image

আজ, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ইং

হ্যালারের বাণী

সানোয়ার হোসাইন সানি    |    ১৩:৩৯, এপ্রিল ৭, ২০২০

image

সারাদিন ডিউটি সেরে, পোষাক খুলে মাত্র ফ্রেশ হচ্ছিলাম,বারটি ছিল শুক্রবার।যদিও শুক্র-শনি বা বড়দিন পুলিশের জন্য আবার বন্ধ বলতে কিছু নেই-গল্পের শুরুটা ওইদিন রাতে ৮টায়।
কোন এক শুক্রবার রাত ৮টার দিকে বড়কর্তার ফোন এলো 
তাড়াহুড়া কন্ঠেঃ-সানোয়ার, তুমি কোথায়? 
-স্যার, আমি বাসায়।বলেন স্যার কি করতে হবে? 
আবারঃ- তুমি বাসায় কি করো?!
আবারো স্যারঃদেশের খোঁজ-খবর কি কিছু রাখ না নাকি?
-স্যার, আমি….!!তখনই বুঝতে বাকি নেই কিছ একটা হয়েছে,বের হতে হবে!
- তোমাকে কেউ 'অমুক' জায়গার ঘটনা জানায়নি? 
- না তো স্যার। কি হয়েছে? 
- এক হারামজাদা নাকি সুইসাইডাল বোম্ব ব্লাস্ট করে মরে পড়ে আছে। তুমি এক্ষুনি টিম নিয়ে সেখানে চলে যাও। আমিও আসতেছি। 

তৎক্ষনাৎ ঘটনাস্থলে দ্রুত ছুটে গেলাম। হাজার হাজার মানুষের ভীড়ে পুরো এলাকা ভিন্ন রূপ নিয়েছে। ক্রাইমসীনে ঢুকতে আমাদের বেশ বেগই পেতে হলো। অনেক কষ্টে ভিতরে ঢুকে দেখি ব্যস্ত রাস্তার পাশে ওয়াক-ওয়ের উপর এক (সুইসাইডাল) জঙ্গির দ্বিখণ্ডিত লাশ পড়ে আছে। গণমাধ্যমকর্মীরা ছবি নিচ্ছে, কেউ কেউ লাইভ দিচ্ছে, পুলিশ ক্রাইমসীন পাহারা দিচ্ছে ইত্যাদি। শতশত উৎসুক জনতাও লাশের ছবি নিচ্ছে,  আবার কেউ কেউ সেল্ফিও তুলছে। সব মিলিয়ে সে এক বিশাল কান্ডকারখানা! 

যাহোক, শুরু করলাম ক্রাইমসীন সিকিউর করে আলামত রক্ষার পালা। লাশটি একটি কাপড় দিয়ে ঢেকে দিলাম। তার পেটে বাঁধা বিস্ফোরিত  সুইসাইডাল বোমার আলামত মার্কিং করতে লাগলাম। সেটা করতে গিয়ে প্রায় হাজার খানেক মানুষের ভীড় ২০ গজ দূরে ঠেলে দিতে হলো। তাতে ২৫-৩০ জন আর্মড পুলিশের ৩০ মিনিট (আনুমানিক) সময় লেগে গেল। তবুও যেন অনেকের ছবি তুলা শেষ হচ্ছিল না! 

