image

খালেদা-তারেক দলীয় পদও হারাচ্ছেন !

image

দণ্ডিত বা দুর্নীতিপরায়ণ কোনো ব্যক্তি বিএনপির কোনো পদে থাকতে পারবেন না—এমন বিধান বাতিল করে দলটি যে সংশোধিত গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করেছে, তা গ্রহণ না করতে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। দলটির সংশোধিত গঠনতন্ত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দাখিল করা এক রিট আবেদনে বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল বুধবার এ নির্দেশ দিয়ে রিটটি ৩০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তির আদেশ দেন। এ আদেশের ফলে একাধিক মামলায় দণ্ডিত খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের যথাক্রমে বিএনপির চেয়ারপারসন ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান পদে থাকা অনিশ্চিত হয়ে পড়ল।

আইনজীবীরা বলছেন, হাইকোর্টের এ নির্দেশ মানতে বাধ্য ইসি। ফলে ইসি বিএনপির সংশোধিত গঠনতন্ত্র গ্রহণ না করলে বা বাতিল করে দিলে বিএনপির কোনো কমিটিতে দণ্ডিত কোনো ব্যক্তি থাকতে পারবেন না। আর এ কারণেই বিএনপি চেয়ারপারসন কারাবন্দি খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন হিসেবে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলটির কোনো পদে থাকতে পারবেন না বলে অভিমত আইন বিশেষজ্ঞদের। তাঁরা বলছেন, হাইকোর্টের এ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ রয়েছে বিএনপির। বিএনপি যদি আপিল করে এবং আপিল বিভাগ হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করেন, সে ক্ষেত্রে খালেদা জিয়া বা তারেক রহমানের দলের শীর্ষ পদে থাকতে কোনো সমস্যা হবে না। আর যদি দলটি কোনো স্থগিতাদেশ না পায়, তবে তাঁরা পদে থাকতে পারবেন না। আইনজ্ঞরা বলছেন, সংবিধান অনুযায়ী নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দুই বছরের বেশি সাজাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি নির্বাচনের অযোগ্য। এ কারণেই দণ্ডিত কোনো ব্যক্তির বিএনপির পদে রাখার উদ্দেশ্যে দলটির গঠনতন্ত্রে সংশোধনী আনা দেশের সংবিধানের পরিপন্থী।

উল্লেখ্য, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার যথাক্রমে ১০ ও সাত বছর কারাদণ্ড আর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও একটি অর্থপাচার মামলায় তারেক রহমানের যথাক্রমে যাবজ্জীবন ও সাত বছরের কারাদণ্ড হয়েছে।

সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘হাইকোর্টের আদেশটি যথাযথ হয়েছে বলে মনে করি। কারণ আমাদের সংবিধানের ৬৬(২)(ঘ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নৈতিক স্খলনজনিত কারণে যদি কারো দুই বছরের বেশি সাজা হয়, তাহলে সাজা ভোগ করার পর আরো পাঁচ বছর তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না।’ তিনি বলেন, ‘দেশের সর্বোচ্চ আইন হলো সংবিধান। দেশের সংবিধানে যেখানে দণ্ডিত ব্যক্তিকে নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে, সেখানে একটি বড় রাজনৈতিক দলের পদে কিভাবে দুর্নীতিবাজ বা সাজাপ্রাপ্তরা থাকতে পারেন, তা বোধগম্য নয়। এটা নৈতিকতা পরিপন্থী। দুর্নীতিবাজদের রাখার জন্য কোনো রাজনৈতিক দল হতে পারে না। এ কারণেই মনে করি, হাইকোর্ট যথাযথ আদেশ দিয়েছেন। তবে এ আদেশের বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই বিএনপি বা সংক্ষুব্ধ পক্ষ আপিল বিভাগে যাবে। আর আপিল বিভাগ যদি হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করেন, তবে পদে থাকতে বাধা থাকবে না।’

রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, দণ্ডিত কেউ দলের পদে থাকতে পারবে না—এটাই স্বাভাবিক। দুনিয়ার সব রাজনৈতিক দলের এটাই নৈতিক মানদণ্ড। বিএনপির গঠনতন্ত্রে সেটাই তো ছিল। এখন এটা যদি পরিবর্তন করা হয়, দণ্ডিত বা সাজাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তিকে রাখতে রাজনৈতিক দলের পক্ষে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া খুবই অনভিপ্রেত। তাই সংশোধিত বা পরিবর্তিত গঠনতন্ত্র যাতে ইসি গ্রহণ না করে সে জন্য সঠিকভাবেই নির্বাচন কমিশনের প্রতি নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। সংশোধিত গঠনতন্ত্র গ্রহণ করার অর্থ হবে দুর্নীতির সঙ্গে আপস করা। ইসি একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান তো এ রকম কোনো কিছু গ্রহণ করতে পারে না। তিনি বলেন, এই সংশোধিত গঠনতন্ত্র যদি ইসি গ্রহণ না করে তাহলে সাজাপ্রাপ্তরা দলটির কোনো পদে থাকতে পারবে না।

তবে হাইকোর্টের আদেশ সম্পর্কে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন কালের কণ্ঠকে বলেন, বিএনপি একটি রাজনৈতিক দল। এটা কোনো সরকারি দল বা সরকারি বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান নয়। তাই একটি রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্রের বিরুদ্ধে কোনো রিট আবেদন করার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, ‘যখন আইনজীবীদের আদালত বর্জন চলছে তখন সরকার সমর্থক আইনজীবী আদালতে রিট আবেদন নিয়ে গেছেন এবং আদালত থেকে একতরফাভাবে আদেশ নিয়ে গেছেন। তিনি বলেন, এখন লিখিত আদেশ ও রিট আবেদনের কপি সংগ্রহ করব। এরপর আইনগতভাবে যে যে পদক্ষেপ নিতে হয়, তার সবই নেওয়া হবে।’

নির্বাচনী আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক কালের কণ্ঠকে বলেন, একটি রাজনৈতিক দলের পদে নায়ক বা জেলে বা কৃষককে নেবে কি না, সেটা সেই দলের গঠনতন্ত্রের ব্যাপার। এ রকম রাজনৈতিক বিষয় আদালতে টেনে আনা উচিত নয়। কারণ হলো, রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আদালত যদি কোনো পক্ষে বা বিপক্ষে আদেশ দেন তবে তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠতে পারে। এতে আদালত বিতর্কিত হন। আদালতের প্রতি মানুষের আস্থা কমে। এ জন্যই রাজনৈতিক প্রশ্নে মামলা হলে আদালতেরও তা গ্রহণ করা উচিত নয়। তবে তিনি বলেন, দেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো কিছু কোনো রাজনৈতিক দলে থাকতে পারে না। রাখাটাও উচিত না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিএনপির সংশোধিত গঠনতন্ত্র গ্রহণ না করতে এবং এ বিষয়ে রিটকারীর আবেদনটি ৩০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হাইকোর্ট যে নির্দেশনা দিয়েছেন তা গতকাল পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনে পৌঁছেনি। নির্বাচন কমিশন সচিব গতকাল সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা টিভি চ্যানেলগুলোসহ সংবাদমাধ্যমে এ নির্দেশের কথা জেনেছি। কিন্তু আদেশের কোনো অনুলিপি পাইনি। অনুলিপি না পাওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা যাচ্ছে না।’

রিটকারী আপনাদের কাছে যে আবেদনটি করেছিলেন সেটি প্রসঙ্গে এক প্রশ্নে সচিব বলেন, ‘প্রতিদিনই নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রচুর আবেদন আসে। আদালতের নির্দেশ জানার পর ওই আবেদনটি খুঁজে বের করা হয়েছে।’

এদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের আইন শাখা হাইকোর্টের নির্দেশের বিষয়টি সম্পর্কে করণীয় নির্ধারণের জন্য ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করেছে।

