যাবে, এটা আমার দল শুধু নয়, জোটের কেউ জানে না। এসব কারণেই জোট ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত।

২০ দলীয় জোটের সাথে বিজেপির সম্পর্ক ছিন্নের পরদিনই জোট ছাড়ার হুমকি দিয়েছে আরেক শরিক দল লেবার পার্টি। মঙ্গলবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানে দলটির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, আমরা বিএনপিকে ড. কামালের ঐক্যফ্রন্ট ছাড়ার জন্য এবং কারাবন্দি বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য কর্মসূচি দিতে আগামী ২৩ মে পর্যন্ত আল্টিমেটাম দিচ্ছি। এর মধ্যে বিএনপি সিদ্ধান্ত না নিতে পারলে ২৪ তারিখে আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত নেব। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শুধু আমার দল নয়, আমি যদি ২০ দলীয় জোটে না থাকি তাহলে আরও অন্তত ৪-৫টি দল এই জোট থেকে বেরিয়ে যাবে।

বিএনপির সমালোচনা করে তিনি বলেন, বিএনপি নেতারা দল এবং জোট পরিচালনায় চরমভাবে ব্যর্থ, এটা পরিষ্কার। আমরা ২০ দলীয় জোটকে কার্যকর রাখতে চাই। ২০ দলীয় জোট আমাদের রক্তের ওপর দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই জোটের কারণে আমি পাঁচবার গ্রেফতার হয়েছি। যুবলীগের হামলার শিকার হয়েছি। লাখ লাখ নেতাকর্মী হামলা মামলা গুম খুন অপহরণের শিকার হয়েছে। ২০ দলীয় জোটই আন্দোলন-সংগ্রামের পরীক্ষিত জোট। পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের কারণে জোটকে বাইরে রাখা হয়েছে। আওয়ামী লীগের একটা এজেন্ডা হচ্ছে এই ঐক্যফ্রন্ট।

এদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে বিএনপিকে রাখা হবে কিনা এই নিয়ে নানা গুঞ্জন শুরু হয়েছে। ঐক্যফ্রন্ট শেষ পর্যন্ত টিকবে কিনা এই নিয়েও চলছে আলোচনা-সমালোচনা। ফ্রন্টের নেতা ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহদুর রহমান মান্না ঐক্যফ্রন্টের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, হঠাৎ করে বিএনপির ইউ টার্ন সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। দলটির এ সিদ্ধান্তে ঐক্যফ্রন্টে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। তবে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির লক্ষ্যে সমঝোতা হলে দলটির পক্ষ থেকে আমাদের তা খোলাখুলি বলুক, কী সমঝোতা হয়েছে।

ঐক্যফ্রন্টের আরেক শীর্ষনেতা গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরী বলেন, গত চার মাসে আমাদের রাজনীতি ছিল- শপথ নেব নাকি নেব না? গণফোরাম থেকে দলের দুই এমপিকে বলা হয়েছিল শপথ নিতে হলে সবাই একসঙ্গে নেব। কিন্তু তারা আগেই নিয়ে নেন। ফলে তাদের মধ্যে একজনকে দল থেকে বহিষ্কার ও আরেকজনকে শোকজ করা হয়। এখন বিএনপির নির্বাচিতরা শপথ নেয়ার মধ্য দিয়ে আমরা বিষয়টি অনেকটাই স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়েছি।

এসব আলোচনা সমালোচনার মাঝেই এবার নতুন করে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ঐক্যফ্রন্টের আরেক শরিক কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। তিনি জোট ছাড়ার হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে অনেক অসঙ্গতি রয়েছে। বলে জানিয়ে এসব অসঙ্গতি ও কিছু প্রশ্নের উত্তর আগামী এক মাসের মধ্যে সুরাহা না হলে ৮ জুন এই ঐক্যফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে যাব।

বিএনপি নেতৃত্বাধীন দুই জোটে এতসব মতবিরোধ সৃষ্টিতে দুই জোট নিয়ে বিএনপির চিন্তা ভাবনা কি এই বিষয়ে দলটির সিনিয়র এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে যে যার যার দল গোছানোই ঠিক হবে। জোট নিয়ে এত চিন্তাভাবনা করার কিছু নেই।

খবর : দৈনিক অধিকার