image

এসি আকরামের জবানবন্দিঃ কয়েক ঘন্টার মধ্যেই তাপস খুনের আসামী গ্রেপ্তার

image

ঘটনার সময়কাল ১৯৯৮। মার্চের শেষ সপ্তাহ। পুরান ঢাকার হাজারীবাগের কোম্পানি ঘাটস্থ চামড়া রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ইমেক্সিন ট্রেডিংয়ের সিলেক্টার ফখরুল ইসলাম তাপস দু’দিন ধরেই অফিসে আসছেন না। ছুটিও নেননি। প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার নুরুল ইসলাম পারভেজ এরই মধ্যে স্বপ্নের ঠিকানা ছবিটি প্রযোজনা করে সিনেমা পাড়ায় খ্যাতি পেয়েছেন। পাশাপাশি হাজারীবাগের চামড়া শিল্পেও একজন ভাল রপ্তানিকারক হিসেবে দেশ-বিদেশ তিনি সুনাম অর্জন করেছেন। তার প্রতিষ্ঠানের সিলেক্টার দুদিন অফিসে অনুপস্থিত। বিষয়টিকে তিনি গুরুত্ব দিয়ে তারই অফিসে তাপসের সহকর্মী সোহেলকে দায়িত্ব দিলেন তাপসের খোঁজ-খবর নিতে।

অবিবাহিত তাপস একাই থাকতেন ঝিগাতলা গাবতলা মসজিদ এলাকার বিপরীতের গলির একটি ফ্লাটের ২য় তলার সাব-লেট হিসেবে।দু’দিন ধরে বাড়িতেও ফিরেননি বলে তার পাশের রুমের প্রতিবেশীরা সোহেলকে জানালেন। তার গ্রামের বাড়ি ব্রাক্ষণবাড়িয়ার ছোট কুমিরায়। তার মা, ভাই স্বজনসহ ঢাকার সব বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সোহেল জানতে পারলেন তাপস কোথাও যায়নি। সবার মনেই গভীর উদ্বেগ উৎকন্ঠা। যে ছেলে বন্ধুদের প্রতিদিনই জানাতো সে কখন কোথা, কার সঙ্গে আছে অথচ দু’দিন ধরেই তার কোন খোঁজ নেই। বন্ধুরা যার যার সাধ্যমতো খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। এরই মধ্যে তাপসের ভাই ঢাকায় চলে এসেছেন ভাইয়ের খোঁজে। কারো সঙ্গে কোন শত্রুতাও নেই। কাকে কেন সন্দেহ করবেন। সোহেলের জানা ছিলো তাপস মীরপুর সনি সিনেমা হলের পেছনের একটি মার্কেটে এক বন্ধু’র সঙ্গে পাটনারে সেলাইয়ের কারখানা দিয়েছেন। সেখানে তার একলাখ টাকা বিনিয়োগ আছে। তাপসের পাটনারের সঙ্গে সোহেল যোগাযোগ করলেন, সেখানেও যায়নি। তারাও তার নিখোঁজে চিন্তিত। সবার মধ্যেই উৎকন্ঠা। তাপস তাহলে গেল কোথায়? কেনই বা সে নিখোঁজ হবে ?

এদিকে চামড়া রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ইমেক্সিনের মালিক নুরুল ইসলাম পারভেজও বেশ চিন্তিত। কারণ কেউ শত্রুতা করে তাকে ব্যবসায় পিছিয়ে দিতে চামড়ার সিলেক্টারকে গুম করে দেয়নি তো? নাকি তাপসের পাটনারই তাকে গুম করলো? গ্রামের বাড়িতে তাপসদের বাবার সম্পত্তি নিয়ে চাচাতো ভাইদের সঙ্গেও বিরোধ আছে। প্রতিষ্ঠানের মালিক, বন্ধু ও তাপসের স্বজনদের মনে এমন নানামুখী প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।

