image

মিরসরাইয়ের বারইয়ারহাট রেলক্রসিং : গেইটম্যানের অবহেলায় ঘটছে দুর্ঘটনা, ঝরছে প্রাণ

image

গেইটম্যানের অবহেলার কারণে ঘটছে বারবার ট্রেন দুর্ঘটনা, ঝরছে প্রাণও। বারইয়ারহাট রেলক্রসিংয়ে দীর্ঘ সময় ধরে এই মৃত্যুর মিছিল চললেও মিলছে না তার কোন সমাধান। বিগত বছরগুলোতে দুর্ঘটনার হার ছিল বেশ উদ্বেগজনক। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনের বারইয়ারহাট পৌরসভা এলাকার রেলক্রসিং যেন দিনদিন মরণ ফাঁদে পরিণত হচ্ছে। একেরপর এক দুর্ঘটনা ঘটলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে অনেকটাই দায়সারা ভাব। রেলক্রসিংয়ে রেললাইন ঘেঁষে কাঁচা তরকারি ও অস্থায়ী বাজার বসার কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে এই অংশে। কাঁচা বাজার বসানোর নেপথ্যে রয়েছে রেলক্রসিংয়ের গেইটম্যানরা, তারা জনপ্রতি ব্যবসায়ী থেকে ২০ টাকা করে প্রতিদিন নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

রেল ক্রসিংয়ে দায়িত্বরত গেইটম্যানদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে ২০১৬ সালের ৩১ জুলাই বাস-ট্রেন সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ওইদিন ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা যাত্রীবাহী বাস রিফাত পরিবহন (ঢাকা মেট্টো ১৪-২০৬৫) ভোর সাড়ে ৪ টার সময় রেল ক্রসিং অতিক্রম করাকালে চট্টগ্রামগামী ট্রেনের সাথে সংঘর্ষ হয়। এতে কোন বাসযাত্রীর প্রাণনহানী না হলেও আহত হয় ২৫ যাত্রী, দুমড়ে মুচড়ে যায় বাসটি। গেইটম্যান ঘুমিয়ে থাকায় এবং গেইট না ফেলার কারণে যাত্রীবাহী বাসটি রেললাইনের উপর উঠে পড়ে। এভাবেই একেরপর এক দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে বারইয়ারহাট রেল ক্রসিংয়ে।

এদিকে ২০১৬ সালের ২৪ জুলাই বিকেল ৫ টার সময় দায়িত্বরত গেইটম্যান ওই সময় কর্মস্থলে উপস্থিত না থাকায় চট্টগ্রামগামী ট্রেন সোনার বাংলা বারইয়ারহাট রেল ক্রসিংয়ের খুব কাছাকাছি চলে এলেও রেলক্রসিং পারাপার হতে গিয়ে খাগড়াছড়িগামী একটি পিকআপ ও বিপরীত দিক আসা অপর একটি সিএনজিঅটোরিক্সা লাইনের মাঝ বরাবর মুখোমুখি অবস্থায় আটকা পড়ে যায়। একই সময় দ্রুতগামী আন্তনগর ট্রেনটি ক্রসিং থেকে মাত্র ২ থেকে ৩’শ গজ দূরে চলন্ত অবস্থায় ছিলো। পরে চালক লাইনের উপর একাধিক যানবাহনের উপস্থিতি লক্ষ্য করে চলন্ত ট্রেনটি বন্ধ করার চেষ্টা চালায়। অবশেষে ঘটনাস্থল থেকে মাত্র ২০ গজ দূরত্বে (বালিকা বিদ্যালয়ের মুখে) ট্রেনটি বন্ধ হলে দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পায় ট্রেন ও ক্রসিংয়ে আটকা পড়া যানবাহন। স্থানীয়দের সহযোগিতায় যানবাহনগুলো সরিয়ে নেয়া হলে প্রায় ২৫ মিনিটপর গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় ট্রেনটি।

