শিরোনাম
মো. আবুল বশার | ০০:৫৩, নভেম্বর ২৬, ২০২০
করোনাকালীন জটিলতা কাটিয়ে শুরু হয়েছে মহেশখালী মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ কাজ। সম্ভাব্যতা যাচাই সম্পন্ন করার পাশাপাশি সরকারের কাছ থেকে ডিপিপি অনুমোদনও পেয়ে গেছে ১৭ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প। এখন শুরু হবে প্রস্তাবিত বন্দরের ডিটেইল ডিজাইন তৈরির কাজ। ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০২৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে নির্মাণ কাজ শেষ হবে। মাতারবাড়ী বন্দরের টার্মিনালে ভিড়তে পারবে ১৮.৫ মিটার গভীরতার জাহাজ। বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে মহেশখালীর মাতারবাড়ী ও ধলঘাট এলাকায় বন্দরটি নির্মিত হচ্ছে। মাতারবাড়ী পোর্ট চট্টগ্রাম বন্দরের সীমার মধ্যে। তাই নতুন এ বন্দরটি চট্টগ্রাম বন্দরের অধীনে পরিচালিত হবে।
মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্ল্যানিং এন্ড অ্যাডমিন) জাফর আলম এ প্রকল্পের পরিচালক। প্রজেক্টের জাপানি কনসালটেন্ট নিপ্পন কোয়েই (Nippon Koei) এর টিম লিডার হোতানি। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পে প্রথম ধাপে ডিজাইন, সিভিল ওয়ার্ক হবে। দ্বিতীয় ধাপে হ্যান্ডলিং ইক্যুইপমেন্ট সংগ্রহ করা হবে। ভূমিকম্পের বিষয়টি মাথায় রেখে সর্বাধুনিক জাপানি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে এ প্রকল্পে। বন্দর চালু হওয়ার এক বছর পর্যন্ত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগীতা দেবে। আর ওরিয়েন্টাল কনসালটেন্ট গ্লোবাল কোম্পানি প্রকল্পের (বন্দর সংযোগ সড়ক অংশ) সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের কার্যক্রম-সংক্রান্ত পরামর্শ দেবে।
মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য মাটি আনতে গিয়ে ১৪ মিটারের বেশি খনন করতে হচ্ছে। এই গভীরতায় বড় বড় জাহাজ আসতে পারবে এবং একটি গভীর সমুদ্র বন্দর (ডিপ সি পোর্ট) করা সম্ভব। এই সুযোগটিই কাজে লাগিয়ে মাতারবাড়ি প্রকল্পে একটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করছে সরকার। এটা করছে জাপানীরা। এই সি পোর্টটা মাতারবাড়ি প্রকল্পের পরিকল্পণার মধ্যেই ছিল।
মাতারবাড়ি প্রকল্পে ২৪ হাজার মেঘাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্র হবে। মূলত ১ হাজার৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য জেটি নির্মাণ করতে গিয়েই মাথায় আসে সেটিকে গভীর সমুদ্র বন্দরে রূপ দেয়ার। কিন্তু করোনা জটিলতার কারণে গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে বন্ধ হয়ে যায় সব ধরনের কাজ। এখানে আরো তৈরি করা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু ইকোনমিক জোন। এই ইকোনমিক জোনে ইতোমধ্যে গাড়ি নির্মাণ কোম্পানি, বিদেশী ওষুধ কোম্পানিসহ নানা ধরনের শিল্প গড়ার অনুমতি নিয়েছে বিদেশীরা। চীনা ব্যবসায়ীরাও সেখানে বড় বড় কারখানা তৈরি করছে। মাতারবাড়ি প্রকল্পে গ্যাস পাইপ লাইনের সংযোগ দেয়া হয়েছে। এ জন্য সস্তায় সিএনজি অথবা এলএনজি আনতে পারবো দেশের অভ্যন্তরে। এ প্রকল্পটির জন্য ৩৩ ফুট উঁচু বাঁধ দেয়া হয়েছে। এতো উঁচু বাধ দেয়ার কারণে সমুদ্রের পানি উঠবে না। আবার অনেক জমি পাওয়া গেছে। বিশ্ব বাণিজ্যের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে সক্ষমতার দিক থেকে হিমশিম খাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর। প্রয়োজনের তুলনায় সীমিত জনবল এবং যন্ত্রপাতি দিয়ে এই বন্দরকে বছরে ৩০ লাখের বেশি কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করতে হচ্ছে। এই অবস্থায় জরুরি হয়ে পড়ে বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের। আর গভীর সমুদ্র বন্দরের জন্য প্রথম পছন্দের তালিকায় রয়েছে মাতারবাড়ির নাম।
