image

ডেড লাইন কেরানীগঞ্জ : সেই ভয়াল ২৫ নভেম্বর 

image

স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর আজও ঢাকার কেরানীগঞ্জের ঘাটার চরের টানপাড়া গ্রামের মানুষের কান্না থামেনি। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে ২৫ নভেম্বর ভোরে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায় দেশীয় দোসরদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী।

গত ২৩ ও ২৪ নভেম্বর সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, কেরানীগঞ্জের ঘাটার চরের  টানপাড়া, ভাওয়ার ভিটা খান বাড়িসহ গোটা এলাকায় এখনো মানুষ এক অজানা আতংকে দিন কাটান। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর যুদ্ধ অপরাধী তথা তাদের এদেশীয় দোসরদের মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচার হলেও ঘাটার চরের টানপাড়া গ্রামের স্বামী, সন্তান, ভাই-স্বজনহারা পরিবারগুলোতে মনের শান্তনাটুকু পাননি ঘাতকদের বিচারের মাধ্যমে। আজও বুক ফুলিয়ে গ্রামে ঘুরে বেড়ায় ৭১ এর খুনী রাজারকার, আলবদর আল- শামসসহ পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগীরা। 

টানপাড়া গ্রামের চার পাশেই নদী আর খাল। গাছ-পালায় ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পূর্ণ এই গ্রাম। কৃষকের ঘরে ঘরে গোলায় ভরা ধান।যুদ্ধ জয়ের শেষ প্রান্তে বাংলাদেশ। সীমান্তবর্তী জেলা শহরগুলোতে স্বাধীনতার নতুন লাল সূর্য উঁকি দিচ্ছে। ইপিআর সদস্য মজিবুর রহমান, গোলাম মোস্তফা, মজিদ পালোয়ান ও আজিজ খানরা যখন যুদ্ধ করছে দেশের জন্য। ওই সময়ে কেরানীগঞ্জের প্রভাবশালী রহমান  মাতব্বর টানপাড়া গ্রামের তরুণ- পুরুষদের মুক্তিযুদ্ধ করতে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করতে টানপাড়া জামে মসজিদের সামনে গ্রামের পুরুষদের নিয়ে বৈঠক করেন। মুক্তিযুদ্ধে যেতে সবাই নাম লেখায়। এই নাম লেখানোই যেন সবার মৃত্যু ঘন্টা বাজিয়ে দেয়।পাকিস্তানি বাহিনীর এদেশীয় সহযোগীরা জেনে যায়, গ্রামের সবার মুক্তিযুদ্ধ যাবার খবর। পাকিস্তানিদের কাছে পৌছে গেলো সেই তালিকা। এরপরই ২৩ ২৪ নভেম্বর দিনভর পাকিস্তানি বাহিনীর এদেশীয় সহযোগীরা গোটা গ্রামে নজরদারি করতে থাকে। ২৪ নভেম্বর রাত থেকেই গ্রামবাসীর মাঝে মুখ চেনা রাজাকারদের আনা-গোনায় সন্দেহের সৃষ্টি হলেও তারা ভাবতেই পারেনি এতো বিশ্বাস ঘাতক জাতি হতে পারে বাঙালি। একটি গ্রামে এমন হত্যাযজ্ঞ তারা কল্পনাও করতে পারেননি।

কেরানীগঞ্জ, আটি আর ঢাকার হাজারীবাগের রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিস্তানিরা ঘিরে ফেলে টানপাড়া গ্রাম, ভাওয়াল খানবাড়িসহ ঘাটার চর। এরপরের বর্ননা আরো মর্মান্তিক। গ্রামের ঘর থেকে পুরুষদের ধরে এনে এনে জড়ো করা হচ্ছিলো খালপাড়ে, বিভিন্ন বাড়ি-ঘরে দেয়া হচ্ছিলো আগুন। দৌড়ে টানপাড়া জামে মসজিদের ছাদে আশ্রয় নেন গ্রামের টগবগে তরুণ ফুলেমান। ঘন কুয়াশা আর অন্ধকার রাত পাকিস্তানি বাহিনীর আগুন আর হাজার হাজার গুলির আলো যেন টর্চের মতোই ঝল-ঝল করছিলো। চোখের সামনেই ১০০মন ধানের গোলাটি আগুনে ছাই হয়ে যাচ্ছিলো।ঘর থেকে ধরে নিয়ে গেলো দুই ভাই সোলেমান আর লোকমানকে।এরপরই গুলির শব্দ। নারী-শিশুদের চিৎকার কান্নার শব্দে গোটা গ্রামের আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠে। এ ভাবেই কয়েক ঘন্টা চলে পাকিস্তানি বাহিনীর লোমহর্ষক হত্যাযজ্ঞ। সকাল হতেই গ্রামটি হয়ে যায় পুরুষ শূন্য। ৫৮ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করা হয়।

