image

মিরসরাইয়ে জঙ্গি আস্তানায় র‌্যাবের অভিযানে গোলাগুলি ও বিস্ফোরণ : ২লাশ উদ্ধার, আটক ২, রাইফেলসহ বোমা তৈরির বিপুল সরঞ্জাম উদ্ধার

image

দেশের অর্থনীতির লাইফলাইনখ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের মাঝামাঝিতে অবস্থিত জঙ্গি আস্তানায় র‌্যাবের অভিযানে গোলাগুলি ও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এসময় আতœঘাতী বোমায় নিহত হয় দুই জঙ্গি, আটক করা হয় বাড়ির মালিক ও কেয়ারটেকারকে। মিরসরাই উপজেলার জোরারগঞ্জ থানাধীন ৩ নম্বর জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর সোনাপাহাড় গ্রামের চৌধুরী ম্যানশনে এই ঘটনা ঘটে। বৃহস্পতিবার (৪ অক্টোবর) রাত ৩ টা থেকে ওই বাড়ীটি ঘিরে দীর্ঘ প্রায় ৮ ঘন্টা অভিযান চালায় র‌্যাব। অভিযানে রাইফেল, গ্রেনেডসহ বোমা তৈরির বিপুল সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়, উদ্ধার হওয়া একে-২২ রাইফেল গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্রের সাথে মিল রয়েছে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জানিয়েছেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশ ঘেঁষে গড়ে তোলা ওই বাড়িতে অবস্থান নিয়ে জেএমবির সদস্যরা চট্টগ্রামে বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা করে, তার মধ্যে চট্টগ্রাম আদালত ভবনও রয়েছে। অভিযান শেষে চৌধুরী ম্যানশনের ওই সেমিপাকা বাড়ি থেকে একটি একে-২২ রাইফেল, ৫ টি অবিস্ফোরিত গ্রেনেড, ৩ টি পিস্তল, গোলাবারুদ, কয়েকটি বই এবং বোমা তৈরির বেশকিছু সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। ওই বাড়ির মালিক মাজহার চৌধুরী ও কেয়ারটেকার হকসাবকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়। বাড়ির মালিক ঠিকাদারী ব্যবসা করেন, তিনি থাকেন জোরারগঞ্জ বাজারের পাশে সিলমা প্যালেস নামের একটি ভাড়া বাড়িতে। অভিযানে গোলাগুলিও বিস্ফোরণের কারণে বৃহস্পতিবার রাত ৩ টার সময় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়, তবে পুরাতন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে স্বাভাবিকভাবে যান চলাচল করে। ভোর ৪ টা ২২ মিনিটের সময় ওই বাড়িতে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটার পর গোলাগুলি বন্ধ হয়ে যায়। র‌্যাব বারবার মাইকিং করে জেএমবি সদস্যদের আতœসমর্পণের জন্য অনুরোধ করলেও তারা আতœসমর্পণ করেনি। বিস্ফোরণে বাড়ির টিনের ছাদ উড়ে যায়, নিহতদের লাশ ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে। পরে নিয়ন্ত্রিতভাবে আবার যানবাহন চলাচল শুরু হয়। ঢাকা থেকে সকাল ৯ টার সময় বোমা নিস্ক্রিকারী দলের সদস্যরা এসে বাড়ির ভেতরে ও বাইরে তল্লাশি চালিয়ে অস্ত্র ও বিস্ফোরক এবং ২ জন অজ্ঞাত পুরুষের ছিন্নভিন্ন লাশ উদ্ধার করা হয়।

