image

অনিশ্চয়তার পথে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন

image

২০ জুন বিশ্ব শরণার্থী দিবস। বিশ্বের সর্ববৃহৎ শরণার্থী ক্যাম্প এখন বাংলাদেশে। মিয়ানমারের সেনা নির্যাতন ও গণহত্যা থেকে বাঁচতে গত বছরের ২৫ আগস্ট থেকে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এছাড়া এর আগে থেকেই আরো প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে রয়েছে। বর্তমানে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে নিয়ে বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার নিশ্চয়তা নিয়ে তারা আদৌ নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারবে কি না তা নিয়েও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রোহিঙ্গারা। একই সাথে ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার অবস্থানের কারণে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যেও নানা অসন্তোষ ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। রোহিঙ্গাদের সাথে স্থানীয়দের দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতেরও আশঙ্কা করছেন অনেকেই।

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩০টি ক্যাম্পে বর্তমানে রয়েছে ১১ লাখ ১৮ হাজার রোহিঙ্গা। মিয়ানমারের সাথে চুক্তি অনুযায়ী গত বছরের ১৫ অক্টোবর দুই শতাধিক রোহিঙ্গাকে স্বদেশে ফেরৎ পাঠানোর দিনক্ষণ ঠিক করা হলেও ওই দিন রোহিঙ্গাদের অনিচ্ছায় তাদের স্বদেশে পাঠানো যায়নি। আবার কখন প্রত্যাবাসন শুরু করা হবে তার দিনক্ষণও ঠিক হয়নি এখনো। জাতিসঙ্ঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দাবি করে আসছে যে, মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পরিবেশ এখনো সৃষ্টি হয়নি। জাতিসঙ্ঘের সাথে মিয়ানমারের চুক্তির পরও নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিয়ে শঙ্কিত রোহিঙ্গারা। তাদের প্রধান দাবি রোহিঙ্গা হিসেবে তাদের জাতিগত স্বীকৃতি, নাগরিকত্ব প্রদান, নিজ ভিটে মাটি ফেরৎ দেয়ার পাশাপাশি নিজ দেশে স্বাধীনভাবে চলাচলের সুযোগ দিতে হবে।

রোহিঙ্গা শিবিরে দিন দিন বাড়ছে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। এসব অপরাধে জড়িত রয়েছে ক্যাম্পের একটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ, যাদের কাছে রোহিঙ্গা থেকে শুরু করে স্থানীয়রা পর্যন্ত জিম্মি। বিশেষ করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ক্রমেই বাড়ছে, যা নিয়ন্ত্রণ করতে ক্যাম্প প্রশাসনকে হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

সম্প্রতি আবু তাহের নামে এক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে পুলিশ গ্রেফতার করে থানায় আনার সময় একদল রোহিঙ্গা তাকে ছিনিয়ে নিতে হামলা চালায় পুলিশের ওপর। এ সময় পুলিশ আত্মরক্ষার্থে ফাঁকা গুলি বর্ষণ করতে বাধ্য হয়। এ ধরনের ঘটনা প্রশাসন ও স্থানীয়দের ভাবিয়ে তুলেছে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, ক্যাম্পে কিছু পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হলেও বেশির ভাগ রোহিঙ্গা এলাকা ক্যাম্প পুলিশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়ে গেছে। চার দিক খোলা থাকায় নির্বিঘ্নে ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গারা পালিয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গারা অবাধে অপরাধ করে বেড়াচ্ছে। গহিন অরণ্যে গড়ে তুলেছে তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের ঘাঁটি। মাদক ও অস্ত্র পাচারের মতো কাজে তারা জড়িত। যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরের বাইরে হওয়ায় তা নিয়ন্ত্রণ করা অনেক সময় সম্ভবই হয় না।

সূত্রে আরো জানা গেছে, রোহিঙ্গারা জেলে সেজে প্রতিদিন উখিয়ার বালুখালী, ঘুমধুম, ধামনখালী, আঞ্জুমানপাড়া সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমারে প্রবেশ করে থাকে। তারা রাতে বিপুল পরিমাণ ইয়াবার চালান নিয়ে ক্যাম্পে ঢুকে পড়ে। কারণ দিনে ৫টার পর থেকে ক্যাম্পে কোনো অপরিচিতি, বহিরাগত লোকজনের প্রবেশ নিষেধ। তাই রাতে ক্যাম্প থাকে ওই সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে।

স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বর্তমানে যে অবস্থায় রোহিঙ্গাদের রাখা হয়েছে, তাতে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তাদের মধ্যে হানাহানি, সংঘর্ষ, খুন, গুম বেড়েই চলছে। রোহিঙ্গারা খুবই বেপরোয়া ও হিংস্র। বড় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটানোর আশঙ্কা রয়েছে বলে স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে। দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা বেষ্টনীতে নির্ধারিত জায়গায় রাখা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কে কী বললো সেদিকেও নজর দেয়ার প্রয়োজন নেই বলে স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

অভিযোগ রয়েছে, এক শ্রেণীর এনজিও রোহিঙ্গাদের এ এলাকায় থাকার জন্য নানাভাবে প্রভাবিত করে আসছে। এসব এনজিওর কারণে রোহিঙ্গারা সন্ত্রাসের মতো ভয়ঙ্কর কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছে। আর এসব কাজে অর্থ জোগান দিচ্ছে ওই এনজিওগুলো। ভাসানচরের মতো স্থানে রোহিঙ্গাদের রাখার প্রস্তুতি নেয়া হলেও এনজিওগুলোর কারণে তাদের সেখানে স্থানান্তর করা সম্ভব হচ্ছে না। এসব এনজিও আন্তর্জাতিক মহলে রোহিঙ্গাদের নিয়ে মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে। রোহিঙ্গাদের সাহায্য-সহযোগিতার নামে এরা কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে আসছে। আর এনজিও কর্মকর্তারা সমুদ্রসৈকতে বিলাসবহুল জীবন-যাপন করছেন।

উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ মো: আবুল খায়ের বলেন, রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণের জন্য ইতোমধ্যে উখিয়ার রোহিঙ্গা শিবিরে পাঁচটি পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। এসব ক্যাম্পে তিন শতাধিক পুলিশ সদস্য নিয়োজিত আছেন। এরপরও রোহিঙ্গারা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটাতে দ্বিধা করে না। তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে প্রশাসনকে হিমশিম খেতে হয়।

উখিয়া-টেকনাফে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গার দীর্ঘমেয়াদি অবস্থানে শঙ্কিত স্থানীয় জনগোষ্ঠী। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় তাদের সাথে স্থানীয়দের নানা দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন কারণেই স্থানীয় জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের ওপর অসন্তুষ্ট। অন্য দিকে প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত সরকারি কর্মকর্তারা জানান, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন কার্যক্রম কখন শুরু হবে তার দিনক্ষণ এখনো ঠিক হয়নি। এ পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ক্রমেই বাড়ছে।