image

উচ্চ আদালতের আদেশ অনুযায়ী নদী দখলকারীদের শাস্তির আওতায় আনা হোক: আনোয়ার হোসেন

image

বিশ্ব পরিবেশ দিবস এবার করোনা বিপর্যয়ের মধ্যেই পালিত হচ্ছে। প্রাণীকুলের মাঝে এবারের জীববৈচিত্র্য ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়েছে। যেখানে মানুষের কোলাহল আর পদচারনায় মুখরিত থাকতো বিচ আর পর্যটন শহরগুলো সেখানে দখল করে নিয়েছে প্রাণীকুল। সৃষ্টিকর্তার এ এক মহান শিক্ষা আমাদের মানবসভ্যতার জন্য।

বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট আনোয়ার হোসেন বলেছেন, নদী না বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে না। তাই দেশের নদী দখল,দূষনকারীর যে তালিকা তৈরী করা হয়েছে হাই কোর্টের আদেশ অনুযায়ী আমরা এর পূর্ণ বাস্তবায়ন চাই। নদী দখলকারীদের শাস্তির আওতায় আনারও দাবী জানান।

বিশ্বের ১৪৩ টি দেশে একযোগে পালিত  হচ্ছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস। এবার আয়োজক কলম্বিয়ার সাথে পার্টনারশিপে জার্মানি দিবসটি উদযাপন করছে। এ বৎসর দিবসের মূল প্রতিপাদ্য “Biodiversity বা জীববৈচিত্র্য“। ইতিমধ্যে জাতীসংঘ ২০১১-২০২০ সময়কে Decade on Biodiversity হিসেবে ঘোষণা করেছিলো। এ বছর শেষ সময় আমরা পার করছি।

বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট আনোয়ার হোসেন। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি বাংলাদেশের নদী রক্ষার আনন্দোলন করে আসছেন। সিটিজি সংবাদ ডট কম এর সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় বললেন, বর্তমান বিশ্বে মানুষের বিভিন্ন কর্মকান্ডের কারণে পরিবেশ বিপর্যয়, জলবায়ুর পরিবর্তন ও জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন। 

আমাদের দেশে প্রভাবশালীদের আশ্রয়ে- প্রশ্রয়ে অসাধু চক্র নদ-নদী,খাল-বিল, হাওর-বাওর, নালা দখল করছে। এ ছাড়া দূষণ, মিল কারখানার বর্জ্য বিষাক্ত করে ফেলেছে নদীর পানি। নদী হারাচ্ছে নাব্যতা, দিনে দিনে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে নদীপথ, এমনকি পানি নিষ্কাসনের পথও। হারাতে বসেছি আমাদের  সবুজ শ্যামল বাংলার অপরুপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীব বৈচিত্র। নেমে আসছে পরিবেশের মহাবিপর্যয়। সামান্য বৃষ্টিতেই তলিয়ে যাচ্ছে রাজধানী ও বানিজ্যিক শহর চট্রগ্রাম। তৈরি হচ্ছ জলাবদ্ধতা, নস্ট হচ্ছে রাস্তাঘাট,ব্যহত হচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাত্রা।

এতে রাষ্ট্রের পরিবেশ বিপর্যয় ছাড়াও অর্থনীতি ক্ষতির সাথে ঢাকার বাতাসে দূষণের মাত্রা গত ১০ বছরে ৮৬ শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। সাধারণত ইটভাটা আর শিল্পকারখানা থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া, পরিবহনের ধোঁয়া, নির্মাণাধীন বিভিন্ন প্রকল্পের আবর্জনা এই তিনটি উৎস থেকে দূষিত হয় বায়ু। এসব দূষিত বায়ুর কারণে প্রতিনিয়তই বাড়ছে শ্বাসকষ্ট জনিত ফুসফুসে ক্যানসারসহ এজমার মতো রোগ।

আনোয়ার হোসেন বলেন, ঢাকার পরই নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর সবচেয়ে বেশি দূষণের শিকার। ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ মাসে বায়ু দূষণ সবচেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ইট ভাটাগুলো বায়ু দূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী৷ 

পানি দূষণ পুরো জীববৈচিত্রকে প্রভাবিত করে। এটি প্রমাণিত হয়েছে যে, পানি দূষণ বিশ্বজুড়ে মৃত্যু এবং রোগের প্রধান কারণ। শুধুমাএ পানি দূষণের কারণেই প্রতিদিনই বিশ্বে প্রায় ১৪০০শ’রও বেশি লোকের মৃত্যু হয়। বাংলাদেশে আনুমানিক ৮০ জন মানুষ পানি দূষণ সম্পর্কিত অসুস্থতায় প্রতিদিনই মারা যায়।

বাংলাদেশে শব্দদূষণের ভয়াবহতার উল্লেখ করে তিনি বলেন, এক গবেষণায় দেখা গেছে নর্মালি এই মাত্রা হওয়া উচিত ৬০-এর কম এনবিএম। কিন্তু ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায়, যেমন নিউমার্কেটের সামনে ওভারব্রিজের নীচে, শাহবাগ বা গুলিস্তানে এনবিএম ১১০ থেকে ১২০ পর্যন্ত ওঠে৷ এটা কখনোই ৯০-এর নীচে নামে না৷

