শিরোনাম
আলমগীর মুহাম্মদ ফারুকী | ২২:০৯, এপ্রিল ১৪, ২০২০
এই যেন এক বিশাল ব্যতিক্রমী যুদ্ধ, মানবসভ্যতার সাথে অদৃশ্য শত্রুর, এক আণুবীক্ষণিক ভাইরাসের।আমরা সবাই ভীত সন্ত্রস্ত। এই লড়াইয়ে জিততেই হবে, তা না হলে মানব ইতিহাসের সব প্রাপ্তি মিথ্যা হয়ে যাবে। সৃষ্টিকর্তার পছন্দনীয় শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষের ক্ষমতা ও অগ্রগতি প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এটা প্রকৃতি চাইবেনা। আমরা আসুন এই অনাকাঙ্ক্ষিত বিভীষিকার মাঝে সম্ভাবনা খুঁজি, সৃষ্টিশীলতাকে তালাশ করি। বেঁচে থাকার প্রেরনা আনি।
ধরুন, এই ভাইরাস পানি বাহিত। আপনি বাসায় যে পানিতে সব কাজ সারছেন, নদী, সাগর বা পুকুরের যে পানি সভ্যতার প্রান তা এই ভাইরাসকে পরিবহন করছে। তাহলে কেমনে সম্ভব হতো প্রানীজগতের বেঁচে থাকা...অতএব শুকরিয়া মহান আল্লাহর নিকট।
একবার ভাবুনতো, যদি এই ভাইরাস ইবোলা বা এইচআইভির মত মৃত্যুর নিশ্চয়তা দিতো তাহলে আমরা বর্তমানে জীবিত থেকেও মৃত্যুর খুব কাছে থাকতাম। Study দেখাচ্ছে আশার আলো। বাস্তবতা বলছে, এটার মৃত্যু ঘটানোর সম্ভাব্যতা ৩%, সর্বোচ্চ ৬% ।
মহান প্রভু আমাদের প্রতি কত সহায়! খাবার বা নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মাধ্যমে এই ভাইরাস হয়তো ছড়াতে পারতো, বাতাসে দীর্ঘ সময় ভেসে থাকতে পারতো, অনন্ত অসীম জীবনের অধিকারী হতে পারতো এই প্রানঘাতক। এসব কিছুর সম্ভাবনা প্রশ্নসাপেক্ষ।
মনে করুন, আপনার হাতে, শরীরে ভাইরাস কিলবিল করছে। তাকে তাড়ানো বা হত্যা করার কোন অস্ত্র আপনার কাছেই নাই। তাহলে কেমন হতো?? বিজ্ঞান এক্ষেত্রে জানিয়েছে, স্যানিটাইজার, এলকোহল, এমনকি বাংলা বা পঁচা সাবানে এর সাক্ষাৎ মৃত্যু হয়। হাজারী সাহেব হয়তো এই আঙ্গিকেই বলতে চেয়েছিলেন, তবে অতি আবেগ, মৃত্যুভয়, জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা তাকে বিভ্রান্ত করেছে। এই মৃত্যুদূত ভাইরাসকে কাবু করতে আমরা যদি কোন উপায় না পেতাম, তবে কেমন অসহায় লাগতো???
পরিসংখ্যান ও বিজ্ঞরা বলছে, শিশু এবং যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রবল তারা মুটামুটি নিরাপদ। মনে করুন, আপনার ছোট শিশু সন্তানটি যদি এক্ষেত্রে Vulnerable হতো, ছোট্ট মনিটা এই দুষ্ট প্রজাতির আক্রমণের শিকার হতো, তাহলে আমরা বড়রা কি স্বাভাবিক থাকতে পারতাম???
এই ভাইরাস Non Living Object এ বেশীক্ষণ বেচেঁ থাকতে পারেনা, এরা মানুষকেই পোষক হিসেবে বেছে নেয়। এটি যদি Dengue Virus এর মত মশাকে কিংবা কোন কোন ক্ষেত্রে মাছি, পোকামাকড়, কীটপতঙ্গকে বাহক বানাতো,তাহলে কি ভয়াবহ হতো তা কি কল্পনা করা যায়?? এক্ষেত্রে মহান সৃষ্টিকর্তার কোন্ কোন্ অনুগ্রহকে আমরা অস্বীকার করব???
মাত্র ১৪ দিন কোয়ারাইন্টেন থাকলে আক্রান্ত ব্যক্তি নিজে ভাইরাস থেকে মুক্ত হয়, সুস্থ মানুষ তার সংস্পর্শে নিঃসংকোচে যেতে পারে। এটি যদি মানুষের মধ্যে HIV এর মত আয়ুস্কাল পেত, তবে এই সভ্যতা কি ঠিকতো???