প্রটোকল অনুসারে বিদ্যুতের লাইন বন্ধ করে টর্চ লাইটের আলোতে অ্যাক্টিভ সেকেন্ডারি ডিভাইস খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু না, তেমন কিছুই নজরে এলো না। চারিদিকে শুধুই বিস্ফোরিত সুইসাইডাল বোমার (ভেস্টের) ধ্বংসাবশেষ। স্বস্তি নিয়ে পরবর্তী কার্যক্রম শুরু করা ঠিক পুর্ব মুহূর্তে একটি জিনিস নজরে পড়ে গেল। একটি বড় সাইজের লাগেজ লাশের অবস্থান থেকে প্রায় দুই মিটার দূরে পড়ে আছে। লক্ষ্য করে দেখলাম, লাশ আর লাগেজের মাঝখানের জমিনে অঙ্কিত হয়ে আছে লাগেজের ডিপ স্ক্র‍্যাচমার্ক। আর সেটা থেকে বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, এটি শুধু লাগেজ নয়, বরং বিশালাকৃতির একটি আইইডি (বোমা)৷ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলাম। স্নায়বিক সাড়া হারিয়ে ফেললাম। যখন হুশে এলাম তখন শুধু ঘামের আর্দ্রতাটকুই টের পেলাম। আমার বোম টিমের সদস্যরা তখনও কিছু বুঝে উঠতে পারেনি। তারা নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। এই ফাঁকে লাগেজের সাইজ এবং সেটির (অনুমেয়) ওজন থেকে মনে মনে এই বোমার ধ্বাংসাত্মক ক্ষমতার অংকটি সেড়ে ফেললাম। অংকের ফলাফল ভয়াবহ রকমের দুঃসংবাদ বয়ে আনলো; বোমাটি বিস্ফোরিত হলে চারিদিকে এক বর্গকিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত হবে সেটির ধ্বংশযজ্ঞ। দুরত্ব আর সময়ের বিচারে এখন আর নিরাপদে যাবারও কোন উপায় নেই। বুঝতে পারলাম চারপাশের কয়েক হাজার উৎসুক-অনুৎসুক জনতা, গণমাধ্যমকর্মী, পুলিশ-র‍্যাব এবং পুরো বোম্ব ডিসপোজাল টিমের সদস্যদের নিয়ে আমরা একটি ডেথ-ট্র‍্যাপে পড়ে গেছি। সিনিয়র স্যারদের বিষয়টি অবহিত করলাম। 

এবার কিছুটা দূরে গিয়ে টিমের সবাইকে ঘটনাটি জানালাম। সবাই স্তব্ধ, এবং হতবাক হয়ে গেল। তৎক্ষনাৎ আমরা সবাই মানসিক শক্তি সঞ্চারের জন্য যুদ্ধ শুরু করে দিলাম। তারপর দ্রুততার সাথে জায়গাটি ফাঁকা (ইভাকোয়েশন) করতে লাগলাম। সকল পুলিশ সদস্যদের ক্রাইমসীন ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে যাবার পরামর্শ দিলাম। ব্যস্ত রাস্তার গাড়ি চলাচল পুরোপুরি বন্ধ করে দিলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যে ট্রাফিকজ্যামের লেজ ক্রমাগত লম্বা হতে লাগলো। সেই সাথে ট্রেন চলাচল এবং গ্যাসের লাইনও বন্ধের পরামর্শ দিলাম। ফায়ার সার্ভিসের একাধিক ইউনিট প্রস্তুত করে বেশ কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্স স্ট্যান্ডবাই রাখলাম। মানসিক চাপে আমরা সবাই সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের লক্ষ্য একটাই, আর তা হলো বোমাটিকে নিয়ন্ত্রিতভাবে নিস্ক্রিয়করা অথবা ব্লাস্ট করা। তাই একটি নিরাপদ জায়গা বেছে নিয়ে আমরা একটি সিপি (কমান্ড পোস্ট) স্থাপন করলাম। সবথেকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ শুরু করে দিলাম। তখন টিমের সবাই প্রচন্ড চাপা উৎকন্ঠা আর দায়িত্ববোধে নিমজ্জিত। এদেশের সর্বশেষ ভরসার জায়গা হিসেবে আমরা আমাদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, সাহস, পেশাদারিত্ব আর দেশমাতৃকার প্রতি গভীর ভালোবাসা নিয়ে বোমাটি নিষ্ক্রিয় করার উদ্দেশ্যে সবথেকে নিরাপদ পদ্ধতির সন্ধান করতে লাগলাম। 

