image

দিন দিন বেপরোয়া-ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দারা : শঙ্কায় জনপদের মানুষ

image

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪ টি রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে প্রতি মাসে কোটি টাকার বেশী চাঁদাবাজির খবর পাওয়া গেছে।রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজিতে স্থানীয়রাও রেহায় পাচ্ছে না। চাঁদাবাজ সশস্ত্র সন্ত্রাসী চক্রের বিরোধীতাকারী কয়েক হাজার নিরীহ রোহিঙ্গা নিরাপত্তার অভাবে ক্যাম্পর বাইরে অবস্থান করছে বলে জানা যায়। এসব চাঁদাবাজির অর্থ দিয়ে এক শ্রেণীর সন্ত্রাসী রোহিঙ্গা উগ্রবাদীতার দিকে ঝুঁকে পড়ার আশংকা সংশ্লিষ্টদের।

দায়িত্বশীল বিভিন্ন সংস্থার মতে আরসা বা আল-ইয়াকিনের কোথাও অস্থিত্ব নাই।  এসব মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সৃষ্ট গুজব মাত্র। তবে বাংলাদেশ- মিয়ানমার সীমান্তবর্তী  মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আরকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি ‘আরসা’ বা আল-ইয়াকিনের তৎপরতার গুঞ্জন বহুদিনের। প্রতিটি রোহিঙ্গাদের মাঝে ঐ সন্ত্রাসী বাহিনী আতংক কাজ করছে বলে জানা গেছে।

গত কয়েকমাস ধরে টেকনাফ ও উখিয়ার রোহিঙ্গা শরনার্থী শিবিরে থেকে এসব কথিত সংগঠনের নামে জিহাদের কথা বলে রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে কোটি টাকার বেশী চাঁদা তুলেছে একটি চক্র। বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করে এই চাঁদা উত্তোলন করা হচ্ছে। এতদিন বিনা রশিদের মৌখিকভাবে চাঁদা আদায় করলেও সম্প্রতি রশিদ মূলে তারা আদায় করছে।

সূত্র মতে, সাধারণ রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে ফিতরা’র নামে,প্রবাসি, ক্যাম্পে বিভিন্ন সেবা সংস্থায় চাকুরীরত ও ব্যবসায়ী রোহিঙ্গা পরিবার থেকে যাকাত ও ফিতরা উভয়ের নামে চাঁদা আদায় করা হয়েছে। এছাড়া ক্যাম্পের হেড মাঝিদের কাছ থেকে মাসিক ৫ হাজার টাকা, ব্লকের সাধারণ মাঝিদের কাছ এক হাজার টাকা করে বাধ্যতামূলক চাঁদা নেয়া হচ্ছে।ক্যাম্পে আড়াই হাজারের মত মাঝি রয়েছে।তাঁদের কাছ থেকে জোরপূর্বক টাকা আদায় করেছে উক্ত চক্রটি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, গত রমজান মাসের শুরু থেকে শরনার্থী ক্যাম্পের অলিগলিতে কয়েকশো রোহিঙ্গা বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে প্রতিটি ক্যাম্পের ঘরে ঘরে গিয়ে ফিতরা এবং যাকাত আদায় করতে রোহিঙ্গাদের নির্দেশ দেয়। তাঁদের বেশিরভাগেই বয়স ৩০ থেকে ৪০ ঘরে। প্রত্যেক দলে কয়েকজন করে রোহিঙ্গা মৌলানাও ছিলেন। তাঁরা রোহিঙ্গাদের রক্ষায় বিচ্ছিন্নতাবাদী কথিত ঐ সংগঠনের গুরুত্ব ও কর্মকাণ্ডের কথা তুলে ধরেন।