আমরা মানুষরা অনেক নিষ্ঠুরতা দেখিয়ে চলছি, পাশবিকতার শেষ সীমাটাও আমরা অতিক্রম করেছি। অন্যায়,অবিচার, ঘুষ, দুর্নীতি, যুদ্ধ,বিগ্রহে এই সভ্যতাতো এমনিতেই এক মেকি কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে আছে। যারা বেশী সভ্য সেই প্রথম বিশ্ব তাদের সব শ্রম, জ্ঞান, সম্পদগুলো মরনাস্ত্র তৈরির পিছনে ব্যয় করেছে। তারাই এখন ভাবছে বিগত ভুলগুলোর কথা। বিল গেটস সেই ২০১৫ তে বলেছিল, আমাদের উচিত মানবসভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য পারমাণবিক অস্ত্রের পিছনে নয়, বরং ক্ষতিকর জীবানুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে কিংবা মহামারী ঠেকাতে বিনিয়োগ করা। ১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধের বিভৎসতা ছাড়াও নিকট অতীতে সিরিয়া যুদ্ধে প্রায় ৪ লক্ষের অধিক, ইয়েমেন যুদ্ধে প্রায় ১ লক্ষ, ইরাক যুদ্ধে ১০ লক্ষের অধিক এবং আফগানিস্তান যুদ্ধে প্রায় ১ লক্ষের অধিক কিংবা মায়ানমারসহ পৃথিবীর অনেকখানে অগনিত মানুষকে আমরা হত্যা করেছি। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে, শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে আমরা এই হত্যাকাণ্ড চালিয়েছি।ধর্মীয় উন্মাদনা দেখিয়েছি। এই করোনা ভাইরাস প্রগতিশীল বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে, অত্যাচারীর বিবেককে জাগিয়ে তুলেছে, তাদের বিগত ভুলগুলো ধরিয়ে দিচ্ছে। তৃতীয় , দ্বিতীয়, প্রথম বিশ্ব এক কাতারে এসে দাড়িয়েছে। কেউ ব্রাহ্মণ, আবার কেউ নমশূদ্র নয়, সবাই সমান। এটাই সাম্য। এটাই প্রাপ্তি, এটাই মানবজাতির জন্য সর্বোত্তম শিক্ষা।
পরিবেশ ,প্রকৃতি ও প্রানীকূল এতদিন মানবের দানবীয়তায় অসহায় হয়ে পড়েছিল, তারা অভিশাপ দিয়েছিল। তারা আজ দেখিয়ে দিচ্ছে পৃথিবী শুধু মানুষের নয়, তাদেরও ভোগ করার অধিকার আছে। মানুষ আজ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে তাদের দাবীর ন্যায্যতাকে স্বীকার করছে।
ধর্ম পবিত্র ও সুন্দর। প্রকৃত ধার্মিক মানুষ মানেই একজন পরিশুদ্ধ মানুষ। ধর্ম জীবনকে পার্থিব প্রাপ্তিতে সীমাবদ্ধ করেনা, পারলৌকিক জীবনের জবাবদিহিতার বিষয়ে সতর্ক করে। যৌক্তিক ও উদার ব্যাখ্যা ধার্মিকতাকে আরও মানবিক করে তুলে। এই ভাইরাস পৃথিবীর সবল দূর্বল প্রায় সকলকে স্রষ্টার প্রতি ধাবিত করেছে, ভুলোমনা মানুষগুলোকে সর্বশক্তিমানের অনুগ্রহের প্রতি নিবিষ্ট করেছে। অযাচিত অহংকারগুলোকে করেছে চূর্ন বিচূর্ণ। ইতালির প্রধানমন্ত্রী একসময় বলে উঠলেন, ”আমাদের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ, এখন তাকিয়ে আছি আকাশের দিকে। সমাধান একমাত্র আকাশে যিনি আছেন তাঁরই হাতে”। সসীম সৃষ্টিকে অসীম স্রষ্টার অনুগ্রহের দিকে মনোযোগী করার কৃতিত্ব এই ক্ষদ্র অনুজীবকে দিতেই হবে।
