image

নির্ভিক ও অকুতোভয় মাওলানা শফিক আহমদ (রাহঃ)

image

১২ জানুয়ারি ২০১৭ সকালে ঘুম থেকে ওঠেই ভাগিনা ইকবালের কান্না জড়িত কন্ঠে তাঁর আব্বা মাওলানা শফিক আহমদ সাহেবের ইন্তেকালের সংবাদ পাই। পরক্ষণে মরহুমের মেঝ ছেলে ভাগিনা তারেকের মোবাইল। দুঃসংবাদটি ছিল বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত। আত্মীয়তার সম্পর্ক ছাড়াও মাওলানা শফিক আহমদের ন্যায় উঁচু মাপের আলেম, শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে আপোষহীন নির্ভিক ও অকুতোভয় সমাজসেবক, ন্যায় বিচারক-এক কথায় বর্ণাঢ্য ঐতিহ্যের অধিকারী একজন মহান ব্যক্তিত্বের মহাপ্রয়ানে রীতিমত আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি। জেয়াফত অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গেলে ভাগিনা তারেক তার আব্বার স্মরণে প্রকাশিতব্য স্মারক গ্রন্থের জন্য তথ্যবহুল একটি লেখার অনুরোধ জানান। ভাগিনা বিশিষ্ট ব্যাংকার তারেকের অনুরোধেই আজকের নাতিদীর্ঘ এই লেখা।

আল্লামা শফিক আহমদ (রাহঃ) লোহাগাড়া উপজেলার আধুনগর হরিণা গ্রামে ১৯৪৪ সালে সম্ভ্রান্ত এক জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মরহুম পিতা মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ ছিলেন আধুনগর ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও প্রখ্যাত জমিদার। মাতৃকুলের বংশধারাও অত্যন্ত মর্যাদা সম্পন্ন। সাতকানিয়ার বারদোনা গ্রামের প্রখ্যাত সুফি-দরবেশ হাফেজ কলিমুল্লাহ( রাহঃ)এর মেয়ের ঘরের নাতি ছিলেন তিনি। বুলবুলে বাংলা খ্যাত প্রখ্যাত ওয়ায়েজ মাওলানা মোবারক আহমদ ( রাহঃ) ছিলেন তাঁর আপন মামা।

আল্লামা শফিক আহমদ চুনতি হাকিমিয়া কামিল মাদ্রাসা থেকে ১৯৬৫ সালে ফাযিল এবং ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে ১৯৬৭ সালে কামিল পাস করে চুনতি হাকিমিয়া কামিল মাদ্রাসায় শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করেন। মাঝখানে শিক্ষকতা পেশায় কিছুদিন বিরতি দিয়ে নব্বই দশকের শুরুতে তিনি আমিরাবাদ সুফিয়া আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হিসেবে বেশ কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেন। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী মাওলানা শফিক আহমদ (রাহঃ) একাধারে ওয়ায়েজ,শায়ের এবং লেখক ছিলেন। তাঁর রচিত হামদ, না'ত, মর্সিয়া সংকলন "তছল্লিয়াতে হাতের", "রহমতের ঝর্ণাধারা গতিরোধ করছে কারা" ও "হাদিসের আবরনে সত্যের বিচরন" গ্রন্থ সমূহে প্রখর মেধা ও গভীর পান্ডিত্যের পরিচয় পাওয়া যায়। হামদ, না'ত ও মর্সিয়া নিজের সুললিত ও মিষ্টি কন্ঠে গাওয়ার সময় দর্শক-শ্রোতারা মনোমুগ্ধ ও তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়তেন।

চুনতি হাকিমিয়া কামিল মাদ্রাসার তদানীন্তন নাজেমে আ'লা আল্লামা ফজলুল্লাহ (রাহঃ) (প্রফেসর ড.আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী এমপি'র শ্রদ্ধাভাজন আব্বা) এর রচিত উচ্চ মার্গীয় হামদ, না'ত ও মর্সিয়ায় তাঁর সুর ও কন্ঠ ছিল অত্যন্ত মানানসই। ১৯৭৯ সালে আমাদের সকলের ওস্তাজ নাজেমে আ'লার ইন্তেকালের দিন প্রিয় ওস্তাজের শোকে মুহ্যমান মাওলানা শফিক আহমদ (রাহঃ) এর অঝোরে কান্না এখনো স্মৃতিতে অম্লান।

উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমিদারিত্ব তথা সামাজিক প্রতিপত্তি ও সুখ্যাতির মায়াজালে আচ্ছন্ন না থেকে শিক্ষকতার পাশাপাশি ওয়াজ নছিহতকে তিনি মহান ব্রত হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। একজন প্রথিতযশা, যুক্তিবাদী ওয়ায়েজ হিসাবে তাঁর সুনাম ও সুখ্যাতি সর্বত্রে ছড়িয়ে পড়ে। সুমধুর ও সুললীত কণ্ঠের অধিকারী আল্লামা শফিক আহমদের ওয়াজ মাহফিলে দূর-দূরান্ত থেকে দর্শক শ্রোতাদের ঢল নামত। ওয়ায়েজে বেনজির হিসাবে তিনি বিশেষ সুখ্যাতি অর্জন করেন। তিনি একজন খাঁটি আশেকে রাসুল (সাঃ) ছিলেন। তাঁর রচিত বিভিন্ন হামদ-না'তে তিনি নবী প্রেমকে অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় ফুঁটিয়ে তুলেছেন। চুনতির শাহ সাহেব আশেকে রাসুল (সাঃ) হযরত শাহ মাওলানা হাফেজ আহমদ (রাহ) এর অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন। তিনিও শাহ সাহেব হুজুরকে প্রাণাধিক ভাল বাসতেন এবং ওনার নির্মিত "মসজিদে বায়তুল্লাহ"এর দীর্ঘদিন খতিবের দায়িত্ব পালন করেন। নিখাদ এই ভালবাসার বহি:প্রকাশ ঘটিয়েছেন তাঁর দ্বিতীয় ছেলে তারেকের সাথে শাহ সাহেবের কনিষ্ঠা দৌহিত্রী জমিলার সাথে শুভ পরিণয়ের মাধ্যমে।

১৯৭৭থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত চুনতি মাদ্রাসায় লেখা-পড়ার সুবাদে লোহাগাড়ার স্থানীয় রাজনীতি, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব নিয়ে বিবাদ-বিসম্বাদ খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়। বিশেষ একটি গোষ্ঠী গোটা লোহাগাড়ায় একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে পুরো লোহাগাড়া উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ঐ সময়ে। সাধারণ জনগনের পক্ষ হয়ে যে ক'জন ব্যক্তি কায়েমী স্বার্থবাদীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান তম্মধ্যে মরহুম মাওলানা শফিক আহমদ (রাহঃ) ছিলেন মধ্যমণি। তবে পদুয়ার মরহুম এস.আই চৌধুরী, লোহাগাড়ার জিয়াউল হক চৌধুরী বাবুল, বড়হাতিয়ার মরহুম মাওলানা আব্দুল ওয়াহাব, এভোকেট হুমায়ুন কবির রাসেল সাহেবদের নাম উল্লেখ না করলে নয়। তিক্ত হলেও সত্য, স্বাধীনতা পরবর্তী দেশের অন্যান্য স্থানের মত সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার আলেম-ওলামারাও রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্ব -কর্তৃত্ব থেকে পিছিয়ে পড়েন। এমন নাজুক অবস্থায়ও মাওলানা শফিক আহমদ নিজের কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব ধরে রাখতে সক্ষম হন। অত্যন্ত দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মরহুম মাওলানা শফিক আহমদ (রাহঃ) কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত না থাকলেও স্থানীয় সাধারন জনগনের ব্যাপক সমর্থনে এসময়ে তিনি নিজস্ব একটি বলয় তৈরি করতে সক্ষম হন। চাষি শ্রেণী এবং নির্যাতিত-নিপীড়িত জনসাধারণের অভিভাবক হিসাবে তিনি ঐ সময়ে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন।অধিকার বঞ্চিত দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে শোষক শ্রেণীর হাত হতে রক্ষার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আপোষহীন। ১৯৭৫'র রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর অবিভক্ত সাতকানিয়ার একচ্ছত্র রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব লোহাগাড়ায় চলে আসে, যদিও তখনো লোহাগাড়া পৃথক উপজেলা হয়নি। তদানীন্তন সংসদ সদস্য মোস্তাক আহমদ চৌধুরী হয়ে ওঠেন ক্ষমতার মধ্যমণি। এসময় মাওলানা শফিক আহমদ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় তৎকালীন লোহাগাড়ার দোর্দণ্ড প্রতাপশালী রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন এবং শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান তৈরি করেন। ন্যায়ের প্রতীক হিসাবে তখনকার সময়ে স্থানীয়ভাবে "শফি মলইর লাঠি" বাক্যটি বহুল আলোচিত ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। খুব সম্ভব ১৯৭৮ সালের ঘটনা। আমি গারাংগিয়া নিজ বাড়ি থেকে আমিরাবাদ বটতলী হয়ে বাসে করে চুনতি মাদ্রাসায় আসতেছিলাম। বাসটি বিশাল লোহারদীঘি (যেটি আজ বিলুপ্ত) পর্যন্ত পৌঁছা মাত্র হঠাৎ যাত্রীদের নামিয়ে দেওয়া হয় সামনে দাঙ্গার ভয় দেখিয়ে। গাড়ি থেকে নেমে দেখি গাড়ির লম্বা লাইন। হেটেহেটে আধুনগর খানহাট সংলগ্ন ডলু খালের উপর নির্মিত লাল ব্রীজের কাছাকাছি দেখতে পাই ব্রীজের উত্তর পার্শ্বে মোস্তাক মিয়ার নেতৃত্বে লম্বা কিরিচ- লাঠি- বল্লম হাতে বিশাল উত্তেজিত জনতা। ব্রীজের দক্ষিণ পার্শ্বে মাওলানা শফিক সাহেবের নেতৃত্বে বিশাল লাঠিয়াল বাহিনী। এভাবে মাওলানা শফিক আহমদ তদানীন্তন সাতকানিয়া লোহাগাড়ার একচ্ছত্র অধিপতি মোস্তাক মিয়ার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন।