মিয়ানমার সেনাদের বিরুদ্ধে রাখাইনে তথাকথিত জিহাদের জন্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ কিনতে ফিতরা ও যাকাতের টাকা দেয়ার নির্দেশ দেয়।প্রচারণায় নিয়োজিত সবাই নিজেদেরকে আল-ইয়াকিন বা আরসার সদস্য হিসেবে পরিচয় দেন। এভাবে২০ রমজান থেকে চাঁদা উত্তোলন শুরু করে আরসা বা আল-ইয়াকিনের সদস্য পরিচয় দেয়া সদস্যরা।এতে ব্যাপক সাড়াও দেন সাধারণ রোহিঙ্গারা।সব মিলে শরনার্থী শিবিরের ৩৪ ক্যাম্প থেকে কয়েক কোটি টাকা চাঁদা আদায় করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন বালুখালী এলাকার স্থানীয় নুরুল হক, হাজী মোহাম্মদ মিয়া, মোঃ জকরিয়া, আবু তাহের, মোঃ রফিক ও মোঃ আলমগীর বলেন, সম্প্রতি বালুখালী ১১ ও ১২ নাম্বার ক্যাম্পে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা আরো জানায়, ক্যাম্পের অভ্যন্তরে স্থানীয় লোকজনের যেসব দোকান-পাট রয়েছে তা থেকে ভাড়ার টাকা উত্তোলন করতে বাধা প্রধান করছে।

এ নিয়ে উর্ধতন সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছে স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন। উখিয়ার বালুখালী এলাকার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার নুরুল আবছার চৌধুরী বলেন, নিজের নিরাপত্তার অভাবে স্ব পরিবারে কক্সবাজার শহরে ভাড়া বাসায় থাকতে হচ্ছে। স্থানীয় চিহ্নিত একটি মহল রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করে নানা বেআইনি কার্যক্রম চালাচ্ছে।

নিরাপত্তার স্বার্থে নাম পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে অনেক রোহিঙ্গা জানান, ক্যাম্পের প্রত্যেক ব্লকে ব্লকে আরসার ট্রেনিং প্রাপ্ত সদস্যরা রয়েছে। অস্ত্রের যোগান হলে প্রশিক্ষণ প্রাপ্তদের মিয়ানমারে নিয়ে যায় নেতারা। এসব রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে নিয়ে গিয়ে প্রশিক্ষণ শেষে আবার ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হয়। চাঁদা আদায়ের বিষয়ে অনেক রোহিঙ্গা মনে করেন, তাঁরা রোহিঙ্গাদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে । তাই তাঁদেরকে ফিতরা ও যাকাতের টাকা দান করে থাকে রোহিঙ্গারা। কেউ যদি চাঁদা দিতে অস্বীকার করে তাহলে উপায় নেই চাঁদা দিতে হবেই বলে তারা জানান।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ক্যাম্পগুলোতে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে অন্তত ৮-১০ হাজার রোহিঙ্গা জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, শতাধিক দেশী-বিদেশী এনজিওতে নানা পদে মাসিক বেতনে চাকুরী করছে। নাইট গার্ড, ভলান্টিয়ার, স্বাস্থ্য কর্মী, পরিবার কল্যাণ কর্মী, নির্মাণ কর্মী,শিক্ষক,সুপারভাইজারসহ বিভিন্ন টেকনিক্যাল, নেন টেকনিক্যাল পদে মাসিক ১০ থেকে ৫০ হাজার টাকা বেতনে চাকুরী করে।

ক্যাম্প অভ্যন্তর ও সংলগ্নে ১০-১২ টি হাট বাজারসহ ক্যাম্পের অলি গলিতে ছোট,মাঝারী ও বড় দোকান রয়েছে অন্তত ৫-৬ হাজার, এসব চাকুরীজীবি,দোকান মালিক, ব্লক ও হেড মাঝি থেকে স্তরভেদে চাঁদা নির্ধারণ করা আছে। মাসে শুরুতে আল ইয়াকিনের ধার্য চাঁদা নির্দ্দিষ্ট লোকের কাছে পরিশোধ করতে হবে বাধ্যতামূলক ভাবে। নচেৎ অনাদায়কারীদের ওপর নেমে আসে চরম নির্যাতন, জুলুম।

৩৪টি ক্যাম্পে আল-ইয়াকিন পরিচয়ে চাঁদা আদায়ের আলাদা নেতৃত্বের কথা জানা যাচ্ছে। এদের কয়েকজন আল-ইয়াকিন নেতার পরিচয় পাওয়া গেছে।

