image

ভোলায় কুঁড়েঘর, ঢাকায় কোটিপতি ছাত্রলীগ নেতা মুমিন

image

যমুনা নিউজের সৌজন্যে ডেস্ক রিপোর্ট : পরপর কয়েকটি কুঁড়েঘর। একটি ঘরের উঠান পেরিয়ে আরেকটিতে যেতে হয়। এরকম কয়েকটি ঘর পেরিয়ে পাওয়া গেলো সেই বাড়িটি। ভোলায় গত কয়েকদিন ধরে টক অব দ্যা টাউন এই বাড়িটি ঘিরে। কারণ ক’দিন আগে ঢাকা থেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এসে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় এই বাড়ির ছেলে মুমিনকে। তখনই ঘরে থাকা বাবা-মার কানে আসে ছেলে মুমিন নাকি ঢাকায় বিশাল নেতা, তার আছে লাখ লাখ টাকা, আর বড় বড় মানুষের সাথে ওঠাবসা। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিদ্ধান্ত জালিয়াতি মামলায় এই মুমিন এখন তেজগাঁও থানা পুলিশের রিমান্ডে। রাজধানীর কোতয়ালী থানায় একটি জালিয়াতির মামলাও দায়ের হয়েছে তার বিরুদ্ধে। ঢাকার কয়েকজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে প্রকল্পের কাজের তদবির করে দিবে বলে কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ তরিকুল ইসলাম মুমিনের বিরুদ্ধে।

যমুনা নিউজের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে ভোলার ভাঙা ঘরের ছেলেটি ঢাকায় এসে কীভাবে মহীরুহ হয়ে উঠলো। ভোলার স্থানীয় ছাত্রনেতা ও ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

তার পুরো নাম তরিকুল ইসলাম মুমিন, নিজের গ্রামে “মুর্কামমিন” বলেও ডাকতো কেউ কেউ। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর ২০১১ সালে ঢাকায় আসেন মুমিন। সর্বপ্রথম তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটির (ডিইউডিএস) সভাপতি আশিকের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ক’টা দিন থাকার জন্য আশ্রয় চান। একই এলাকার হওয়ায় মুমিনকে সূর্যসেন হলের ৫৪১ নম্বর কক্ষে কয়েকদিন থাকতে দেন আশিক। এরমাঝেই মুমিন শুরু করে ছোট ছোট প্রতারণা। হলের নিচের দোকানে ফাও খাওয়া, শিক্ষার্থীদের বকা-ঝকা, তর্কাতর্কিসহ বিভিন্ন অভিযোগ শোনার পর তাকে হল থেকে বের হয়ে যেতে বলেন তৎকালীন ডিইউডিএস সভাপতি। এবার হলে আশ্রয় নেওয়ার জন্য মুমিন টার্গেট করেন সেই সময়ের বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মামুনুর রশীদকে। পরে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিরও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হন মামুন। কয়েকদিন ফুট-ফরমায়েশ খাটার পর মামুনই তাকে আশ্রয় দেন সুর্যসেন হলের তিনতলার দক্ষিণ কোণের একটি কক্ষে। সেই সময় থেকেই মুমিন তার এলাকা ভোলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে পরিচয় দেয়া শুরু করেন। সূর্যসেন হলের কিছু নেতার সাথেও পরিচয় হয়। সূর্যসেন হলের আঞ্চলিক রাজনীতিতে বরিশাল অঞ্চল বেশ শক্ত হওয়ায় সেই পক্ষের সাথে মিশে যান মুমিন।

প্রতারণা ও জালিয়াতিতে অভিযুক্ত মুমিনের বড় উত্থানটি হয় মূলত ২০১৬ সালে, ছাত্রলীগের সোহাগ-জাকির কমিটি আসার পর। তখন ছাত্রজীবন শেষ হওয়ায় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মামুনুর রশীদ হল থেকে চলে যান। কক্ষটি দিয়ে যান মুমিনকে। মুমিন টার্গেট করে সম্পর্ক করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি আবিদ আল হাসানের সাথে। তখন থেকেই নিজেকে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য পরিচয় দিতে থাকেন তিনি। সেসময় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের কাছে বেশ কয়েকজন অভিযোগ দেন, মুমিনের কার্যকলাপ ও কমিটিতে না থেকেও নাম ব্যবহারের বিষয়টি নিয়ে।