র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, নারী জঙ্গিসহ জেএমবির ৪ সদস্য ওই বাড়িতে উঠেছিল বলে তাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য ছিল। তবে বাড়িতে ওঠার পর ওই নারী সেখান থেকে চলে যান। গত দুই মাসে বেশ কয়েকটি জঙ্গিবিরোধী অভিযান চালিয়ে র‌্যাব জানতে পারে, জেএমবির একটি গ্রুপ চট্টগ্রাম ও আশপাশের এলাকায় অবস্থান করছে এবং তাদের কাছে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ আছে। তারা একটি বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা করছে খবর পেয়ে ওই বাড়ি চিহ্নিত করে ঘিরে ফেলে র‌্যাব। র‌্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে বাড়িটির ভেতর থেকে জঙ্গিরা গুলিবর্ষণ করে এবং বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। পরে বেশ কিছুক্ষণ গোলাগুলি চলারপর ভোর ৪ টা ২২ মিনিটের সময় ভেতরে বিস্ফোরণ ঘটে, বিস্ফোরণে বাড়ির টিনের চাল উড়ে যায় এবং পুরো ভবনের ভেতর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। বোমা নিস্ক্রিয়কারী দলের সদস্যরা ঘটনাস্থলে তল্লাশি চালিয়ে দুইটি আইইডি (ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) পান, বাড়ির ভেতরে তল্লাশি চালিয়ে পাওয়া যায় আরও তিনটি আইইডি। বিস্ফোরকগুলো উদ্ধার করে বাড়ির পাশের খোলা জায়গায় বিস্ফোরণ ঘটান তারা। দুপুর দেড়টার সময় বাড়ি থেকে নিহতদের লাশ উদ্ধার করে প্রথমে জোরারগঞ্জ থানায় এবং পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্তের জন্য নেওয়া হয়।

জঙ্গিদের লক্ষ্য ছিল চট্টগ্রাম আদালতে নাশকতার, হলি আর্টিজানে হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্রের মিল : জঙ্গিদের লক্ষ্য ছিল চট্টগ্রাম আদালতে নাশকতা চালানোর। তাই তারা পরিকল্পনামাফিক সোনাপাহাড়ের চৌধুরী ম্যানশন ভাড়া নেন। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, চৌধুরী ম্যানশনে যেসব অস্ত্র ও বিস্ফোরক পাওয়া গেছে, তারমধ্যে একে টুয়েন্টিটু রাইফেল গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্রের মিল রয়েছে।

তিনি আরো বলেন, ইতিপূর্বে গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং র‌্যাবের বিভিন্ন উইংয়ের গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তারা চট্টগ্রামে জেএমবির একটি গ্রুপের সক্রিয় থাকার তথ্য জানতে পারেন। সেই তথ্যের ভিত্তিতেই সোনাপাহাড়ে অভিযান চালানো হয়। বাড়ি ভাড়া নেওয়া সবাই জেএমবির একটি গ্রুপের সদস্য। যাতায়াতের সুবিধার জন্য মহাসড়কের পাশে ওই বাসা ভাড়া নেয় জঙ্গিরা। খুব দ্রুত চট্টগ্রামে নাশকতার পরিকল্পনা করছিল তারা। কিছু ডকুমেন্টসও পেয়েছি। চট্টগ্রাম আদালতে তাদের নাশকতার পরিকল্পনা ছিল।

তিনি বলেন, জেএমবি একেবারে দেশ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান পরিচালনা করছে। তাদের কর্মকান্ড অব্যাহত আছে। হয়ত একসময় যেরকম সুসংগঠিত ছিল, নেতৃত্ব ছিল, সে অবস্থায় এখন নেই। সোনাপাহাড়ের ওই আস্তানায় অন্য যারা ছিল, তাদেরও খুঁজে বের করা হবে।

