image

আজ, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ইং

বদলে যান, বদলে দেব

মো. আখতার হোসেন আজাদ    |    ১০:২১, মে ৩১, ২০২০

image

বাংলাদেশ পৃথিবীর অপার সম্ভাবনাময় দেশ। পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক ও দক্ষ মানব সম্পদ থাকা সত্ত্বেও নানাবিধ কারণে আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছরেও কাঙ্খিত লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে পারিনি। ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের দরুণ আমরা যতটা না ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি, তারও অধিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কৃত্রিম সংকটে। দূর্নীতি, সুশাসনের অভাব, আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া, রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানাবিধ কারণে আমাদের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। বারবার নষ্ট রাজনীতির কাছে আমরা হেরে যাচ্ছি। যত বড় না দেশ, তার চেয়ে যেন বেশি রাজনীতির চর্চা আমরা করি। নীতির রাজা হিসেবে রাজনীতি পরিচিত হয়ে আসলেও বাংলাদেশে শব্দটি ক্রমেই জনধিকৃত শব্দে পরিণত হয়েছে।

পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহ সংকটময় অবস্থায় উপনীত হলে দল-মত ভেদাভেদ ভুলে জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠে। বিপরীতে আমাদের দেশ কখনো ক্রান্তিকাল অতিক্রম করলে আমরা জাতীয় ঐক্যের বদলে পরস্পর কাঁদা ছোড়াছুড়িতে নিজেদের নিয়োজিত করি। বর্তমানে সারাবিশ্ব এক ভয়ানক অবস্থা অতিক্রম করছে; যার ঢেউয়ের আঘাত বাংলাদেশেও আছড়ে পড়েছে। কিন্তু এ মহামারীতেও আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দ, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ নিজেদের চিরাচরিত অভ্যাস ধরে রেখেছেন। সকলেই নিজের মনগড়া বক্তব্য, মন্তব্য, ব্যাখা করে চলেছেন। দেশে করোনাভাইরাসের আগমনের প্রাথমিক অবস্থায় সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বশীল মন্ত্রীবর্গের দায়িত্বহীন বক্তব্য ও মন্তব্য সাধারণ জনগণের, বিশেষ করে শিক্ষিত যুব সমাজের কাছে নিন্দিত হয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, করোনা নিয়ন্ত্রণে আমেরিকা-ইতালির থেকেও সফল বাংলাদেশ; পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষ্যমতে করোনা কোন মারাত্মক রোগ নয়, এটি সর্দি-কাশির মতো; সেতুমন্ত্রী বলেছেন, বিএনপি করোনাভাইরাস নিয়ে রাজনীতি করছে। দেশের এমন ক্রান্তিকালে নন্দিত ব্যক্তিবর্গের এমন নিন্দিত বক্তব্য জনগনের হাসির খোরাকে পরিণত হয়েছে। আবার করোনাভাইরাস নিয়ে রাজনীতির মাঠও গরম রেখেছেন আমাদের দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ। বিরোধীদলের নেতারা সরকারের অবহেলা ও গাফিলতি দাবী করার প্রত্যুত্তরে সরকারের পক্ষ থেকে এটিকে বিরোধীদলের অপরাজনীতি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এটি সত্য যে, সরকার প্রথমে করোনাভাইরাসকে এতটা গুরুত্ব প্রদান করেনি যতটা গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু দেরীতে হলেও দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণজমায়েত, সভা-সমাবেশ, ধর্মীয় অনুষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা করেছে। এতে বিরোধীদলের পক্ষ থেকে বিন্দুমাত্র সাধুবাদও জানানো হয়নি। বরং এ দুর্যোগকে পুঁজি করে প্রত্যেকে নিজেদের মতো রাজনীতি করে যাচ্ছেন। অথচ সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা ছিল, সরকার ও বিরোধীদল পরামর্শক্রমে দেশের সম্পদের যথার্থ ব্যবহার করে এই জাতীয় দুর্যোগকে মোকাবেলা করতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে যাবে।