এর কয়েকমাস পর মুমিন সত্যি সত্যি জায়গা পেয়ে যান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে অনেকটা গণহারে একটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করেন সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সেক্রেটারি জাকির হোসেন। সেই কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য হন মুমিন। তখন পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে “বৃহত্তর বরিশাল গ্রুপ”-এর প্রভাবশালী হিসেবেই আত্মপ্রকাশ ঘটে তার। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই নয়, ক্যাম্পাসের বাইরেও প্রসারিত হতে থাকে কার্যকলাপ। বাইরে গিয়ে নিজেকে নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির বড় নেতা পরিচয় দিতেন তিনি।

তখন থেকেই নানা ধরনের জালিয়াতির সাথে জড়িয়ে পড়েন মুমিন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ভর্তি, গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ, নিয়োগ ও তদবির বাণিজ্য শুরু হয় পুরোদমে। প্রকল্প পাশ করানোর কথা বলে বেশ কয়েকজন ঠিকাদার, ব্যবসায়ীর থেকে টাকা নেয়ার কথাও রিমান্ডে জানিয়েছেন তিনি। সবশেষ, নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার নিয়োগের সময় চাঞ্চল্যকর জালিয়াতিতে ধরা না পড়লে হয়তো এই বাণিজ্যেও উতরে যেতেন মুমিন। ভোলায় বিভিন্ন জনকে চাকরি দেওয়ার নাম করে টাকা নেয়া ও প্রতারণার অনেক অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। সদর থানায় তার নামে আছে বেশ কয়েকটি মামলা।

ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি আবিদ আল হাসানের দাবি, ‘মুমিনের সাথে আমার কোনো সখ্য ছিল না। আমি সভাপতি হবার আগেই সাবেক নেতা মামুনুর রশীদ ও ডিইউডিসের সাবেক সভাপতি আশিক ভাইয়ের রুমে থাকতো এটা জানতাম। মুমিন এসে মাঝে মাঝে মামুন ভাইয়ের আত্মীয় পরিচয় দিতো। সে ক্যাম্পাসের ছাত্র ছিল না, এটা জানতাম না।

আবিদ আল হাসান জানান, মুমিন যাতে কেন্দ্রীয় কমিটিতে জায়গা না পান সেজন্য দলের সেক্রেটারি জাকির হোসেনকে ২/৩ বার অনুরোধ করেন তিনি’।

কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন জানান, ‘মুমিনের ব্যাপারে আমিও কয়েকজনকে সাবধান করেছি। সে কমিটির না হয়েও পদ ব্যবহার করতো শুনতাম। কিন্তু, তৎকালীন প্রভাবশালী মন্ত্রীর পিএস-এর তদবিরের জন্যই তাকে মৌখিকভাবে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে ঘোষণা করি’।

মামলা ও রিমান্ড নিয়ে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার বিজয় বসাক তালুকদার বলেন, ‘একটি স্পর্শকাতর মামলায় সে রিমান্ডে আছে। মূলত জালিয়াতিতে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের একজন সহকারীকে আটকের পর সে মুমিনের কথা জানায়। রিমান্ডে পাওয়া তথ্যগুলো পরে জানানো হবে বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা’।

মুমিন আরো বড় পরিসরে ছাত্রলীগে আত্মপ্রকাশ করেন দুই বছর আগে। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির পরিবর্তন হয়। সোহাগ-জাকির কমিটি বিদায় নিয়ে আসে শোভন-রাব্বানী কমিটি। তখনকার বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি আবিদ আল হাসান হল থেকে চলে যাওয়ার পর মুমিনও হল ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। কারণ কয়েকবছর ধরে তিনি যেসব শিক্ষার্থী, নেতা-কর্মীদের সাথে প্রতারণা করেছেন, যারা মুমিনের হম্বিতম্বি ও অত্যাচার সহ্য করেছেন তাদের আক্রোশের মুখে পড়েন মুমিন। হল ছেড়ে বাসায় উঠলেও ক্যাম্পাসে প্রভাব কমেনি। মুমিনের যাতায়াত তখন শুরু হয় বঙ্গবন্ধু হলের নর্থ ব্লকে। সেই ব্লকের ২০৮ নম্বর রুমে থাকতেন ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী। রাব্বানীসহ ওই হলের বরিশাল অঞ্চলের অনেক নেতার সাথে সখ্যতা হয় মুমিনের। তাদের বাসায় ও পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু হলেও মাঝে মাঝে থাকতেন তিনি। হলের একাধিক সাবেক ছাত্রনেতা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়িত্বরত একটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা জানান, রাব্বানীর সাথে মূলত টাকার লেনদেন করেই সখ্যতা হয় মুমিনের। অন্তত ১৮ লাখ টাকা দিয়ে তখন কেন্দ্রীয় কমিটিতে সহসভাপতির পদ পান মুমিন।