১৯৮৩ সালে লোহাগাড়া উপজেলায় সংখ্যালঘু অধ্যুষিত আধুনগর ইউনিয়নের সফল চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালীন মছদিয়ায় কবরস্থান বনাম শ্মশান দাবী নিয়ে মুসলমান ও বৌদ্ধদের মাঝে সৃষ্ট উত্তেজনা নিরসন এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অন্যন্য দৃষ্টি স্থাপনের পাশাপাশি গোটা লোহাগাড়া উপজেলার নির্যাতিত জনগণের পক্ষ হয়ে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে লোহাগাড়াবাসীর হৃদয়ের মণিকোটায় বিশেষ স্থান লাভ করেন। আশির দশকের শেষের দিকে বড়হাতিয়ায় ছিদ্দিক মিয়ার বলি খেলা ও গরুর লড়াইয়ের অন্তরালে মদ,জুয়া,হাউজিসহ অশ্লীল কর্মকান্ড বন্ধ করে বায়তুশ শরফের মরহুম পীর সাহেব আল্লামা আব্দুল জব্বার (রাহ:) এর নেতৃত্বে ঐ স্থানে "মাহফিলে জবলে সীরত"চালুর ক্ষেত্রে মাওলানা শফিক আহমদ সিপাহসালারের ভূমিকা পালন করেছিলেন।

তিনি লোহাগাড়া উপজেলার পশ্চিম কলাউজানের সম্ভ্রান্ত খতিব পরিবারের সাথে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর শ্বশুর ছিলেন প্রখ্যাত ওয়ায়েজ, হাফিজুল হাদিস খ্যাত আল্লামা মাহমুদুল হক খতিবী (রাহঃ), চুনতি হাকিমিয়া কামিল মাদ্রাসার প্রবাদপ্রতিম ওস্তাজ মাওলানা কামাল উদ্দিন মুছা খতিবী (রাহঃ)ছিলেন চাচা শ্বশুর এবং মরহুম প্রফেসর ড.মুহাম্মদ  আনওয়ারুল হক খতিবী( রাহঃ) এর একমাত্র ভগ্নিপতি। সম্পর্কে আমার দুলাভাই (মামাতো বোনের জামাতা)। একজন পুরুষকে সার্বিকভাবে সফল করে তুলতে পারিবারিক সুখ- শান্তি তথা স্ত্রীর ভূমিকা অপরিসীম। এ ক্ষেত্রেও মরহুম মাওলানা শফিক আহমদ স্বার্থক ছিলেন। বহু গুণে গুণান্বিতা ওনার মহিয়সী স্ত্রী আমাদের সকলের প্রিয় নিলু আপা(ডাক নাম)। একজন বিদুষী নারীর যতসব গুণ তার সবটা যেন আপার মাঝে সন্নিবেশ ঘটেছে। চলনে-কথনে এবং মেহমান নেওয়াজিতে আপার কোন তুলনা নেই। পিতৃকুলে "নিলু" এবং শ্বশুরালয়ে "ইকবালের মা" বহুল প্রশংসিত নাম।ছোট্ট কায়িকার এই মানুষটির পক্ষে ছয় ছেলে এক মেয়েকে মানুষ করার পাশাপাশি জমিদার পরিবারের আঞ্জাম দিয়ে সকলের মন জয় করা চাট্টিখানি কথা নয়। মহান আল্লাহর দরবারে রোগভোগ গ্রস্ত আপার হায়াতে তাইয়্যেবা কামনা করছি। 

পরিশেষে মরহুম আল্লামা শফিক (রাহ:) রুহের মাগফিরাত কামনা করে আমার ক্ষুদ্র প্রয়াসের ইতি টানলাম।

লেখক ঃ লেখক ও সাংবাদিক।