image

উত্তপ্ত উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প : এক সপ্তাহে ২ বাংলাদেশী ও ৬ রোহিঙ্গাসহ ৮ খুন

image

আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে দীর্ঘদিন ধরে আরসা ও মুন্না গ্রুপের মধ্যে দফায় দফায় হামলা ও গুলিবর্ষণের ঘটনায় গত এক সপ্তাহে ২ বাংলাদেশী ও ৬ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষসহ ৮ জন নিহত হয়েছে। এতে আহত হয়েছে নারী-পুরুষ ও শিশুসহ অন্তত শতাধিক। এছাড়া ক্যাম্পের ২ শতাধিক ঝুপড়ি ঘর ও ৬৫ টি দোকান ভাঙচুর করেছে। এ নিয়ে ক্যাম্পে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে।পাশাপাশি স্থানীয় ও রোহিঙ্গাদের দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। 

মঙ্গলবার রাতে ক্যাম্প-২ ডব্লিউ -ডি-৩ ব্লক এলাকায় ফের দু,গ্রুপের সংঘর্ষে দুই বাংলাদেশীসহ ৪ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে কমপক্ষে অর্ধ শতাধিক।মঙ্গলবার রাতে এ ঘটনা ঘটেছে।নিহতরা হলেন,টেকনাফ উপজেলার হৃীলা পশ্চিম সিকদার পাড়া গ্রামের নুর হোসেনের ছেলে নুরুল হুদা,রঙ্গীখালীর গ্রামের দিল মোহাম্মদের ছেলে নুরুল বশর।দু,জনই নোহা গাড়ির চালক বলে পুলিশ জানিয়েছে।নিহত রোহিঙ্গারা হলেন,লম্বাশিয়া মর্গেজ পাহাড়ের মুন্না মাষ্টারের ভাই মোহাম্মদ উল্লাহ প্রকাশ(গিয়াস উদ্দিন)।একই ক্যাম্পের দিল মোহাম্মদের ছেলে ওমর ফারুক।

আহতদের কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের বিভিন্ন এনজিওর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।নিহতদের লাশ উখিয়া থানা পুলিশ উদ্ধার করে বুধবার দুপুরে ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে পেরণ করেছে।

গত (০১ অক্টোবর) বৃহস্পতিবার রাত ১২টা থেকে ভোর পর্যন্ত দু,গ্রুপের গুলাগুলি চলে। সকালে সমিরা আক্তার (৪১) নামের এক রোহিঙ্গা নারীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি হলেন কুতুপালং ৩ নম্বর ক্যাম্পের এফ ব্লকের মৃত ছৈয়দ আলমের মেয়ে।

রবিবার (৪ অক্টোবর) আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপে দফায় দফায় সংঘর্ষে দুই জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন।
ভোর ৪টার দিকে কুতুপালং ক্যাম্পের ২ ওয়েষ্ট এর ডি ৫ ব্লকের মৃত সৈয়দ আলমের ছেলে ইমাম শরীফ (৩২) ও ডি ২ ব্লকের মৃত ইউনুসের ছেলে শামসুল আলম (৪৫) এর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

গত (৫ অক্টোবর) রাত ১১ টা থেকে সোমবার ভোর পর্যন্ত আরসা ও মুন্না গ্রুপের মধ্যে এ সংঘর্ষ হয়। এতে মোহাম্মদ ইয়াছিন (২৪) নামে এক রোহিঙ্গা যুবক নিহত হয়। নিহত যুবক কুতুপালং ডি-৪, ২ ওয়েস্ট ক্যাম্পের মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে। কুতুপালং ক্যাম্পের আইন শৃংখলার দায়িত্বে নিয়োজিত ১৪ আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক আতিকুর রহমান ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

