image

এসি আকরামের জবানবন্দিঃ ইমদু গ্রেপ্তারে বেরিয়ে আসলো অপরাধ জগতের লোমহর্ষক ঘটনা

image

মাত্র একমাসের মধ্যেই কুখ্যাত খুনী গালকাটা কামাল, মন্ত্রী’র বাড়ি থেকে ইমদুসহ আরো কয়েকজন সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করেছিলেন তৎকালীন লালবাগ থানার ওসি আকরাম হোসাইন। খোদ সরকারি দলের যুব নেতা ও সরকারের মন্ত্রীর বাড়ি থেকে কুখ্যাত দুই আসামিকে গ্রেফতার করে আকরাম হোসাইন আলোচিত হয়ে উঠেন। অসীম সাহসীকতার সঙ্গে এই দুই শীর্ষ খুনীকে গ্রেফতারের পর আকরাম হোসাইন ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের জনপ্রিয় টিভি ব্যক্তিত্ব সাংবাদিক ফজলে লোহানীকে জিয়াউর রহমান পুরষ্কারের ভূষিত করা হয়। ফজলে লোহানী তৎকালীন সরকার নিয়ন্ত্রিত বিটিভির যদি কিছু মনে না করেন অনুষ্ঠানের অনুসন্ধানী রিপোর্টে ইমদুর অপরাধ জগতের উপর একটি প্রতিবেদন প্রচার করেছিলেন।

২৩ মার্চ ৮২তে তাদের দুজনকে জিয়াউর রহমান জাতীয় পুরষ্কারে ভূষিত করা হয়। এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই পদক প্রদান করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শাহ্ আজিজুর রহমান। বিচারপতি সাত্তার সরকারের সময়ে সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রচার মাধ্যমে এমন দুই ব্যক্তিকে পুরষ্কৃত করার মাত্র একদিন পরই ৮২’র ২৪ মার্চ সেনাপ্রধান হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদ বিচারপতি সাত্তার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে দেশে সামরিক শাসন জারি করেছিলেন। তাই রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন ছিলো সরকারি দলের নেতা ও মন্ত্রীর বাসভবন থেকে খুনীদের গ্রেফতারের পেছনে তৎকালীন সেনাশাসক হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদের খেলা ছিলো। ক্ষমতা দখলের জন্য এরশাদ এই গ্রাউন্ড তৈরী করেছিলেন। বয়োজ্যেষ্ঠ বিচারপতি আব্দুস সাত্তার সন্ত্রাস, দূর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়ে এরশাদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়েছিলেন, এরশাদ এমনটাই দাবি করেছিলেন।

এ প্রসঙ্গে এসি আকরাম হোসাইন বললেন, এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণের পেছনে কুখ্যাত সন্ত্রাসী-খুনীদের আটকের কোন সম্পর্ক ছিলো কিনা সেটা আমার জানা নাই। তবে জিয়াউর রহমানের সময়ের অবসরপ্রাপ্ত আর্মি অফিসার মোস্তাফিজুর রহমানকে সরিয়ে ডাঃ মতিনকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী করার পর থেকেই কুখ্যাত অপরাধীদের গ্রেফতারের বেশ তোড়জোড় শুরু হয়। মন্ত্রী-এমপিরা কোথাও প্রভাব বিস্তার বা অপরাধী গ্রেফতার করলে তদ্বির করছিলেন না। বিষয়টি আমার কাছে কেমন অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিলো। ভাবছিলাম দেশটা মনে হয় ভাল হয়ে যাচ্ছে। মহান আল্লাহর নিকট দোয়া করছিলাম রাজনৈতিকদের হেদায়েত করার জন্য। তবে এতো দ্রুত সেনাশাসন চলে আসবে তা ভাবনায় ছিলো না।

তিনি বললেন, কুখ্যাত সন্ত্রাসী ইমদু কালিগন্জ, নরসিংদী, টঙ্গী, জয়দেবপুর এলাকার মানুষের কাছে এক মূর্তিমান আতংকের নাম ছিলো। মূলত ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার এএফএম মাহমুদ আল ফরিদ তাকে নিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ শুরুর পরই বের হয়ে আসতে শুরু করে সব লোমহর্ষক হত্যাকান্ডের মর্মস্পর্শী বিবরণ। প্রকাশ্য দিবালোকে এই ধরণের হত্যাকান্ডের বর্ণনা শুনে আঁতকে উঠেছিলেন পুলিশের কর্মকর্তারাও। শুধু মাত্র প্রতিহিংসার কারণেই ইমদু তারই গুরু জাসদের শ্রমিক নেতা আলী হোসেন ও তার ভগ্নীপতিসহ তিন জনকে হত্যা করেছিলেন প্রকাশ্যে। এই খুনের লোমহর্ষক ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিলো কালিগন্জ মসলিন কটন মিলের শ্রমিকরা। তাদের কাছে ইমদু ছিলো এক মানুষরুপী ভয়ংকর দানবের নাম। বিভিন্ন সংবাদপত্রে ইমদুর এই হত্যাকান্ডের বর্ণনা প্রকাশ হতে শুরু করলে তৎকালীন বিটিভির জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান "যদি কিছু মনে না করেন'" অনুষ্ঠানের উপস্থাপক টিভি ব্যাক্তিত্ব সাংবাদিক ফজলে লোহানী অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে ইমদুর হাতে নিহত পরিবারগুলোর মর্মস্পর্শী বেদনার কথা দেশবাসীর কাছে তুলে ধরেছিলেন।

পুলিশ অফিসার আকরাম হোসাইন বলছিলেন, ইমদুকে জিজ্ঞাসাবাদে প্রতিটি হত্যাকান্ডের কথাই স্বীকার করেন। নরসিংদির মজিদ হত্যার মামলায়ই মূলতঃ তৎকালীন ঢাকা জেলার এসপি মাহমুদ আল ফরিদ তাকে গ্রেফতার করতে এসেছিলেন। এই হত্যাকান্ডের জিজ্ঞাসাবাদেই ইমদু তার উত্থানের সব ঘটনা প্রকাশ করতে শুরু করে।

সাংবাদিক ফজলে লোহানী তার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বের করে আনেন, কিভাবে ইমদু মানুষ খুন করে তার মাথা কেটে সেই মাথা নিয়ে ফুটবল খেলতেন। ওই সময়ে সারাদেশে এই প্রতিবেদন তোলপাড় সৃষ্টি করেছিলো। ১৯৮২ সালের মার্চ মাসেই খোদ সরকার নিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশ টেলিভিশনে এমন প্রতিবেদন দেখে দেশবাসীর বিস্মৃত হয়েছিলেন। সারাদেশ ফুঁসে উঠে ইমদুর ফাঁসির দাবিতে।

আকরাম হোসাইন বলছিলেন, আমার নিজের কাছেও বিশ্বাস হচ্ছিল না, কিভাবে মানুষ এভাবে মানুষকে খুন করতে পারে। আকরাম হোসাইন বললেন, আমার চাকরি জীবনে ইমদু ও গালকাটা কামালের মতো এমন ভয়ংকর খুনী আর দেখিনি। এমন ভয়ংকর খুনীদের গ্রেফতার ও পরর্বতীতে তাদের ফাঁসি হওয়ায় জনমনে স্বস্তি এসেছিলো।