image

এসি আকরামের জবানবন্দিঃ দেশের প্রথম হেরোইনের চালান আটক

image

আশির দশকের মাঝামাঝি। পেশাগত দক্ষতায় একের পর এক কাজের সাফল্যে পদোন্নতি পেয়ে সহকারী কমিশনার হন। এরপর থানা থেকে ডিবিতে যোগদান করেন। পুলিশ প্রশাসনে কাজ পাগলা অফিসার হিসেবেই তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। প্রতিদিনই কোন না কোন অভিযানে অপরাধী গ্রেফতার করছেন। দেশে তখন সামরিক শাসন চলছে। ঘরোয়া রাজনীতির অনুমতি মিললেও প্রকাশ্য রাজনীতি না থাকায় সংবাদমাধ্যমগুলোর ফোকাস ছিলো শুধুই অপরাধ ও গ্রেফতারের সংবাদের উপরই। সাত্তার সরকারের সময় থেকেই একে একে সন্ত্রাসী আটকে আকরাম হোসাইন আলোচনায় উঠে এসেছিলেন। তার দাপটে ঢাকার সন্ত্রাসীরা কোনঠাসা ও অসহায় হয়ে গিয়েছিলো। ঢাকা শহরে তার সঙ্গে সর্বস্তরের মানুষের একটি ভালবাসার সেতুবন্ধন রচিত হয়েছিলো। অপরাধ প্রতিরোধ ও আটকে তাকে সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে নানা তথ্য সংবাদ দিয়ে মানুষ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো। এর মধ্যেই তার কাছে সংবাদ আসলো মাদকের নতুন নেশা হেরোইন বা ব্রাউন সুগারের চালান নিয়ে দুই পাকিস্তানি ঢাকায় একটি আবাসিক হোটেলে অবস্থান করছে।

ঢাকায় এধরণের নেশা কারো কাছ থেকে আটক না হওয়ায় এই নতুন মাদক সম্পর্কে সবাই অপরিচিত হলেও নেশার বিস্তার ঘটতে শুরু করেছিলো বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায়। যদিও মরণনেশা হেরোইনের ছোবল সম্পর্কে একজন পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে আগে থেকেই তার ধারণা ছিলো। তাই ঢাকায় হেরোইনের প্রবেশ ও পাকিস্তানির অবস্থানের বিষয়টিকে তিনি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে খোঁজখবর শুরু করেন। সোর্সের সংবাদের সত্যতাও পেয়ে গেলেন। ঢাকার রমনা থানা এলাকার মগবাজারে হোটেল সুরমা আবাসিক হোটেলে ওই দুই পাকিস্তানি অবস্থান করার বিষয়টি নিশ্চিত হলেন। পরদিনই সহকর্মীদের নিয়ে হোটেলের চার পাশে নজরদারি শুরু করলেন।হোটেল ম্যানেজারের কাছ থেকে জানতে পারলেন পাকিস্তানরা (যতটুকু মনে করতে পেরেছিলেন) ২০৯নাম্বার রুমটিতে অবস্থান করছে।সারাদিনই তারা রুমে থাকে। খুব একটা বের হননা। আশেপাশের রুমে সাদা পোশাকে ডিবি সদস্যরা বোর্ডার সেজে অবস্থান করছিলেন। টার্গেট ছিলো মাল ডেলিভারির সময় দেশীয় মাদক ব্যবসায়ীসহ হাতেনাতে আটক করা। কিন্তু ঘন্টার ঘন্টা পেরিয়ে রাত হয়ে আসতেও মাল নিতে কেউ আসছিলো না। তাই তাদের কাছে যে, মরণনেশা হেরোইনের চালান আছে এটাও শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছিলো না। পাকিস্তানিদের রুমে খাবার নিয়ে যে বয়গুলো যাতায়াত করে তাদের কাছ থেকে জানতে পারলেন ওরা রুমের ভিতরে যেতে দেয় না। ওরা দরজা খুলে নিজেরাই খাবার ভেতরে নিয়ে যায়। মাত্র দুই দিন তাদের অবস্থান হলেও একজন হুজুর ছাড়া আর কেউ তাদের সঙ্গে দেখা করেননি। জানতে পারলেন এসি আকরাম হোসাইন। ৮/১০ঘন্টায় তিনিও আসছেন না। রাত গভীর হওয়ার আগেই সিদ্ধান্ত নিলেন অপারেশনের। রুম নাম্বার ২০৯। বারান্দা, হোটেলের পেছনেসহ সাদা পোশাকে ঘিরে রাখলেন হোটেল সুরমা।হোটেলের বয়দের দিয়ে দরজা নক করালেন। পাকিস্তানি দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে তাদের রুমের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুই পাকিস্তানিকে আলাদা আলাদা বসিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন। তারা এক পর্যায়ে স্বীকার করলেন পাকিস্তান থেকে মাদক নেশা হেরোইন আনার কথা।তাদের কক্ষে তল্লাশি চালিয়ে মাসকিন টেপ দিয়ে মোড়ানো বড় বড় দুটি প্যাকেটে উদ্ধার করা হলো মাদক হেরোইন। আটক করা হলো দুই পাকিস্তানি নাগরিককে। ল্যাবে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হলেন আটককৃত দুই প্যাকেট মাদক নেশা হেরোইন, যা ব্রাউন সুগার নামে পরিচিত। দেশের বৃহৎ প্রথম মাদক হেরোইনের চালান।

পরদিন মরণনেশা হেরোইন আটকের সংবাদ শিরোনাম হয়ে উঠলো সংবাদপত্রগুলোতে। দেশে প্রথম মরণনেশা হেরোইন আটকের ঘটনা এভাবেই বর্ণনা করছিলেন এসি আকরাম হোসাইনই। পরে দুই পাকিস্তানির মধ্যে আজিজ খানকে জিজ্ঞাসাবাদ ও অনুসন্ধান চালিয়ে বাড্ডা ও টঙ্গি থেকে মওলানা মতিন নামে একজনকে আটক করা হয়। জিজ্ঞাবাদে মতিন জানিয়েছিলেন, তাকে দোভাষী হিসেবে তারা রেখেছিলো। কিন্তু এই হেরোইনের বিষয়ে সে কিছুই জানেন না এবং তার সাহায্যে বাংলাদেশের কারো সঙ্গে গত দুই দিনে কথা হয়নি। 

দেশের সর্বপ্রথম হেরোইনের চালান আটকের স্বীকৃতি স্বরূপ দুবাইতে ৮৮টি দেশের মাদক বিরোধী সম্মেলনে কান্ট্রি চীফ হিসেবে আকরাম হোসাইন বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ওই সম্মলনে পাকিস্তান থেকে এসেছিলেন একজন ডিআইজি। আদালতের অনুমতি নিয়ে ঢাকায় ডিবি অফিসের পেছনের খোলা জায়গায় গর্ত করে ম্যাজিষ্ট্রেট ও পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে হেরোইন ধ্বংসের ছবিটি তার সাফল্যের স্মৃতি টুকু মনে করিয়ে দিয়েছিলো।