শিরোনাম
মালেক রানা, কর্ণফুলী সংবাদদাতা | ০১:৫৫, মে ১৮, ২০১৯
দিনে কম রাতে বেশি। চট্টগ্রামে সুকৌশলে সরকারি পদ্মা, মেঘনা, যমুনাসহ বহু কোম্পানির হাজার হাজার লিটার তেল চুরি হচ্ছে। এসব অপরিশোধিত সয়াবিন তেল’কে স্থানীয় ভাষায় পিলাই তেল হিসেবে চিনে। কর্ণফুলীর বিভিন্ন ঘাট ও ডিপোতে অনুসন্ধানকালে এসব তথ্য উঠে এসেছে ।
বহমান নদীর দুপারের স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে বছরের পর বছর চোরাই পথে লোপাট করা হচ্ছে সরকারি তেল। আর এর মাধ্যমে বিপুল সম্পদশালী হয়ে উঠেছে চোরাকারবারীরা ও গুটিকয়েক ক্ষমতাসীন দলের লোভী নেতাকর্মী। যা প্রশাসন ও দুদকের ধরা ছোয়ার বাহিরে।
এদের কেউবা সেজেঁছে মাছ ব্যবসায়ী, আর কেউবা তেল ব্যবসায়ী । খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এরা সামান্য ডিজেল ও কেরোসিন ব্যবসার গ্রাম্য লাইসেন্স নিয়ে নদীতে থাকা জাহাজ ও ডিপো থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার লিটার তেল চুরি করছে। যা পরে মজুদ রেখে ট্রাক/ভাউচারে পাচার করে বিক্রি করছে।
এমনকি রাতের আধারে তেল চুরির আড়ালে বিভিন্ন মাদক, বিয়ারসহ বিদেশি চোরাই পণ্য খালাস করার কথাও জানান নাম প্রকাশ না করা অনেক সাম্পান চালক ও ঘাটশ্রমিক। এসব কাজের জন্য নাকি তাদের গড়ে উঠেছে একটি বিশাল বাহিনী ও সিন্ডিকেট। যে সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত স্থানীয় অনেক এমপির এপিএস হতে শুরু করে প্রভাবশালী লোকজন। যাদের কোনো সুনির্দিষ্ট বৈধ ব্যবসা বানিজ্য না থাকলেও দিনে দিনে বনে যাচ্ছে বিপুল বিত্ত বৈভবের মালিক। যেন আলা দিনের আশ্চর্য্য চেরাগ তাদের হাতে।
তথ্য পাওয়া যায়,নদীতে সক্রিয় থাকা এসব চোরাকারবারীরা বাড়ি,গাড়ি, মিল কারখানার পাশপাশি মাটির নিচে স্থাপন করেছে চোরাই তেলের গোপন ডিপো। আরো জানা যায়, গড়ে ওঠা এসব সিন্ডিকেট নাকি খুলনার কুখ্যাত এরশাদ সিকদারের চেয়েও ভয়ংকর। তাদের বিরুদ্ধে ভয়ে কেউ মুখ খোলার সাহস করেন না। প্রচলন রয়েছে, তাদের এই ক্ষমতার পেছনে ইন্ধন যোগাচ্ছে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী নেতা ও প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারা। যাদের যোগসাজেশ ও আশ্রয় প্রশ্রয়ে রুটিন মাফিক তেল চুরি হচ্ছে বলে বন্দর এলাকা, কর্ণফুলীর জুলধা, ডাঙ্গারচর, শিকলবাহা সহ চরপাথরঘাটার একাধিক সাধারণ মানুষের অভিযোগ।
এসব চোরাকারবারি চক্রের অন্যতম সদস্য হিসেবে যাদের নাম উঠে এসেছে তাদের মধ্যে অন্যতম হল, আব্দু শুক্কুর প্রকাশ ডাকাত শুক্কুর, মো. ইউনুস, মো. ইলিয়াছ, আলি আহমেদ, মো. সেলিম, জানে আলম, সোর্স মো. জহুর, মো. নাছির, সোর্স মো. ইউসুফ, মো. জাফর, মনির আহমেদ, মো. তাহের, মুহাম্মদ কায়সার ,আব্দুল মন্নান, মো. মুছা, মো. হাসান, মো.ইসমাঈল সহ প্রমুখ।
স্থানীয় পর্যায়ে প্রচলিত আছে, ২০০৫ সালের আগে স›দ্বীপ চ্যানেলে ডাকাতি ও কর্ণফুলী নদীতে জলদস্যুতা করে শুক্কুর বনে যান নামকরা ডাকাত। এর পর থেকে তাকে অনেকে চেনে ‘মাদারি শুক্কুর’, ‘ডাকাত শুক্কুর’ ও ‘জলদস্যু ত্রাস শুক্কুর’ নামে। তার নামের পাশে নতুন বিশেষণ ‘চোরাকারবারি তেল চোর শুক্কুর’। এখন কর্ণফুলী নদীতে একচেটিয়া রাজত্ব তার।
এদের বেশির ভাগ কারবারির বাড়ি চট্টগ্রাম বন্দর এলাকা এবং কর্ণফুলী এলাকার বলে জানা যায়। অনেকের নাম আবার বেসরকারি টিভি চ্যানেল যমুনা টেলিভিশনের ‘৩৬০ ডিগ্রি’ অনুষ্ঠানে প্রচারিত হয়, যার ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ভাইরাল হয়।
অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য মতে, এসব তেল চোরাকারবারীদের সবচেয়ে বড় আস্তানা রয়েছে জুলধা ইউনিয়নের ডাঙ্গারচর ৯ নং ঘাটে। বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তেল কোম্পানী পদ্মা, মেঘনা, যমুনার তেলের পাইপ ছিদ্র করে প্রতিদিন রাতে বিপুল পরিমাণ তেল সেখানে মজুদ করা হয়। রাতে মাদক ও তেল পাচারের সহায়ক নৌ-যান হিসেবে যাদের রয়েছে নিজস্ব নৌকা আর স্পীডবোট। এসব অপকমের্র মূল সহায়তাকারী হিসেবে উল্লেখিত কোম্পানির নাইট গার্ড ও কতিপয় কর্মচারীর কথা উঠে এসেছে। এমনকি সিন্ডিকেটে নিয়ন্ত্রিত চক্রটি দেশীয় লাইটারেজ জাহাজ ও বিদেশি তেলের জাহাজ থেকেও টলিযোগে তেল চুরি করে তাদের নিজস্ব তেলের ডিপোতে মজুদ করেন। পরে এসব চোরাই তেল ঢাকা, নারায়নগঞ্জের বিভিন্ন খাদ্য ফ্যাক্টরী, পটিয়ার শান্তিরহাট, কক্সবাজার ও কর্ণফুলী এলাকার বিভিন্ন তেলের দোকানে বিক্রি করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
যেসব উল্লেখযোগ্য জাহাজ হতে তেল চুরি হচ্ছে বলে নাম এসেছে সেসব হলো-রাজা শাহ সিটি জাহাজ,শবনম টু,শবনম থ্রি,শবনম ফোর, সিটি ফোর, সিটি সেভেন,সিটি নাইন, পদ্মা ১৩-১৪-১৫, রবিন জাহাজ, যমুনা ১৩-১৪-১৫, পিপলস ওয়ান, পিপলস টু, যমুনা -১৭, ফ্রেশ ১৬-১৮-১৯-৩১ ইত্যাদি।
তথ্য পাওয়া যায়, এসব অবৈধ তেল ব্যবসায়ীদের একমাত্র সম্বল স্ব স্ব এলাকার কমিশনার/চেয়ারম্যান কতৃক প্রদত্ত দ্্ুইশ টাকার ট্রেড লাইসেন্স কিংবা ডিজেল বিক্রির অনুমোদিত কপি। এ ছাড়া সরকার তাদের হাজার হাজার লিটার তেল বিক্রির কোন লাইসেন্স দেননি। চোরাকারবারীদের দৃশ্যমান কোন বৈধ ব্যবসা বানিজ্য না থাকলেও চোখের সামনে এরা চুরি করা পিলাই তেল বিক্রি করে বনে গেছেন কোটি কোটি অর্থ বিত্তের মালিক।
এমনও কথা শোনা যাচ্ছে, ঘাটে ঘাটে পয়সা দিয়ে দিনে ১০ লাখ টাকার সরকারি তেল চুরি করছে এসব সিন্ডিকেট। কিন্তু প্রশাসন দেখেও দেখছে না। দুদকও এখনো যেতে পারেনি তাদের গড়া অবৈধ সম্পদের নাগালে।
স্থানীয় সূত্রে জানায়, প্রতিটি ঘাটে ঘাটে প্রশাসন তাদের সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে। ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও প্রশাসনকে মাসিক চাঁদার পরিমান নাকি ১৬ লক্ষ টাকা প্রায়। যার একটি অংশ, চট্টগ্রাম শহরের প্রভাবশালী এক নেতা, বন্দর এলাকার হর্তাকর্তা, এপিএস খ্যাত তিন ব্যক্তি, দলীয় পদে থাকা কর্ণফুলী উপজেলার কয়েকজন নেতাকর্মী, বন্দর, ইপিজেড , কর্ণফুলী এলাকার স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করেন। এছাড়াও পটিয়া এবং চট্টগ্রামের কিছু আঞ্চলিক পত্রিকার বির্তকিত গণমাধ্যমকর্মীর পকেটেও নাকি মাসিক মাসোহারা প্রবেশ করে বলে সুত্রে জানায়।
চোরাকারবারি ব্যবসার সাথে মাদক সহ নানা জাহাজি পণ্য চুরি তার সাথে মানবপাচারের মতো নানা অভিযোগ উঠেছে এ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। এক তথ্যে জানা যায়, প্রতি মাসে শহরের আগ্রাবাদের একটি বিলাস বহুল হোটেল ও পতেঙ্গা বোট ক্লাবে ক্ষমতাসীন দলের পদে থাকা নেতাদের নিয়ে বিলাসি আড্ডার ফাঁকে মাসোয়ারার হিসাব মিটিয়ে নেয়।
এলাকাবাসী অভিযোগে আরো জানায়, ডাকাত শুক্কুর আজ জিরো হতে হিরো। অবৈধ চোরাকারি করে বিপুল সম্পত্তির মালিক ও বিলাসবহুল কয়েকটি বাড়ি সহ জমিজামার দখল-বেদখল বানিজ্য করে টাকার কুমির বনে যায়।
যে নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে চট্টগ্রামের সম্পুর্ন চোরাকারবারী ব্যবসা। যার রাজত্ব কায়েম চলছে কর্ণফুলী নদী আর সাগর চ্যানেলে। গড়ে তোলেছেন টাকার পাহাড়। ধরাকে সরা জ্ঞান করে।কিছু প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের হাত করে। যা নিয়ন্ত্রণ না থাকায় দিন দিন বেপরোয়া হচ্ছে এসব চোরাকারবারীরা। ফলে বছর শেষে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তেল কোম্পানীগুলো লোকসানে পড়ছে। এসব লোকসান উত্তরণে জরুরী প্রশাসনের সুনজর প্রত্যাশা করেছে অনেক সচেতন নাগরিক।
Developed By Muktodhara Technology Limited