image

ভাসানচর পরিদর্শনে যাওয়া রোহিঙ্গা নেতারা নিরাপত্তা হুমকিতে

image

টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ সংলগ্ন শামলাপুর রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের হেড মাঝি নুর মোহাম্মদ জানিয়েছেন, তাকে মোবাইল ফোনে হুমকি দেয়া হচ্ছে। হুমকি দাতারা এও বলছে, ‘তুই কে? ভাসানচরে নিয়ে যাওয়াদের সরকারের কাছে তালিকা দেবার দায়িত্ব তোকে কে দিয়েছে? খবর আছে তর, এই দুনিয়ায় বেশি দিন ঠাঁই হবে না। আবার কথা হবে। হুমকি দেওয়া বিষয়ে এসব কথা বলেছেন তিনি।

নোয়াখালীর হাতিয়ার ভাসানচর পরিদর্শন শেষে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯ টার দিকে নৌবাহিনীর জাহাজে করে চট্টগ্রামে পৌঁছান রোহিঙ্গা নেতারা। পরে সেখান থেকে সেনাবাহিনীর নিরাপত্তায় রাতে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে পৌঁছায় ৪০ জন রোহিঙ্গা নেতা। তার মধ্যে দুই জন নারী সদস্যও ছিল। তবে তাঁরা কেউ ভাসানচরের বিষয়ে ক্যাম্পে কোন ধরনের প্রচারনা না চালালেও ক্যাম্পে ভাসানচর নিয়ে ‘গুজব’ ছড়ানোর খবর তাদের মুখে শুনা গেছে।

তবে, ভাসানচর পরিদর্শন যাওয়া রোহিঙ্গা নেতারা ক্যাম্পেই নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়ে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

এদিকে, সরকার ঘিঞ্জি শরণার্থী শিবির থেকে কমপক্ষে এক লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে মেঘনা নদী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় জেগে ওঠা ভাসানচরে পাঠানোর অংশ হিসেবে 'ভাসানচরে বসবাসের উপযোগী কি না, তা রোহিঙ্গা নেতাদের মাধ্যমে সরজমিনে পরির্দনের উদ্যোগ নেয়া হয়।

বাহারছড়া শামলাপুর রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের হেড মাঝি নুর মোহাম্মদ বলেন, ‘তার ক্যাম্পের চার জন রোহিঙ্গা নেতা ভাসানচরে ঘুরে এসেছেন। তাদের বিভিন্ন কৌশলে হুমকি ধমকি দিয়ে যাচ্ছে মোবাইলের মাধ্যমে। মঙ্গলবার রাত ১২টার পরে আবদুর শুক্কুর ওরফে হুজুর পরিচয় দিয়ে তাকে হুমকি দেয়, ভাসানচর নিয়ে ক্যাম্পে কোন ধরনের যেন প্রচারনা না চালায় তার মাঝিরা। ভাসানচরে যাতে সেখানে কোন মানুষ না যায়। না হলে পরিনতি ভাল হবেনা। 

তিনি বলেন, বুধবার রাতে আবার ফোন করবে উল্লেখ করে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন। 

শুক্কুর উখিয়া কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পের যে কোন একটি ক্যাম্পে বসবাস করছে তিনি ধারনা করছেন।

তিনি বলেন, গত বছর রোহিঙ্গাদের ভাসানচর ও প্রত্যাবাসনের সময় সরকারকে যথেষ্ট সহতায় করেছি। তাছাড়া সেইসময় উৎসাহিত করে তার ক্যাম্প থেকে স্বেচ্ছায় দেড়শ মানুষ ভাসানচরে যাবার জন্য রাজি করা হয়েছিল। তখনও এ ধরনের হুমকি ঝামেলায় পরতে হয়েছিল। মাঝিরা ভয়ে ফোন বন্ধ রেখেছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। 

উখিয়ার হাকিম পাড়ার শরণার্থী ক্যাম্পের হেড মাঝি হামিদ হোসেন। তিনি মিয়ানমারের মংডু মেরুল্লা পাড়ার বাসিন্দা। ২০১৭ সালে ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সেনাদের নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। তিনি ভাসানচরে দেখতে যাওয়া রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের টিম লিডার ছিলেন।

এই রোহিঙ্গা নেতা হামিদ হোসেন বলেছেন, ‘ভাসানচরের অবকাঠামো ও পরিবেশ সুন্দর। তবে সেখানে থাকার ঘরগুলো নিয়ে আমাদের দ্বিমত রয়েছে। আসার আগের দিন ভাসানচর নিয়ে মতামত চাওয়া হলে সবার পক্ষে থেকে বিষয়টি সেখানকার কর্মকর্তাদের তুলে ধরেছি। ক্যাম্পে ফেরার পর বুধবার পর্যন্ত ক্যাম্পে কোন ধরনের ভাসানচর নিয়ে প্রচারনা চালানো হয়নি। তাছাড়া এখানে আসার পর থেকে বিভিন্ন ধরনের ‘গুজব’ কানে আসছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের অবহিত করা হয়েছে।