৭১এর ২৫ নভেম্বর ভোররাতে টানপাড়া গ্রামের এই হত্যাযঘ্যের বর্ননা দিচ্ছিলেন টানপাড়া গ্রামের বর্তমান ৯০ বছরের বৃদ্ধ ফুলেমান। তার দুই ভাই সোলেমান ও লোকমানকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি আর এদেশীয় তাদের সহযোগী রাজাকাররা। গত ৪৮বছর ধরে দুই ভাইসহ গ্রামের ৫৮ জন স্বজন হারানোর শোক বয়ে বেড়াচ্ছেন ফুলেমানের মতো জহির উদ্দীন, রহমানের সন্তানরা। নব্বই বছরের বৃদ্ধ ফুলেমান। ৪৮ বছরে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলছেন তিনি। মনে শুধু হতাশা। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে আক্ষেপ করে বললেন, আমার ভাই, স্বজন-সম্পদ সব হারিয়েছি। কৈ কেউতো আমাদের খোঁজ নিতে আসে না। আমরা ৪৮ বছর ধরে কি ভাবে বেঁচে আছি। আমাদের গ্রামের একটি পরিবারের নামওতো শহীদ পরিবারে নেই। কি পেয়েছি আমরা। তাদের রক্তে একটি স্বাধীন ভূখন্ড আর পতাকাই এখন আমাদের অর্জন।

পাশের বাড়ি শহীদ জহিরুউদ্দীনের স্ত্রী আয়েশা খাতুন।বয়স ৭৫এর কোটা ছাড়িয়েছে।বাড়ির পাশে নিজ স্বামী আর জহিরুউদ্দীনের ভাতিজার কবর দেখিয়ে বলেন, সকালে রক্তাক্ত লাশ দুটি কোনক্রমে এনে ঘরে থাকা চাদর দিয়ে পেঁচিয়ে ঘরের পাশেই দাফন করেছি। পচাত্তর বছরের বৃদ্ধা আয়েশা খাতুন বলেন, বিয়ের পর পাঁচ/ সাত বছর সংসার করার পরই স্বামী হারাই। ৪৮ বছর ধরে কেউ খোঁজ নেয় না আমরা কেমন আছি। কিভাবে বেঁচে আছি। তিনি বলেন, স্বামী- স্বজন হারিয়েও শহীদ পরিবার হিসেবেও সরকারের স্বীকৃতি টুকুও পাইনি। আমাদের পরিবারসহ শহীদ হওয়া এই গ্রামের পরিবারগুলোতে কোন পুরুষ ছিলো না যে, ওরা দৌড়-,ঝাপ করবে আমাদের জন্য। এখনো শুনি খুনিদের অনেকেই এই কেরানীগঞ্জ আর ঢাকায় ঘুরে বেড়ায়। এদের কোন বিচারের আওতায় আনা হয়নি। আয়েশা খাতুনের বাড়িতেই শহীদদের নামে মাদ্রাসায় খাবার দেয়ার জন্য রান্না করছিলেন শহীদ শাহাবুদ্দিনের ছেলে মন্টু, শহীদ সালাউদ্দীনের ছোট ভাই মাহতাবুর। ৭১এর সেই ২৫ নভেম্বর এরা শিশু সন্তান থাকায় প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। স্বজন হারা মন্টু - মাহতাবুর বললেন আমরা মা, চাচি আর দাদিদের কাছে শুনেছি সেই রাতের পাকিস্তানি বাহিনী আর এদেশীয় সহযোগীদের হাতে শহীদ হওয়া আমাদের বাবা-চাচা ও গ্রামবাসীদের উপর নির্মমতার কথা।