সর্বশেষ রবিবার (২ সেপ্টেম্বর) ভোর সাড়ে ৩ টার সময় গেইটম্যান ঘুমিয়ে থাকায় গেইট না ফেলার কারণে রেললাইনে যাত্রীবাহী এসআলম পরিবহনের একটি বাস উঠে পড়লে ময়মনসিংহ থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা বিজয় এক্সপ্রেস ট্রেন বাসটি ঠেলে প্রায় ৫’শ মিটার দূরে নিয়ে ফেলে। এতে করে ২ বাসযাত্রী নিহত ও ২২ বাসযাত্রী গুরুতর আহত হয়।

২০১৪ সালের ২২ মার্চ (শনিবার) দুপুরে বারইয়ারহাট রেলগেইট এলাকায় চট্টগ্রামগামী একটি ট্রেনের ধাক্কায় নিহত হয় কালা মিয়া (৬০)। সে উপজেলার ২ নম্বর হিঙ্গুলী ইউনিয়নের ইসলামপুর গ্রামের বাসিন্দা। ২০১৫ সালের ৭ মার্চ (শনিবার) সকাল সাড়ে ৮ টায় বারইয়ারহাট রেলগেইট এলাকায় সকালে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকামুখী প্রভাতী এক্সপ্রেস ট্রেনে কাটা পড়ে নিহত হয় মোস্তফা (২৫)। তিনি উপজেলার ২ নম্বর হিঙ্গুলী ইউনিয়নের চিনকিরহাটের আবুল কালামের পুত্র। ২০১৫ সালের ২১ অক্টোবর (বুধবার) বেলা ১১ টার সময় বারইয়ারহাট রেললাইনে অবৈধভাবে বসা কাঁচা বাজার থেকে বাজার করার সময় ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী একটি ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে লাতু মিয়া (৬০) নিহত হয়। এসময় শরীর থেকে তার পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। লাতু মিয়ার বাড়ি ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলার শুভপুর জয়পুর এলাকায়। ২০১৬ সালের ৫ জুলাই বারইয়ারহাট রেলক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় এক বৃদ্ধ নিহত হয়। তার নাম, পরিচয় জানা যায়নি। ২০১৭ সালের ৯ জুন (শুক্রবার) সকালে বারইয়ারহাট রেলগেইট এলাকায় রেললাইন পার হওয়ার সময় হঠাৎ ট্রেন চলে আসায় এসময় অপর দিকে রেললাইনের গাঁ ঘেঁষে অবৈধ কাঁচা বাজার থাকায় তিনি দ্রুত সরে যেতে না পারায় ট্রেনে কাটা পড়ে ঘটনাস্থলে নিহত হয় বশির আহম্মদ (৬০)। সে উপজেলার ২ নম্বর হিঙ্গুলী ইউনিয়নের মেহেদীনগর গ্রামের বাসিন্দা। ২০১৭ সালের ১৫ আগষ্ট (মঙ্গলবার) সন্ধ্যা ৭ টায় বারইয়ারহাট রেলগেইট এলাকায় বারইয়ারহাট-রামগড় রোড়ের সিএনজিঅটোরিক্সা চালক মহসীন ঢাকাগামী একটি ট্রেনের ধাক্কায় নিহত হয়। সে রামগড় উপজেলার লামকুপাড়ার আবুল কাশেম মোল্লার পুত্র। ২০১৭ সালের ১৪ অক্টোবর (শনিবার) সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টার সময় ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনের চিনকি আস্তানা রেল স্টেশনের উত্তরে বারইয়ারহাট রেল ক্রসিং এলাকায় সন্ধ্যার সময় আবদুস সালাম (৭০) নামের এক বৃদ্ধ ট্রেনে কাটা পড়ে নিহত হয়। এসময় ঢাকাগামী একটি ট্রেন আসলেও তিনি সরতে না পারায় মুহুর্তের মধ্যে কাটা পড়ে তিনি মারা যান। নিহত আবদুস সালাম ময়মনসিংহ জেলার কাতালের চর এলাকার বাসিন্দা। তিনি চিনকিআস্তানা স্টেশন এলাকায় পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকতেন। সেখানে তিনি কৃষি কাজ করতেন। ২০১৭ সালের ৩১ অক্টোবর বিকাল ৪ টার সময় বারইয়ারহাট রেলক্রসিংয়ে ঢাকাগামী গোধূলী এক্সপ্রেস ট্রেনের ধাক্কায় ছাথোয়াই অং মারমা (৬০) নামে এক পুলিশ সদস্য নিহত হয়। ২০১৮ সালের ১২ জুলাই (বৃহস্পতিবার) দুপুর ১২ টা ২০ মিনিটের সময় রেল ক্রসিংয়ের উত্তর পাশে রেল লাইন পার হতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে এক মহিলা নিহত হয়। নিহত মহিলার নাম রেহানা আক্তার (৩৫)। সে করেরহাট ইউনিয়নের নলখোঁ গ্রামের জুনাব আলীর স্ত্রী।