সর্বশেষ মঙ্গলবার (৬ অক্টোবর) রাতে কুতুপালং ক্যাম্পে দু’গ্রুপ রোহিঙ্গাদের মধ্যে আবারও সংঘর্ষে মাষ্টার মুন্নার ভাই গিয়াস উদ্দিন ও ওমর ফারুক ও দুই বাংলাদেশীসহ ৪ জন নিহত হয় এবংআনসার সদস্য আল আমিন গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হয়।তাকে উদ্ধার করে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করে সিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকে এ সংঘর্ষ শুরু হয় বলে জানা গেছে।

এছাড়া (০৬ অক্টোবর) মঙ্গলবার
সকালে টেকনাফের চাকমারকুল এলাকায় র‌্যাব-১৫ অভিযান চালিয়ে ধাওয়া করে ৯ জন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের অস্ত্র ও গুলিসহ গ্রেপ্তার করা হয়। কক্সবাজারস্থ র‌্যাব-১৫ এর উপ-অধিনায়ক মেজর মেহেদী হাসান ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, দিন দিন রোহিঙ্গারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি তারা চুরি, হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। শিবির থেকে বেরিয়ে স্থানীয়দের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটছে।

কুতুপালং রেজিস্টার্ড ক্যাম্পের চেয়ারম্যান হাফেজ জালাল আহমদ জানান, আরসা গ্রুপ ও মুন্না গ্রুপের মধ্যে সংঘটিত ঘটনায় প্রাণ বাঁচাতে দুই হাজারেরর অধিক রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু কুতুপালং ক্যাম্প ছেড়ে অন্য ক্যাম্পে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। বর্তমানে ক্যাম্পের অভ্যন্তরে দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। ক্যাম্পে থমথমে অবস্থা বিরাজ করায় রোহিঙ্গা শিবিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা টহল জোরদার বাড়িয়েছে।

কুতুপালং ২ নম্বর ক্যাম্পের হেড মাঝি সিরাজুল মোস্তফা বলেন, দুই গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনায় ছুরি ও লাঠির আঘাতে ককমপক্ষে শতাধিক আহত হয়েছে জানান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক রোহিঙ্গা জানান, ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে আরসা বাহিনীর রোহিঙ্গা নেতা মৌলভী আবু আনাস ও মো. রফিকের নেত্বত্বে মুন্না গ্রুপের মধ্যে দফায় দফায় গুলিবর্ষণ ও হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় সন্ত্রাসীরা কুতুপালং ই-ব্লকের ১০-১৫টি ঝুপড়ি ঘর ভাঙচুর করে। এর আগে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা একটি সিএনজি অটোরিকশাসহ ড্রাইভারকে দিন-দুপুরে অপহরণ করে ৪ লাখ টাকা দাবি করে।

উখিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। বিপুল এই জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করা অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এদিকে দেশি-বিদেশি দাতা সংস্থাগুলোর কারসাজিতে পরপর দুই বার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হওয়ায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ভুগছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। যেখানে রোহিঙ্গাদের এমন অপরাধ কর্মকাণ্ড ও সহিংস আচরণে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকেও ভাবিয়ে তুলেছে।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার শামসু দ্দৌজা জানান কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পে রেজিস্ট্রার্ড এবং আনরেজিস্ট্রার্ড কয়েকটি রোহিঙ্গা গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। ঘরবাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে তারা। সকালেই ঘটনাস্থলে পুলিশ টহল দিচ্ছে। পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের দায়িত্বরত ১৪নং এপিবিএনের ইন্সপেক্টর ইয়াছিন ফারুক বলেন, ‘নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের একটি গ্রুপের সঙ্গে অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মধ্যে আধিপত্য নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছে।

উখিয়া থানার ওসি আহাম্মদ সঞ্জুর মোরশেদ জানান, দুই গ্রুপে সংঘর্ষের ঘটনায় এই পর্যন্ত ৮ জনের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। সংঘর্ষের খবরে ঘটনাস্থলে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।এ ঘটনায় ৪ টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। 

উল্লেখ্য, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে অবস্থিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ ক্যাম্পের অভ্যন্তরে মাদক, দোকানসহ বিভিন্ন ইস্যু ও আধিপত্য নিয়ে একের পর এক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে। এতে করে স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।