এখানেই শেষ নয় জাতীয় নির্বাচন, বিভিন্ন ইস্যু ও চুক্তি নিয়েও আমাদের দেশের রাজনীতির মাঠ সরগরম থাকে সারাবছর। কিছুদিন পূর্বে যখন সারাদেশব্যাপী মাদক, জঙ্গী ও সন্ত্রাস দমন অভিযান চলছিল তখনও আমরা দেখেছি রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পর নোংরা বাকযুদ্ধ। বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশে আমরা দেখতে পাই, আদর্শিক কারণে ভিন্ন রাজনীতি চর্চার পরেও জাতীয় স্বার্থে একে অপরকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করে থাকে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও দেখতে পাই রাজনৈতিক দলগুলোর এমন সহিষ্ণু আচরণ। অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নিজেদের মতরিবোধ থাকলেও জাতীয় ইস্যুতে তারা একাত্ম থাকে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমরা এমন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে পারিনি আজও। যখন যে দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, নিজেদের দেশের প্রভু ভেবে সকল সিদ্ধান্ত এককভাবে গ্রহণ করে থাকে। জনমত বা বিরোধীদলের পরামর্শকে নূন্যতম মূল্যায়িত করে না বললেই চলে। পক্ষান্তরে বিরোধীদলে যখন যে রাজনৈতিক দল আসীন হয়, কারণে-অকারণে সরকারের প্রতিটি কর্মকান্ডের বিরোধীতা করায় যেন প্রধান লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করার সংস্কৃতি চর্চা করতে দেখা যায়। বিপরীতে এটিও সত্য যে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পেলে দেশের উন্নয়নের পাশাপাশি বিরোধী দল দমনও যেন সরকারি দলের অন্যতম প্রধান কর্মে পরিণত হয়। এসব আমাদের দেশের নির্দিষ্ট কোন রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট্য নয়, বরং যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে সকলেই এমন পন্থা অবলম্বন করে থাকে।

আমাদের দেশের ছাত্ররাজনীতির অতীতের সকল গৌরবজ্জ্বোল অর্জনকে ধূলিস্যাৎ করছে। একসময় যেকোন ক্রান্তিকালে ছাত্রনেতারা দেশের মানুষের আশা-আখাঙ্খার প্রতীক ছিল। সুস্থ ধারার ছাত্ররাজনীতি চর্চার ফলে দেশ ও জাতি অনেক যোগ্য নেতৃত্ব উপহার পেয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের, রাশেদ খান মেনন, মতিয়া চৌধুরী, নুরুল ইসলাম নাহিদ, তোফায়েল আহমেদ, আ. স. ম আব্দুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ গুণগত ছাত্ররাজনীতি চর্চার ফসল। কিন্তু বর্তমানে ছাত্ররাজনীতি দেশের মানুষের কাছে এতটা অপছন্দনীয় হয়েছে যে, কেউ ছাত্ররাজনীতি করলে সমাজের লোকেরা বাঁকা চোখে তাকায়। এজন্য দায়ী বৃহৎ রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। ছাত্ররাজনীতিকে মাত্রাতিরিক্ত নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের ফসল এটি। আমাদের দেশের প্রতিটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের সহযোগী বা ভাতৃপ্রতিম ছাত্র রাজনৈতিক সংগঠন রয়েছে। নানা সময়ে নিজের পক্ষে শোডাউন, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতেই সারাবছর ব্যস্ত সময় পার করেন স্থানীয় বৃহৎ সংগঠনের নেতা। অথচ তাদের উচিত ছিল গুণগত ছাত্ররাজনীতি চর্চা হচ্ছে কি না সেটি তদারকি করা। আবার ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্ব নির্বাচনেও থাকে তাদের অনৈতিক প্রভাব। সৎ, যোগ্য এবং ত্যাগী নেতাদের অবমূল্যায়নের ফলে অযোগ্য নেতৃত্ব সামনে আসছে প্রায় প্রতিটি ছাত্রসংগঠনে। ছাত্রনেতা নির্বাচন করা প্রয়োজন ছাত্রদের তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে। কিন্তু লবিং পদ্ধতিতে উঠে আসা নেতৃত্ব অন্যায় প্রভাবের ফলে বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। আবার কোন অপকর্ম জনসম্মুখে আসলে তা বৃহৎ সংগঠনের নেতার মাধ্যমেই ধামাচাপা দেয়ার ফলে এমন অপকর্মের স্পৃহা আরও জাগ্রত হয়। ছাত্ররাজনীতিতে বৃহৎ রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দের অনৈতিক হস্তক্ষেপ ও ছাত্ররাজনীতির নেতাকর্মীরদের অন্যায়-অপকর্ম ঢেকে রাখার কূটকৌশল ছাত্ররাজনীতিতে ঘুণ ধরিয়ে দিচ্ছে।

আমাদের দেশের আরেকটি নেতিবাচক ঐতিহ্য রয়েছে সরকারের কোন সিদ্ধান্তের ক্রুটি-বিচ্যুতি আলোচনা-সমালোচনা করলে সরকারবিরোধী ব্যক্তিতে পরিগণিত করা হয়। বিরোধীমতকে দমনে ছাত্ররাজনীতির নেতাকর্মীদের ব্যবহার করা হয়। দেশের অগ্রযাত্রার নাবিকদের এমন কর্মকান্ড তরুণ সমাজকে হতাশ করে। ফলে মেধাবীরা ক্রমেই এমন দূষিত রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ফলে এক অন্ধকার পথের দিকে এগুচ্ছে ভবিষ্যতের জাতীয় রাজনীতি। যথাযথ মূল্যায়ন, সহনশীলতা ও বিশ্বাসের রাজনীতি যতদিন না চর্চা হবে ততদিন দেশ কাঙ্খিত মাত্রায় পৌঁছতে পারবে না।