সরেজমিনে দেখা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনের বারইয়ারহাটে রেলক্রসিং সবচেয়ে ঝুঁঁকিপূর্ণ এলাকা। রেললাইন ঘেঁষে প্রতিদিন বসছে কাঁচাবাজার। বাজারে প্রচুর লোকসমাগম ঘটে। ট্রেনের হুইসেল শুনে তাড়াহুড়া করে লাইনের ওপর থেকে বাজারের মালামাল সরিয়ে নেওয়া হলেও ট্রেন চলে যাওয়ার পর আবারও বিক্রেতারা সেখানে বসে যায় পসরা নিয়ে। নানারকম দেশীয় শাকসবজি এবং তরিতরকারির পসরা সাজিয়ে বসেন বিক্রেতারা। রেললাইনের বারইয়ারহাট এলাকায় কোয়ার্টার কিলোমিটার পর্যন্ত গড়ে উঠেছে এই কাঁচাবাজার। সকাল থেকে শুরু হয়ে গভীর রাত পর্যন্ত মালামাল বিক্রি করা হয়ে থাকে। কেউ কেউ পণ্যের পসরা নিয়ে রেললাইনের ওপর যে যার মত বসে পড়ে মালামাল বিক্রি করে থাকে। মালামাল কিনতে আসা লোকজন কেনাকাটায় ব্যস্ত থাকার কারণে ট্রেনের আগমন টের না পাওয়ায় দুর্ঘটনার শিকার হয়ে থাকে। হঠাৎ ট্রেন আসলে এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করে মানুষ। অসাবধানতার কারণে চলমান ট্রেনের নিচে পড়ে হাত পা কাটা পড়ে অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করছে আবার কখনো মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে অকাল মৃত্যুও হচ্ছে।

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, বারইয়ারহাট রেলক্রসিংয়ে দায়িত্বরত গেইটম্যানের অবহেলার কারনে কিছুদিন পর পরই ঘটে দুর্ঘটনা। এটি নতুন নয়, প্রায়ই ট্রেন কাছে চলে এলেও গেইটটি খোলা রাখা নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ক্রসিংয়ে রেল দুর্ঘটনা ও কাটা পড়ে ইতোমধ্যে অসংখ্য ব্যক্তি হতাহতের ঘটনা ঘটলে অজ্ঞাত কারনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিরব ভূমিকা পালন করছেন বলেও অভিযোগ করেন তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বারইয়ারহাট রেলক্রসিংয়ে ছাবের আহম্মদ, মোশাররফ হোসেন, আরিফ হোসেন নামের তিন গেইটম্যান পালা করে দায়িত্ব পালন করেন। তারা রেললাইনের পাশ ঘেঁষে বসা অবৈধ ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলো থেকে প্রতিদিন ২০ টাকা করে নেয়।

এ ব্যাপারে বারইয়ারহাট রেল ক্রসিংয়ের দায়িত্বে থাকা গেইটম্যান ছাবের আহম্মদ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টোল (টাকা) নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, আমি কেনো টাকা নেবো, এগুলো মিথ্যে কথা।