বিএনপির কোনো পদে থাকার অযোগ্যতা প্রসঙ্গে দলটির গঠনতন্ত্রের ৭ নম্বর ধারায় ছিল, ‘নিম্নোক্ত ব্যক্তিগণ জাতীয় কাউন্সিল, জাতীয় নির্বাহী কমিটি, জাতীয় স্থায়ী কমিটি বা যেকোনো পর্যায়ের যেকোনো নির্বাহী কমিটির সদস্যপদের কিংবা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের প্রার্থীপদের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। তাঁরা হলেন : (ক) ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশ নম্বর ৮-এর বলে দণ্ডিত ব্যক্তি। (খ) দেউলিয়া, (গ) উন্মাদ বলে প্রমাণিত ব্যক্তি, (ঘ) সমাজে দুর্নীতিপরায়ণ বা কুখ্যাত বলে পরিচিত ব্যক্তি।’

কিন্তু বিএনপি এই ব্যবস্থা বাতিল করে গঠনতন্ত্রের ৭ নম্বর ধারা সংশোধন করে তা গত ২৮ জানুয়ারি ইসিতে দাখিল করে। সংশোধিত ৭ নম্বর ধারায় বলা হয় ‘কমিটির সদস্যপদের অযোগ্যতা/বিলুপ্ত হবে।’ আট পৃষ্ঠার ওই সংশোধনী প্রস্তাবের বিষয়ে দলীয় চেয়ারপারসন ও কাউন্সিল অধিবেশনের সভাপতি হিসেবে খালেদা জিয়া ইসিতে পাঠানো চিঠিতে বলেন, ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির কাউন্সিলে এসব সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে। চিঠিতে আরো বলা হয়, উপরোক্ত সংশোধনীগুলো কাউন্সিলের অনুমোদনের জন্য উত্থাপন করা হলে কাউন্সিল সর্বসম্মতিক্রমে তা অনুমোদন করে। একই সঙ্গে কাউন্সিলের গৃহীত সংশোধনী অনুযায়ী অনুচ্ছেদ ও উপ-অনুচ্ছেদগুলোর ক্রমিকের অনিবার্য পরিবর্তন, ভাষা ও ছাপার ভুলগুলো সংশোধন করার প্রস্তাবও কাউন্সিলে অনুমোদিত হয়।

বিএনপির সংশোধিত এই গঠনতন্ত্র যাতে গ্রহণ না করা হয় সে জন্য গত ৩০ অক্টোবর ইসিতে আবেদন করেন রাজধানীর কাফরুলের বাইশটেকীর বাসিন্দা মো. শাহ আলম মিয়ার ছেলে মো. মোজাম্মেল হোসেন। তিনি নিজেকে বিএনপির কর্মী দাবি করে এ আবেদন করেন। ইসি ওই দিন দুপুর পৌনে ২টায় এ আবেদন গ্রহণ করে। এরপর একই দিন হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিট আবেদন (রিট নম্বর ১৩৫৬৮/২০১৮) করেন তিনি। রিট আবেদন দাখিলকারীর আইনজীবী হলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাবেক সদস্য ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মমতাজউদ্দিন আহমদ মেহেদী। গতকাল বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চে তিনি শুনানি করেন। এরপর আদালত ওই আদেশ দেন।

এ সময় রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আল আমিন সরকার ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল কে এম মাসুদ রুমি। আদালতের আদেশে মোজাম্মেল হোসেনের আবেদন ৩০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দেওয়া হয়। এই আবেদন নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বিএনপির সংশোধিত গঠনতন্ত্র গ্রহণ না করতে ইসিকে নির্দেশ দেন; একই সঙ্গে রুল জারি করেন আদালত। রুলে দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত ব্যক্তি পদে থাকতে পারবেন না—এমন বিধান বাদ দেওয়া কেন বেআইনি হবে না এবং সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। স্থানীয় সরকার সচিব, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশন সচিব, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও মহাসচিবকে চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী, রাজনৈতিক দল হিসেবে ইসিতে নিবন্ধিত হওয়ার সময়ই দলীয় গঠনতন্ত্র জমা দিতে হয়। আর সংশোধন করা হলে তা-ও ইসিকে জানানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কোনো দলের গঠনতন্ত্র বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না, তা দেখার দায়িত্ব ইসির।

উৎসঃ   কালের কন্ঠ