শিক্ষকরা হলেন দেশ গড়ার কারিগর। শিক্ষার্থীদের দক্ষ, আদর্শ ও যোগ্য নাগরিক হিসেবে তোলার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। কিন্তু নৈতিকতার পরীক্ষায় শিক্ষকরা অনেক সময় অনুত্তীর্ণ হচ্ছেন। প্রাথমিক, মাধ্যমিক গন্ডি কোন রকমে পেরুলেও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষকদের গাফিলতি দেশের সুশীল সমাজকে ভাবিয়ে তুলছে। গবেষণায় অনীহা, প্রশাসনিক পদের লোভে মাত্রাতিরিক্ত রাজনীতি, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের নামে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ফাঁকিবাজি পাঠদান, নিয়মিত ক্লাসে ভ্রুক্ষেপ না দিয়ে কাঁচা অর্থের গন্ধে সন্ধ্যাকালীণ কোর্সে বিশেষ মনোযোগ সকলকে ভাবিয়ে তুলছে। ওদিকে সরকারি আমলাদের লাগামহীন দূর্নীতি, ঘুষ, নিয়োগ বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অপকর্ম দেশের ভবিষ্যৎকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

পৃথিবীর সিংহভাগ জাতির অতীত ইতিহাস রক্ত-রঞ্জিত কালো অধ্যায়ের। তারা সেসব ভুলে দেশে বিভাজন সৃষ্টি না করে কাঁধ-কাঁধ মিলিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেছে এবং সফলতার সোপান বেয়ে উন্নতির স্বর্ণশিখরে আরোহণ করেছে। কিন্তু আমরা বিভাজনের ঘেরাটোপে এখনও বন্দী। কোন মহাশক্তি আমাদের জাতিগত বিভাজন দূর করতে পারবে না। আমাদের জাতিগত বিভাজন আমাদেরকেই দূর করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে আমাদের দেশের প্রবীণ রাজনীতিবিদদের এগিয়ে আসতে হবে। বর্তমানে চর্চিত দূষিত রাজনীতি তরুণ সমাজের উপর চাপিয়ে না দেওয়া হবে সর্বোত্তম কাজ। তরুণ সমাজের মাঝে অপার সম্ভাবনা লুকায়িত আছে। রয়েছে দূর্নিবার চিন্তা ও উদ্ভাবনী শক্তি। দেশের রাজনীতিবিদদের প্রতি আহবান থাকবে, আপনারা পরস্পর বিভেদ ভুলে দেশটাকে এগিয়ে নিতে কাজ শুরু করুন। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়াকে মূল লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ না করে রাজনীতিকে জনসেবার ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করুন। শিক্ষক সমাজের প্রতি আহবান, আপনারা নৈতিকতার স্থান থেকে অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করুন। কথা দিচ্ছি, আপনারা পরিবর্তন হলে, আমরা যুবসমাজ দেশ বদলে দিব।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।

কলাম ও মতামত বিভাগে প্রকাশিত সকল লেখার দায় একান্ত লেখকের। এতে সিটিজি সংবাদ.কম এর নিজস্ব কোন বক্তব্য নেই।



image
image

রিলেটেড নিউজ

Los Angeles

১৮:০৯, মে ১২, ২০২২

বজ্রপাত হচ্ছে-সাবধান হই


Los Angeles

১২:২৮, অক্টোবর ৭, ২০২১

“কয় জন ভালো নয়, সয় জন ভালো হয়”


Los Angeles

০০:৫৯, সেপ্টেম্বর ২১, ২০২১

বাংলাদেশের ফুটবলের কলংকিত দিন ১৯৮২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর !


Los Angeles

১১:৩৪, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২১

প্রকৃতিতে নয়, কেবল কাগজের নোটেই আছে ‘জাতীয় পাখি দোয়েল‘


Los Angeles

২২:১২, সেপ্টেম্বর ১, ২০২১

ফুটবলের মরা গাঙে কি আবার জোয়ার আসবে ?


Los Angeles

২৩:০৮, আগস্ট ১৫, ২০২১

শাসক নয় বঙ্গবন্ধু আপাদমস্তক সেবক ছিলেন


Los Angeles

১৮:৫৭, আগস্ট ১৩, ২০২১

আড্ডা যেন এক উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়


Los Angeles

০০:০৪, আগস্ট ৮, ২০২১

বাইরে মুক্তির কল্লোল ও বন্দী একটি পরিবার


image
image