চাকুরির নাম করে ভাড়া নেন বাসাটি : ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ঘেঁষে গড়ে তোলা বাড়িটি নির্মিত হয় ৪ বছর পূর্বে। সেসময় বাড়িটির মালিক ছিল জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের ছদরমাদিঘী এলাকার সিরাজুল ইসলাম। সিরাজ তখন ওই বাড়িতে চোরাই তেলের ব্যবসা করতো বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। সিরাজুল ইসলামের কাছ থেকে প্রায় ১ বছর পূর্বে বাড়িটি কিনে নেন ইছাখালী ইউনিয়নের বাসিন্দা ঠিকাদারী ব্যবসায়ী মাজহার চৌধুরী। ৫ কক্ষ বিশিষ্ট চৌধুরী ম্যানশনের সেমিপাকা ভবনে সোহেল নামের এক যুবক তার স্ত্রী ও শ^াশুড়ীকে নিয়ে থাকবেন বলে গত ২৮ সেপ্টেম্বর ৩ টি কক্ষ ৫ হাজার টাকায় ভাড়া নেন এবং নাঈম নামের অপর একজন অপর দুইটি কক্ষ ভাড়া নেন। তারা বাড়িটি ঘেঁষে অবস্থিত বিএসআএম স্টীল মিল কারখানায় চাকুরি করে বলেই ভাড়া নেন। তবে অভিযানের সময় বাড়িতে ২ জন ছিল। বাকী সদস্যদের ব্যাপারে খোঁজ নেবেন বলে জানিয়েছে র‌্যাব। তবে বাড়ি ভাড়া দেওয়ার সময় ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র রাখা হয়নি বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে র‌্যাব কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন বাড়ির মালিক ও কেয়ারটেকার।

দেড়শতাধিক র‌্যাব সদস্য অংশ নেন অভিযানে : র‌্যাব-৭ চট্টগ্রাম ও ফেনী ক্যাম্পের দেড় শতাধিক সদস্য অভিযানে অংশগ্রহণ করেন বলে জানিয়েছেন র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান। তিনি জানান, রাত ৩ টা থেকে র‌্যাব সদস্যদের উপস্থিতি টের পেয়ে চৌধুরী ম্যানশনে অবস্থান নেওয়া জঙ্গিদের সাথে র‌্যাবের ব্যাপক গোলাগুলি হয়। ভোর ৪ টা ২২ মিনিটের সময় বিকট শব্দে বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। এসময় বাড়িটির টিনের ছাদ উড়ে যায়, ভবনটি বিধ্বস্ত হয়। পরে র‌্যাব সদস্যরা পুরো বাড়িটি ঘিরে রাখে।

যাতায়াতের সুবিধার্থে ভাড়া নেন বাসাটি : ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশ ঘেঁষে গড়ে তোলা সেমিপাকা বাড়িটি জেএমবির সদস্যরা ভাড়া নেন যাতায়াতের সুবিধার্থে। তবে বাসাটির পূর্বে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলনাইন ও পশ্চিমে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত হওয়ায় মহাসড়ক ও রেলপথ নিয়ে কোন নাশকতার পরিকল্পনা ছিল না সেবিষয়ে র‌্যাব কোন তথ্য জানায়নি। র‌্যাব জানায়, যাতায়াতের সুবিধার জন্য জোরারগঞ্জের ওই এলাকায় মহাসড়কের পাশে ওই বাসা ভাড়া নিয়েছিল জঙ্গিরা। বিএসআরএম স্টিল মিল ও বারইয়ারহাঁটের মাঝামাঝি এলাকায় মহাসড়কের পাশেই গড়ে উঠা বাসাটির নাম ‘চৌধুরী ম্যানশন’। গত মাসের শেষ দিকে ২ পুরুষ ও এক নারী মাসে ৫ হাজার টাকায় ওই বাসা ভাড়া নেয়। তাদের বয়স ২৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে।

বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে গুলির চিহ্ন : জেএমবির সদস্যদের আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণ এতই ভয়াবহ ছিল যে বিস্ফোরণের পর উড়ে যায় বাড়ির টিনের ছাদ, বাড়ির ভেতরের দেয়ালগুলো ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। দেয়ালে দেয়ালে রয়েছে গুলির চিহ্ন, জানালার কাঁচ ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়, খুলে পড়ে দরজাগুলো, আসবাবপত্র সবই ভেঙ্গে খানখান, দেখে মনে হবে এ যেন ধ্বংসস্তূপ। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পূর্ব পাশ ঘেঁষে বাড়িটির অবস্থান। বাড়ির মালিক মাজহার চৌধুরী ৫ কক্ষের বাড়িটি ভাড়া দিয়ে তিনি পার্শ্ববর্তী এলাকায় ভাড়া থাকেন।