এদিকে, অভিযোগ রয়েছে,কিছু এনজিও এবং আইএনজিও কৌশলে রোহিঙ্গাদের ভাসানচর না যেতে উৎসাহিত করছে। এতে যোগদিয়েছে আরসা ও আলেকিন নামের কিছু রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী। তারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পরিবেশ অস্থিতিশীল করতে মরিয়া।

শরণার্থী শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারি উর্চ্চ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ভাসানচর দেখে আসা রোহিঙ্গা নেতাদের হুমকি দিচ্ছে এই ধরনের কথা শুনা যাচ্ছে। বিষয়টি গুরুত্বসহকারে খতিয়ে দেখে আইনি প্রস্তুতি নেওয়া হবে।

ভাসানচর দেখে ক্যাম্প ফিরে টেকনাফের জাদিমুরা শরাণার্থী ক্যাম্পে হেড মাঝি বলেন, ভাসানচরের অবকাঠামো ও পরিবেশের সর্ম্পকে ক্যাম্পে প্রচারনা শুরু করা হয়নি। তাছাড়া ক্যাম্পে সিআইসিরাও এই বিষয় নিয়ে কিছু বলেনি। একই কথা বলেছেন ফিরে আসা আরও দুই রোহিঙ্গা নেতা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক রোহিঙ্গা নেতা বলেন, সত্যিই কথা বলতে মিয়ানমারে জেনোসাইড’র শিকার হয়ে বাংলাদেশে এসেছি। যেতে হলে মিয়ানমারে চলে যাব, ভাসানচরে নয়। আবার অনেকে মনে করেন তাঁরা এখন মিয়ানমারের কাছাকাছি আছেন। ভাসানচরে গেলে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবো। তাছাড়া অনেকের মাঝে ভয় কাজ করছে।
এর আগে, পরিদর্শনে যাওয়া রোহিঙ্গা নেতারা ভাসানচর থেকে বলেছিলেন, অবকাঠামো এবং সুন্দর পরিবেশ বিষয়ে ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের জানানো হবে। আমাদের চেষ্টা থাকবে, অন্তত প্রতিটি ক্যাম্প থেকে যেন স্বেচ্ছায় কিছু পরিবার ভাসানচরে যেতে রাজি হয়।

ভাসানচর দেখে ফিরে আসা রোহিঙ্গা নেতারা ক্যাম্পে এখনো প্রচারনা শুরু করেনি বলে জানিয়েছেন টেকনাফের জাদিমুরা ও শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (সিআইসি) মোহাম্মদ খালিদ হোসেন।

সংশ্লিষ্ট সুত্রে মতে, চারদিনের মাথায় ভাসানচর ঘুরে ৪০ জন রোহিঙ্গা নেতা কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের শরাণার্থী ক্যাম্পে পৌছান। এর আগে সেনাবাহিনীর মধ্যস্থতায় (৫ সেপ্টেম্বর) শনিবার টেকনাফ থেকে ভাসানচর পরিদর্শনে নিয়ে যায় সরকার। প্রতিনিধি দলটি চট্টগ্রাম হয়ে শনিবার বিকেল ৫ টার দিকে ভাসানচরে পৌঁছায়। তাদের জন্য বাংলাদেশ সরকার ভাসানচরে কি ধরনের ব্যবস্থা রেখেছে তা বর্ণনা করা হয়। এরপর তাদের (রবিবার ও সোমবার) দুই দিন পুরো আবাসন প্রকল্পের অবকাঠামো ঘুরিয়ে দেখানো হয়েছে। এসময় তাদের সঙ্গে নৌবাহিনী, পুলিশসহ আরআরআরসি কার্যালয়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। 

৮ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার রাতে তারা কক্সবাজারের স্বস্ব ক্যাম্পে পৌছেন।

প্রসঙ্গত, রোহিঙ্গা স্থানান্তরের জন্য নিজস্ব তহবিল থেকে দুই হাজার ৩১২ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসানচরে আশ্রয় প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে সরকার। জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাস থেকে সেখানকার ৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকা রক্ষা করতে ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ বেড়িবাঁধ এবং এক লাখ রোহিঙ্গা বসবাসের উপযোগী ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের এক সভায় ভাসানচরের জন্য নেওয়া প্রকল্পের খরচ ৭৮৩ কোটি টাকা বাড়িয়ে তিন হাজার ৯৫ কোটি টাকা করা হয়। বাড়তি টাকা বেড়িবাঁধের উচ্চতা ১০ ফুট থেকে বাড়িয়ে ১৯ ফুট করা, আনুষাঙ্গিক সুবিধা বৃদ্ধিসহ জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের জন্য ভবন ও জেটি নির্মাণে ব্যয় করার কথা রয়েছে।