এভাবেই ৪০-৫০ মিনিট অতিবাহিত হলো। আমরা বোমাটি থেকে বেশ দূরেই অবস্থান করছিলাম। তখন  চারিদিক বেশ ফাঁকা এবং স্তব্ধ। কিন্তু হঠাৎ খেয়াল করলাম বোমাটির আশেপাশের জায়গায় থেকে কিছু মানুষের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। নিজের কর্ণ নামক ইন্দ্রীয়'র উপর ঠিক ভরসা কররে পারছিলাম না। এত সতর্ক করার পরও এতটা আত্মঘাতী হয়ে কে সেখানে যাবে! তাই দূরবীন দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু হ্যা, ঘটনা সত্য! কিছু উৎসুক জনতা, যারা একটু দেরীতে ঘটনাস্থলে এসেছে তারা লাশের পাশে (বোমের কাছে) দাঁড়িয়ে মোবাইলে ছবি তুলছে। হতবিহ্বল হয়ে গেলাম! গর্জে উঠে হ্যালারের মাধ্যমে পৃথিবীর নিকৃষ্টতম শব্দের ভান্ডার উন্মুক্ত করে দিলাম যা জীবনের প্রথম ব্যবহার করতে বাধ্য হলাম। ভোকাল কর্ড মীরজাফরি করে বসল। গলা বসে গেল। কন্ঠনালী দিয়ে হাসের বাচ্চার মত ফ্যাস ফ্যাস শব্দ বের হতে লাগলো। 

যেভাবেই হোক তাদের নিভৃত করে দূরে সরিয়ে দিলাম। নির্দেশমত সকল পুলিশ সদস্য নিরাপদ দুরত্বে সরে যাওয়াতে এই ঝামেলা সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা বুঝতে পারলাম। তাই নিজেই একটা প্রটেকশন নিয়ে বোমের কাছাকাছি একটি জায়গায় অবস্থান নিলাম। কি আর করার! বিকল্প কোন উপায়ও নেই! এক হাতে ওয়াকি-টকিতে টিমের সাথে কথা বলতে লাগলাম, আর অন্য হাতে হ্যালারে ফ্যাসফ্যাসানি। 

তারপরও নিকশ কালো সেই অন্ধকারের মাঝেও আনাচে-কানাচে লুকিয়ে থেকে বোমাটি দেখতে দাঁড়িয়ে থাকা অসংখ্য লোকজনের উপস্থিতির টের পেলাম। আমি হতাশ হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলাম। তারপর আবার হ্যালার দিয়ে তাদের দূরে সরে যাওয়ার জন্য শেষবারের মত আহবান করতে লাগলাম। তাদেরকে সেখান থেকে সরাতে আমাদের প্রায় দুই ঘন্টা অতিরিক্ত সময় লেগে গেল। সেই অভিজ্ঞতা দিয়ে এই সমাজ এবং জাতির আচরণের উপর আমার ছোটখাটো একটি পিএইচডি হয়ে গেল।  

যাহোক, রাত প্রায় ১টা বেজে গেল। তখন ৫ ঘন্টা ধরে চলা যুদ্ধের সরু টানেলের শেষ লাইট খুঁজতে লাগলাম। চারিদিকে ভয়াবহ রকমের  নিস্তব্ধতা। এদিকে আমরাও পরিশ্রান্ত, তৃষ্ণার্ত এবং কিঞ্চিত বিরক্ত। তবুও প্রটোকল রক্ষা করে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করে কাজ চালিয়ে গেলাম। ইতিমধ্যে রাস্তায় ট্রাফিকজ্যামের লেজ কয়েক মাইল দীর্ঘ হয়ে গেছে। এ নিয়ে ট্রাফিক পুলিশও বেশ চাপে পড়ে আছে যা আমাদের উপর বর্শিত মোট চাপের যোগফলকে ক্রমাগত ভারী করে তুলছে। 