তিনি দূষণে ক্ষতির উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশে বায়ু, পানি ও পরিবেশ দূষণে বছরে ক্ষতির পরিমাণ প্রায়  ৪২ হাজার কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২.৭ ভাগ৷ শুধুমাত্র বায়ু দূষণে ক্ষতি হয় ২০ হাজার কোটি টাকা৷ দূষণের সবচেয়ে বেশি শিকার হয় শিশুরা।

তিনি বলেন অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়নের ফলেও বাংলাদেশের পরিবেশ মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ছে।শিল্পকারখানাগুলো অপরিকল্পিতভাবে ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগন্জে ভূগর্ভস্থ পানি তোলার ফলে পানির স্তর আশঙ্কাজনক হারে নীচে নেমে যাচ্ছে।

৭১৯টি তৈরি পোশাকশিল্পের ওয়াশিং ও ডাইং কারখানার বর্জ্য দূষণের অন্যতম উৎস৷ এক টন কাপড় উৎপাদন করতে নদীতে বর্জ্য যাচ্ছে ২০০ টন৷  ইস্পাত কারখানাগুলো থেকে ১ লাখ কোটি লিটার এবং কাগজ কারখানাগুলো থেকে ৪৫ হাজার কোটি লিটার দূষিত বর্জ্য পানিতে মেশে। ফলে খাল ও নদীসহ অন্যান্য জলাশয়ের পানিও মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। ঢাকার পাশাপাশি ছোট জেলা শহরগুলোতে জলাশয় ভরাট, দখল ও দূষণ চলছে।

তিনি বলেন, আমরা চাচ্ছি টেকসই উন্নয়ন,কিন্তু পরিবেশ ও নদীগুলোর জলপ্রবাহের সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য নদী ও পরিবেশ বাঁচাতে প্রয়োজন সরকারী ও বেসরকারি সংস্থার সমন্বিত  কার্যক্রম।

তিনি বলেন, আমরা উন্নয়নের নামে, শিল্প বিপ্লব ঘটিয়ে,বিভিন্ন মারনাস্ত্র তৈরী করছি। যুদ্ধ করে, বোমা ফাটিয়ে, আনবিক বোমার পরীক্ষা ও প্রয়োগ করে, নদী দখল ও দূষণকরে গাছপালা নিধন করে, বন উজারকরে  ও রাসায়নিক অস্ত্রের ধ্বংসলীলা চালিয়ে যাচ্ছে উন্নত বিশ্ব।  বন্যপ্রাণী ও পশুপাখি শিকার ও ভক্ষণ করে, গাড়ি, ও কলকারখানায় জীবাশ্ম তেল ও ক্যামিকেল ব্যবহার ও গ্রীন হাউজ গ্যাস (কার্বন ডাই অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, মিথেন প্রভৃতি) নির্গত করে পৃথিবীটাকে অগ্নিপিণ্ডে রুপান্তরিত করছে। প্রকৃতি ও জীবজগতকে প্রকম্পিত ও বিপন্ন করে ফেলছে। প্রকারান্তরে মানুষ আজ তার নিজের অস্তিত্বকেই হুমকির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। অথচ মাটি পানি বায়ুসহ ইত্যাদির আন্তঃসম্পর্কের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সিস্টেমে বা ইকোসিস্টেমের (বাস্তুতন্ত্রের )সাথেই আমাদের জীববৈচিত্র্য ঘনিষ্টভাবে জড়িত। আর পরিবেশে বিভিন্ন উদ্ভিদ, প্রাণী অনুজীবের প্রাপ্যতা ও বৈচিত্র্যই হলো  Biodiversity   বা জীববৈচিত্র্য।

পরিবেশের অবক্ষয় জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ। পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব টিকে থাকার জন্যই জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। কেননা পরিবেশে উদ্ভিদ এবং প্রাণী একে অপরের উপর নির্ভরশীল। যেমন উদ্ভিদ সূর্যের আলো পানির সাথে সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় খাদ্য তৈরী করে। উদ্ভিদ নিজে এ খাদ্য গ্রহণ করে এবং প্রাণীও এ খাদ্যের উপর নির্ভরশীল। প্রাণী নিজের খাদ্য নিজে তৈরী করতে পারেনা,কাজেই পৃথিবীর সকল প্রাণীর খাদ্যের জন্য উদ্ভিদের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে নির্ভর করতে হয়।

তাছাড়া উদ্ভিূদ অক্সিজেন ত্যাগ করে মানুষ তা গ্রহণ করে এবং মানুষ কার্বন ড্রাই অক্সাইড ত্যাগ করে অক্সিজেন গ্রহণ করে। এছাড়াও অনেক উদ্ভিদ হচ্ছে কীটপতঙ্গের আবাস্থল। অর্থাৎ উদ্ভিদ এবং প্রাণী একে অপরের উপর নির্ভর শীল। প্রাণীকুল করোনাকালীন মহাবিপদের সময় পরিবেশ অনেকটাই তাদের নিজেদের মতকরে সাজিয়ে নিয়েছে।