এই কঠিন সময়ে অনেকখানে মনুষ্যত্বের জয়গান চলছে। আমরা মানুষরা মায়া ছড়াচ্ছি। আমার এই নরম মাটির দেশে চাল-গম চোরের চেয়ে অনেক বেশি মানবিক মানুষকে পাচ্ছি। শত সীমাবদ্ধতা সত্বেও জীবনকে তুচ্ছ করে চিকিৎসকরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন- দায়িত্ববোধ থেকে এইসময় সরাসরি রোগীর পাশে থাকা যেন আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ। ইতোমধ্যে দুদকের একজন পরিচালক ও স্বাস্থ্যকর্মী মৃত্যুবরন করেছেন। পুলিশ বাহিনী, আর্মি, প্রশাসন, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা, স্বেচ্ছাসেবীরা মাঠে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। এসব যোদ্ধাদের অভিবাদন। ব্যতিক্রম থাকতেই পারে। সৃষ্টির মাঝে অনাসৃষ্টি থাকে। তারা নগন্য। এসব দেখে আশান্বিত হই। হয়তোবা এগুলো দেখে দুষ্ট লোকগুলোর বিবেক নতুন করে জাগ্রত হবে, নতুন এক সুন্দর মানবিক বাংলাদেশ পাব। করোনা সৃষ্টিকর্তার করুনায় রুপান্তরিত হবে।
চারিদেকে করোনাকে পরাস্ত করতে কত থিওরি, কত উপদেশ, কত পরামর্শ। হয়তোবা তা ভুল, ঠুনকো কিংবা অবৈজ্ঞানিক - তারপরও তো তা আত্মবিশ্বাসে শক্তি যোগায়। মানুষ যে অপরকে নিয়ে ভাবে- তা তার প্রমান। হুমায়ুন আহমেদের 'অচীন বৃক্ষ' নামক উপন্যাসে গ্রামবাসী এমন একটি অবাস্তব বিশ্বাস লালন করেছিল- ঔ গ্রামে এক অচীন পুরানো গাছে একসময় ফুল ধরবে, ফল হবে যেটি খেয়ে কঠিন রোগগুলি সারবে। লিখক এই বিশ্বাসকে নিয়েই উপন্যাস লিখেন। এই স্বপ্নাদেশে বসবাসকারী মোহাচ্ছন্ন আমাদের মানুষগুলো যেন এভাবে বা যে কোনভাবে বেঁচে যাক, এই দেশ যেন মৃত্যুপুরী না হোক- এই চেষ্টা যেন সকলের। সবার চিন্তার আশ্চর্য এক ঐক্যমত। করোনা ভাইরাস এ-ই সৌন্দর্য দেখার সুযোগ করে দিল।
মানুষ মরবে, মরতেই হবে। এটাই স্বাভাবিক। তবে সে- তো আশরাফুল মাখলুকাত, সৃষ্টির সেরা। বেঁচে থাকার অধিকার সেই মানুষের আছে যে মরনকে সত্য ও বাস্তব মর্মে গ্রহণ করে। হিংস্র প্রানীর সাথে মানুষের পার্থক্য এই ক্ষেত্রে যে, মানুষই একমাত্র জীব যে নিজের স্বজাতির জন্য জীবন দিতে পারে। কিন্তু মানুষ হেরে যায় তখন যখন সে তার চাওয়া ও পাওয়ার আকাঙ্খাকে সীমাবদ্ধ করতে পারেনা। যেখানে একজন ক্ষুধার্ত পশু তার উদর পূর্তি হয়ে গেলে শত শিকারকে সামনে পেলেও আক্রমণ করেনা, সেখানে মানুষের চাহিদা ও লোভ শেষ হতেই চায়না। লিউ টলস্টয়ের কালজয়ী সৃষ্টি 'How much land does a man require?’-এর চরিত্রের পরিনতির মত লোভী ও সম্পদ হরনকারীরা এখন একই ফলাফলের মুখোমুখি হচ্ছে, আতঙ্কিত হচ্ছে। মৃত্যু যেখানে সন্নিকট সেখানে সম্পদ কিই-বা কাজে লাগবে??? এই শিক্ষা COVID-19 এর....এটা অস্বীকার করার কি কোন সুযোগ আছে????
মানুষ হারেনা, হারতে পারেনা। ইতিহাস তাই-ই বলে। স্রষ্টা মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ক্ষুন্ন হতে দেবেননা। এই মেঘ একসময় কেটে যাবে। এই রোগকে আমরা জয় করবো। নতুন সূর্য উঠবে,পাখিরা গান করবে, প্রকৃতি হাসবে। মানবিকতা ও সুন্দরের জাগরণ ঘটবে। দুষ্টরা প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠবে। সবাই এই অনাহুত জীবানুটিকে বার বার অভিশাপ দিচ্ছে। তখন হঠাৎ মনে হলো, এই ছোট্ট আণুবীক্ষণিক ভাইরাসটি কত বার্তা , কত সম্ভাবনা, কতো প্রাপ্তি নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে- তা কি আমরা ভেবে দেখছি....এই বাংলা নববর্ষে আমার দেশের মানুষগুলো হোক আত্মপ্রত্যয়ী ও আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান।
লেখক : অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ, নোয়াখালী।
Developed By Muktodhara Technology Limited