এই প্রজন্মের তরুণ টানপাড়া গ্রাম আর ঘাটার চরের বাসিন্দা মাছুদ, জিয়াউল হক জিয়া, দিনলাল, আজাদ, আসলাম, বাবুল ও অপুরারা বললেন, আমরা মুরুব্বিদের কাছ থেকেই শুনে আসছি আমাদের গ্রামের এই বর্বরতার কথা। তরুণরা জানান, গ্রামে এমন পুরুষ ছিলো না যে, আমরা তাদের কাছ থেকে ঘটনা শুনবো। কারণ পাকিস্তানি বাহিনী প্রায় সব পুরুষদেরই মেরে ফেলেছিলো। এরা সবাই এই হত্যাকান্ডে জড়িত সবার বিচার না হওয়ায় হতাশ।

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার আগেই ১/১১ এর সেনা সমর্থিত তত্বাবদায়ক (ফকরুউদ্দীন-,ইয়াজউদ্দীন) সরকারের শাসনামলে ২০০৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর ঢাকার সিএমএম কোর্টে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে ঢাকা জেলা মুক্তিযুদ্ধা কমান্ডার মোজাফফর আহমেদ ১৩জনের নাম উল্লেখ সহ অজ্ঞাত ৫০/৬০ জনের নামে মামলা দায়ের করেন। এরপর ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ সরকারে আসলে যুদ্ধাঅপরাধ ট্রাইবুনালে মামলাটি চলে আসে। ওই মামলার এজাহারে যাদের নাম ছিলো এরা হলেন মতিউর রহমান নিজামি, আলি আহসান মুজাহিদ, মোঃআব্দুল কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান, হাজী নাজিম উদ্দীন, আবুল হাসেম, ফয়জুর রহমান ফয়েজ, কে জি,করিম বাবলা, মোঃইয়াসিন, ডাঃজয়নাল, আঃখালেক, আঃমান্নান সিদ্দীকী, পুইন্না আলবদর।

মামলার বাদি মোজাফফর আহমেদ জানান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের তদন্তে শুধুমাত্র কাদের মোল্লাকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেয়া হয়। ট্রাইবুনালে দেয়া স্বাক্ষী মজিদ পালোয়ান জানান, আমরা ট্রাইবুনালের বিচারককে বলেছি, এই হত্যাকান্ডে আরো অনেকে জড়িত ছিলো। এজাহারে তাদের নাম ছিলো কিন্তু বাদ দেয়া হয়েছে। আলোচিত এই মামলায় একমাত্র আসামী কাদের মোল্লাকে প্রথমে বেকসুর খালাস দেয়া হলে রাষ্ট্র পক্ষ আপিল করলে কাদের মোল্লার যাবৎজীবন কারাদণ্ড হয় বলে মামলার বাদি মোজাফফর আহমেদ জানিয়েছে।

এ দিকে ৭১এর ২৫ নভেম্বর ঘাটার চর, টানপাড়া গ্রাম আর ভাওয়াল ভিটার খান বাড়িতে ঘুরে দেখা যায়, গ্রামবাসীদের মাঝে যেমন চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে পাশা-পাশি আতংকও কাজ করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গ্রামবাসীরা বললেন, স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী পর আমাদের মঝে আতংক বিরাজ করছে। কারণ এলাকার রাজাকার, আলবদর, শান্তি কমিটির যারা পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী ছিলো তারা অনেক ক্ষমতাশালি, অনেকের সন্তন এমপি - চেয়ারম্যানও হয়ে গেছেন।

এই মামলার অন্যতম সাক্ষী  মজিদ পালোয়ান বললেন, দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমি ট্রাইবুনালের সাক্ষী দেয়ার আগে একজন মন্ত্রী আমাকে এক এমপির বাবার নামটি না বলতে নিষেধ করেছিলেন। ট্রাইবুনালের বিচারকদের কাছে এজাহারে থাকা নামগুলোর অনেক আসামীকে চার্জশীট থেকে বাদ দেয়ার বিষয়টি বলা হলেও কোন পদক্ষেপ কেন নেয়া হলো না জানতে চাইলে তিনি বলেন,এটা মন্ত্রী- এমপিরা জানে।