শেষমেশ বোমাটি নিষ্ক্রিয় করতে বোতাম চাপা হলো। প্রচন্ড শব্দে পৃথিবীটা যেন ভেঙ্গে পরল। কানে তালা লেগে গেল। ঝি ঝি শব্দের অকেজো কান ধীরে ধীরে কেজো হয়ে উঠল। আর তখনই চারিদিক থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসতে লাগলো। আমি হন্নে হয়ে কান্নার উৎস খোঁজাখুঁজি শুরু করলাম। বাকি পুলিশরাও একই কাজে ব্যস্ত। পেয়েও গেলাম। বোমের স্ফিংক্টারের আঘাতে লুকিয়ে লুকিয়ে বোমা দেখতে আসা কয়েকজন বেয়াক্কেল এবং উৎসুক বীর আহত হয়ে মাটি পরে কাতরাচ্ছে। দুই জনের বুক ছিদ্র হয়ে ফুসফুস থেকে অঝরে রক্ত ঝরতে শুরু করেছে। তাদের দ্রুত হাসপাতালে নেয়া হলো। আর, এদিকে আমরা পরবর্তী কাজ শুরু করে দিলাম।.....  এবং শেষ রাতের দিকে কাজ শেষও করলাম। 

পুনশ্চঃ 
যে কথাটি বলার জন্য এত বড় একটি গল্পের ফাঁদে ফেলার কারন, তা হলো - মহামারি করোনা,কোভিড-১৯

অভাক হওয়ার বিষয়ঃ
যে দেশের মানুষ দৃশ্যমান 'বৃহৎ আকারের বোমা' দেখেও আতংকিত না হয়ে বরং উৎসুক হয়ে তামাশা দেখতে কাছে দাঁড়ায়, তাদেরকে অদৃশ্য ও আণুবীক্ষণিক 'করোনা'র ভয় দেখিয়ে কতটা কাবু করা যাবে তাতে আমার বেশ সন্দেহ রয়েছে।

তবুও আশায় বুক বাঁধি, একে অপরের উপর নির্ভর করি, আল্লাহকে ডাকি - এই মানুষগুলোর কর্ণকুহরে হ্যালারের বাণী পৌছে যাকঃ

'করোনা'এটম বোমার থেকেও কয়েক লাখগুণ শক্তিশালী বোমা। আর করোনার কাছে 'মানুষ' এই পৃথিবীর সব থেকে দুর্বলতম একটি প্রাণি। কারণ, তার আঘাতে এখন শুধু মানুষই মরছে, অন্য কোন প্রাণি নয়। শুধু মস্তিষ্কের উর্বরতাই পারে মানুষকে এই পৃথিবীর বুকে অনেক দিন ধরে  টিকিয়ে/বাঁচিয়ে রাখতে, ঠিক যেভাবে সৃষ্টির পর থেকে বেঁচে আছি। তাই বাঁচতে হলে মগজ খাটিয়েই বাঁচতে হবে, গতর খাটিয়ে নয়।' 

হ্যালারের বাণী শেষ। আল্লাহ হাফেজ।সবাই বাসায় থাকুন।সরকারী নির্দেশনা মানুন।

লেখকঃ পুলিশ সুপার,কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট,ডিএমপি।



image
image

রিলেটেড নিউজ

Los Angeles

১৮:০৯, মে ১২, ২০২২

বজ্রপাত হচ্ছে-সাবধান হই


Los Angeles

১২:২৮, অক্টোবর ৭, ২০২১

“কয় জন ভালো নয়, সয় জন ভালো হয়”


Los Angeles

০০:৫৯, সেপ্টেম্বর ২১, ২০২১

বাংলাদেশের ফুটবলের কলংকিত দিন ১৯৮২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর !


Los Angeles

১১:৩৪, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২১

প্রকৃতিতে নয়, কেবল কাগজের নোটেই আছে ‘জাতীয় পাখি দোয়েল‘


Los Angeles

২২:১২, সেপ্টেম্বর ১, ২০২১

ফুটবলের মরা গাঙে কি আবার জোয়ার আসবে ?


Los Angeles

২৩:০৮, আগস্ট ১৫, ২০২১

শাসক নয় বঙ্গবন্ধু আপাদমস্তক সেবক ছিলেন


Los Angeles

১৮:৫৭, আগস্ট ১৩, ২০২১

আড্ডা যেন এক উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়


Los Angeles

০০:০৪, আগস্ট ৮, ২০২১

বাইরে মুক্তির কল্লোল ও বন্দী একটি পরিবার


image
image