এমন কয়েকজনের মধ্যে আল- ইয়াকিন চাঁদা কালেকশন গ্রুপের হেড- লিডার কুতুপালং -৮ ইষ্ট ক্যাম্পের মোঃ আবু বক্কর।তার নির্দেশমতো একই ক্যাম্পের, ব্লক- এ/৪২ এর হেডমাঝি আবু তাহের, ব্লক -বি/১৬ এর হেড মাঝি, মোঃ সেলিমসহ আরও কয়েকজন,ক্যাম্পের ৮ ওয়েষ্টে ৮৩ জন মাঝি এবং ক্যাম্প ৮ ইষ্টে ৮৯ জন প্রত্যেক মাঝির কাছ ধার্য্যকৃত জনপ্রতি ১ থেকে ৫হাজার টাকা করে চাঁদা তুলে আবুবক্করের কাছে জমা দিতে হয় বলে দাবি করেছে একটি সূত্র।

বালুখালী ১১ ও ১২ নাম্বার ক্যাম্পের ‘আরসা’র শীর্ষ নেতা মৌলভী আব্দুর রহমান (৫৫), একই ক্যাম্পের দোস মোহাম্মদ (৪০), জাকের হোসেন (৪২), মোহাম্মদ ইউনুছ (৩৫), মোঃ আলম (৩৭),নুর কামালসহ ৩০/৩৫ জন সংঘবদ্ধ গ্রুপ নিয়মিত ক্যাম্পের দোকান পাট হতে চাঁদা আদায় করে যাচ্ছে বলে জানা যায়।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ৩ বছরে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিরুদ্ধে ১২ ধরনের অপরাধে কমবেশি ৭৩১টি মামলা হয়েছে। যাতে আসামি হয়েছেন ১ হাজার ৬৭১ জন রোহিঙ্গা। এসব অপরাধের মধ্যে আছে- অস্ত্র, মাদক, ধর্ষণ, অপহরণ, বিশেষ ক্ষমতা আইন, পুলিশ আক্রান্ত, ডাকাতি বা ডাকাতির প্রস্তুতি, হত্যা, মানব পাচার ইত্যাদি। এর মধ্যে ৫৩টি খুন, ৪১০টি মাদক, ২৮টি মানব পাচার, ৫৯টি অস্ত্র, ৩৫টি ধর্ষণ ও ১০টি ডাকাতি এবং ১৬টি অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের মামলা উল্লেখযোগ্য। ২০১৭ সালে নানা অপরাধে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ছিল ৭৬টি আর আসামি হন ১৫৯ জন। ২০১৮ সালে ২০৮ মামলায় আসামি ৪১৪ জন। ২০১৯ সালে মামলার সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২৬৩টি আর আসামি হন ৬৪৯ জন। চলতি বছরের ২৫ আগস্ট পর্যন্ত রোহিঙ্গা অপরাধীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত ১৮৪ মামলায় আসামি ৪৪৯ জন।

উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প অধ্যুষিত পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, বিভিন্ন ক্যাম্পে আল ইয়াকিন সন্ত্রাসীরা চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন,গুম,মাদক পাচার ও ব্যবসাসহ গুরুতর অপরাধের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এ অবস্হা চলতে থাকলে ক্যাম্প অভ্যন্তরে ও সংলগ্ন এলাকায় স্থানীয়দের বসবাস করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ বলে তিনি জানান এসব ব্যাপারে ক্যাম্পগুলোর মাঝিদের বালুখালী ১১নং ক্যাম্পে দায়িত্বরত এপিবিএন’র ইন্সপেক্টর জাকের হোসেন বলেন, ক্যাম্প থেকে আরসা’র নামে টোকেন বা রশিদের মাধ্যমে চাঁদা আদায়ের ব্যাপারে অবগত নই। তবে এখন থেকে এ বিষয়ে খোঁজ খবর নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।

উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ আহমেদ সনজুর মোরশেদ বলেন, পূ্র্বে কোন অভিযোগ দায়ের করে থাকলে অবশ্যই তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এ সম্পর্কে নতুন কোন অভিযোগ হাতে আসে নাই বলে জানান তিনি।