দেশের মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের ৯২ ভাগ চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে সম্পন্ন হয়। যে গতিতে ব্যবসার প্রবৃদ্ধি বাড়ছে তাতে চট্টগ্রাম বন্দর তার সক্ষমতার শেষ পর্যায়ে এসে গেছে। তাই সরকার ২০১৪ সালে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। গত ২৩ সেপ্টেম্বর পরামর্শক সংস্থার সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর গত ১৬ নভেম্বর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রকল্প উন্নয়নের কাজ শুরু হলো। এ বন্দরের কল্যাণে ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত যে অর্থনৈতিক বেল্ট গড়ে উঠছে- তা আরো বেগবান হবে।
চট্টগ্রাম বন্দরে চীন থেকে জাহাজ এসে পণ্য খালাস করতে যে সময় লাগে মাতারবাড়ী বন্দরে সেই সময় ৩ দিন কমে আসবে। চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে দ্বিগুন ড্রাফটের জাহাজ ভিড়ার সক্ষমতা থাকায় এই বন্দরে ৮ থেকে ১০ হাজার কন্টেইনারবাহী জাহাজ ভিড়তে পারবে। এতে পণ্য পরিবহনের ব্যয় কম হওয়ায় ব্যবসায়ীরা উপকৃত হবেন। প্রাথমিকভাবে ৮ লাখ কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করার লক্ষ্যে নকশা করা হচ্ছে। পরে জেটি বাড়লে সক্ষমতা বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে সম্প্রতি এই বন্দরের জাহাজে ভেড়ানোর জন্য প্রায় ১৫ কিলোমিটার এলাকা ড্রেজিং করে তৈরি করা হয়েছে দু'কিলোমিটার দীর্ঘ নতুন চ্যানেল। ১৬ মিটার গভীর এই চ্যানেলে ঢুকতে পারবে যে কোনো আকৃতির জাহাজ। সাগরে বাঁধ দিয়ে যেমন চ্যানেল তৈরি করা হয়েছে। তেমনি সাগরের মাটি দিয়েই তৈরি করা হচ্ছে এই বন্দরের ভূমি ব্যবস্থাপনা। প্রথম পর্যায়ে এই বন্দরে তিনটি জেটি থাকবে। তবে নতুন এই বন্দরকে কার্যকর করতে কন্টেইনার পরিবহনের জন্য বিশেষায়িত সড়ক ও রেলপথ নির্মাণে তাগিদ দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকা, বাংলাদেশ সরকার ও চট্টগ্রাম বন্দরের অর্থায়নে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ২০২৬ সালে অপারেশনে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে শুরু হওয়া নির্মাণ কাজে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি দিচ্ছে জাইকা। চার হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকার এবং ৩ হাজার কোটি টাকা দেবে বন্দর কর্তৃপক্ষ। বঙ্গোপসাগর উপকূলে বানানো হচ্ছে জাহাজ চলাচলের কৃত্রিম নৌপথ বা চ্যানেল। এই নৌপথে এখন বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম খননযন্ত্র ক্যাসিওপিয়া–ফাইভ বালু–মাটি খুঁড়ে চলেছে। ঢেউ আর পলি জমা ঠেকাতে সাগরের দিকে নৌপথের দুই পাশে পাথর ফেলে তৈরি হচ্ছে স্রোত প্রতিরোধক পাথরের বাঁধ। তাতে এখনই সাগরের নীল পানি। সাগর থেকে এই নৌপথে ঢোকার মুখে হাতের ডানে নির্মিত হবে টার্মিনাল। নামে মাতারবাড়ী টার্মিনাল হলেও বাস্তবে বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পিত গভীর সমুদ্রবন্দর।
আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা পেলে বাংলাদেশে যে বিশ্বমানের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হতে পারে, তার উদাহরণ মাতারবাড়ী। অবশ্য মাতারবাড়ী বন্দরের কার্যক্রম এগিয়ে যাওয়ার মূল কারণ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নৌপথ খনন করে আমদানি করা কয়লা খালাসের টার্মিনাল নির্মিত হচ্ছে। একই নৌপথ ব্যবহারের সুবিধা কাজে লাগিয়ে মাতারবাড়ী বন্দরের টার্মিনাল নির্মাণের পথও সুগম হয়েছে। জাপানের কাশিমা বন্দরের আদলে তৈরি করা হচ্ছে এই বন্দর। ১৯৬২ সালে কাশিমা বন্দরের যখন নির্মাণকাজ শুরু হয়, তখন সেখানে ছিল ধানখেত। তবে বন্দর নির্মাণের পর সেটি ব্যবসা–বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। বিশ্বের বড় বড় ব্যবসাকেন্দ্র গড়ে উঠেছে বন্দর ঘিরেই। মাতারবাড়ী বন্দর ঘিরে এই অঞ্চলের ব্যবসা–বাণিজ্য গড়ে উঠবে। মাতারবাড়ী বন্দর নির্মাণের প্রাথমিক পরিকল্পনায় প্রথম ধাপে রয়েছে দুটি টার্মিনাল। সাধারণ পণ্যবাহী ও কনটেইনার টার্মিনালে বড় জাহাজ (মাদার ভ্যাসেল) ভিড়তে পারবে, যেটি এখন বাংলাদেশের কোনো বন্দর জেটিতে ভিড়তে পারে না। প্রথম ধাপে বন্দর ও পণ্য পরিবহনের জন্য সড়ক নির্মাণসহ খরচ ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। প্রথম ধাপের কাজ শেষ হতে সময় লাগবে ২০২৬ সাল। দ্বিতীয় ধাপে নির্মিত হবে তিনটি কনটেইনার টার্মিনাল। এভাবে পর্যায়ক্রমে বাড়ানো হবে টার্মিনাল। ইতোমধ্যে ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার লম্বা চ্যানেল তৈরির ৯০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এখনই চ্যানেলের গভীরতা ১৬ মিটার। তা সাড়ে ১৮ মিটারে উন্নীত করা হবে। যেটুকু খনন হয়েছে, তাতে এখনই ১৫ মিটার গভীরতার জাহাজ ভেড়ানো সম্ভব। বিদ্যুৎ প্রকল্পের যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম খালাসের জন্য আগেভাগে চ্যানেল তৈরির কাজ শেষ করা হচ্ছে।
পায়রা, মাতারবাড়ী ও বে টার্মিনাল নামে তিনটি আলাদা বন্দর তুলনা করে দেখা যায়, বন্দর সুবিধায় সবচেয়ে এগিয়ে আছে মাতারবাড়ী। দেশে সমুদ্রপথে আমদানি বাণিজ্য সবচেয়ে বেশি হয় চীনের সঙ্গে। মাতারবাড়ী বন্দর হলে চীন থেকে সরাসরি বড় কনটেইনার জাহাজ ভেড়ানো সম্ভব হবে। চট্টগ্রাম বন্দরে এখন গড়ে প্রতিটি জাহাজে ১ হাজার ৮৭৮টি কনটেইনার পণ্য আনা-নেওয়া হয়। মাতারবাড়ীতে চট্টগ্রাম বন্দরে চলাচলকারী চারটি জাহাজের সমান কনটেইনার আনা-নেওয়া করা যাবে এক জাহাজে। বন্দর সুবিধা অনুযায়ী ১৪-১৫ হাজার একক কনটেইনারবাহী জাহাজ ভেড়ানো যাবে।
মাতারবাড়ী বন্দর নির্মাণের জন্য প্রকল্প উন্নয়ন প্রস্তাব এখন পরিকল্পনা কমিশনে অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। প্রকল্প অনুমোদন হওয়ার পর দ্রুতই পরামর্শক নিয়োগ করা হবে বলে প্রকল্প কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। আবার বন্দরের অংশে স্রোত প্রতিরোধক, নৌপথ খনন ও প্রশস্তকরণের কাজ কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঠিকাদারের মাধ্যমে করানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজের সঙ্গে পরোক্ষভাবে মাতারবাড়ী বন্দরের কাজও এগিয়ে যাচ্ছে।
লেখক : মো.আবুল বশার, পিআইডি, চট্টগ্রাম।
Developed By Muktodhara Technology Limited