মুমিন যে কমিটিতে সহসভাপতি হন, ওই কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণার পর শোভন ও রাব্বানীর বিরুদ্ধে রাস্তায় নামেন শতাধিক পদবঞ্চিত নেতা। তারা টিএসসিতে আমরণ অনশনও করেন। পরে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে ওই কর্মসূচি থেকে সরে আসেন পদবঞ্চিতরা।

ওই আন্দোলনে অংশ নেওয়া সাবেক কেন্দ্রীয় কর্মসূচি ও পরিকল্পনা বিষয়ক সম্পাদক রাকিব হোসেন জানান, আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি, টাকা দিয়ে পদ দেওয়ায় আমার যারা আজীবন ত্যাগী কর্মী তাদের বঞ্চিত করা হয়েছিল। মুমিনের ঘটনা সেটার বড় প্রমাণ। মুমিনসহ কেউ কেউ ছাত্রলীগের না হয়েও টাকা দিয়ে পদ পেয়েছে এমন কথা আমরা বারবার বললেও কেউ পাত্তা দেয়নি।

তবে এসব তথ্য অস্বীকার করেন ছাত্রলীগের সবশেষ পদত্যাগ করা সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী। ফেসবুকের একটি পোস্টে তিনি লেখেন, ‘মুমিনের জন্য এতো বড় বড় নেতার তদবির ছিল যে তাকে আমি পদ দিতে বাধ্য হই। কমিটি দেয়ার আগে তাকে একটি উপ-সম্পাদক করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু, এমন একজন তাকে সহসভাপতি পদ দেয়ার রেফারেন্স দেয় যে তার কথা উপেক্ষা করতে পারিনি’।

মুমিনের এই উত্থান নিয়ে কথা হয় ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়ের সাথে। এসব তথ্যের সত্যতা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন কারো না কারো শেল্টারে চলেছে সে। কিন্তু, তার আগে থেকে পদ থাকায় আমাদের কিছু করার ছিল না। সবশেষ মুমিন এমন জালিয়াতি করেছে তাতে সবাই স্তম্ভিত। ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে এতোদিন সে যা করেছে এর দায় সগঠন নেবে না। তাকে এরমধ্যে স্থায়ী বহিস্কার করা হয়েছে।

মুমিনের সব অপরাধের বিচার করতে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেও সব সহায়তা করা হবে বলে জানান জয়।

অভিযুক্ত তরিকুল ইসলাম মুমিনের বাবা ৭৫ বছর বয়সী ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘এগুলোর কিছুই জানতাম না আমরা। তাকে পড়াশোনার জন্য পাঠিয়েছি ঢাকায়। মাঝে মাঝে অল্প ক’দিনের জন্য বাড়ি আসতো। বলতো ঢাকায় তার বড় কাজ, কিন্তু কী কাজ বলতো না। তার কাছে কখনো টাকা-পয়সা চাইনি আমরা। সবসময় বলতাম, পড়াশোনা করে মানুষ হও। আমাদের অল্প যা আছে তাতেই চলবে’।

মুমিনের মা পারভীন বেগম বলেন, ‘এনজিওতে ছোটকাজ করে দুই ছেলেকে বড় করেছি। কখনো খারাপ কিছু শেখাইনি। বড় ছেলের নামে এতোকিছু জানতামও না। হঠাৎ সেদিন বাড়ি এসে তাকে আটক করে নিয়ে গেলো। বলে গেলো ঢাকায় বড় প্রতারণার হোতা সে’।

খবর : যমুনা নিউজ