এদিকে তাপসের চাচাতো ভাইরা তাপসের প্রতিষ্ঠানের মালিকের দিকেও সন্দেহের আঙ্গুল তুলছে। এর মধ্যেই তাপসের সহকর্মী সোহেলের কাছে খবর আসলো দুই দিন আগে মীরপুর বেড়ীবাঁধ এলাকার ডোবা থেকে এক অজ্ঞাত যুবকের লাশ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের মর্গে পাঠিয়েছে। তাপসের ভাই, মিরপুরের পাটনারও লাশটি দেখে এসেছেন কিন্তু সনাক্ত করার অবস্থা নেই। লাশটি বিকৃত ও পচন ধরেছে।বলে রাখা দরকার, অফিসে সোহেল তাপসকে চাচা বলে সম্বোধন করলেও তাপস সোহেলকে বলতো ভাগ্নে। এর মধ্যেই সোহেলের সঙ্গে দুইদিন আগে শেষ দেখার সময় তাপস বলেছিলো ভাগ্নে আজ একজনের সঙ্গে দেখা করতে যাবো। সঙ্গে সোহেলকেও নিয়ে যাতে চেয়েছিলো। কিন্তু সোহেল জানালো বস (পারভেজ ভাই) এর তিন লাখ টাকার চেক তুলে টাকা পৌঁছে দিতে হবে, তাই এতো টাকা সঙ্গে নিয়ে তাপসের সঙ্গে যেতে অপারগতার প্রকাশ করে। তখন তাপস সোহেলকে একটি অনুরোধ করলো, তাহলে আমার হাতের নকগুলো একটু কেটে দাও। অফিসে বসেই সোহেল তাপসের নক কেটে দেয়। সেই দুজনের শেষ কথা ও  দেখা। কিন্তু তাপস কোথায় যাবে কিছুই বলে যায়নি। তার সঙ্গে থাকা অফিসের পেজারটিও সোহেলের কাছে রেখে যায়। সেই থেকেই নিখোঁজ। এবার তাপসদের সহকর্মী সোহেল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের মর্গে। জীবনে কখনো মর্গে আসেননি।এবার অফিসের সহকর্মী ও বসের নির্দেশের কারণে গত দুই দিন মটরবাইকে ঢাকা শহর চষে বেড়িয়েছেন নিখোঁজ সহকর্মী তাপসের খোঁজে। এবার লাশ কাটা ঘরে। যেখানে হতভাগাদের নিথর দেহ পড়ে থাকে। দুরুদুরু বুকে সোহেল কাঁপছে আর মনে মনে বলছে হে আল্লাহ, তাপসকে যেনো এই নিথর দেহের স্তুপে খুঁজে না পাই।

ময়নাতদন্ত শেষে কয়েকটি লাশ কাটা চেরার পর ফেলে রাখা হয়েছে। বেশ কয়েকটি লাশ স্তুপ করে রাখা। সোহেলের রক্ত হিম হয়ে আসছিলো। মানুষের পচা দুর্গন্ধ অসহ্য লাগছিলো তার কাছে। কয়েকটি লাশ এক সঙ্গে। এর মধ্যে সোহেলের নজর কোন লাশের শরীর বা মুখমন্ডলে নয়, হাতের দিকে। হ্যা, এই তো সেই হাত, দুইদিন আগে সে নকগুলো কেটে সমান করে দিয়েছিলো। এ যে তাপসেরই লাশ। ফুলে পচে গিয়েছে। মুখ চেনা কষ্টকর হলেও তার সহকর্মী তাপসকে সোহেল সনাক্ত করলো। অজ্ঞাত লাশের পরিচয় মিললো।

মীরপুর থানা পুলিশকে খবর দেয়া হলো, এই লাশ আর অজ্ঞাত নয়। মর্গেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন গ্রাম থেকে আসা তাপসের ভাই-বন্ধুরা। মূহুর্তে লাশকাটা ঘরের আশপাশে থাকা বন্ধু- স্বজনদের আহাজারি। কে মারলো, কেন তাকে হত্যা করা হলো? নানা প্রশ্ন তাদের মনে।

মর্গের দায়িত্বরতরা জানালেন, গতকালই আমরা অজ্ঞাত লাশগুলো দাফনের জন্য আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের স্বেচ্ছাসেবক ডেকে এনেছিলাম। কাফনের কাপড় কম হওয়ায় এই লাশটি আর তারা নিয়ে যায়নি। আজই তাদের আসার কথা। আপনারা আর একটু পরে  আসলে হয়তো এই লাশ আর পেতেন না। অজ্ঞাত হিসেবেই দাফন হয়ে যেতো। ভাই হারা, বন্ধু হারা ও অফিসের সহকর্মী হারা হলেও এদিক থেকে নাকি ওরা ভাগ্যবান বলছিলো মর্গের ডোম। লাশের সুরতহাল রিপোর্টে হত্যার আগে তাপসকে শারীরিক নির্যাতনের বিবরণ আছে। সেই সঙ্গে বুকের মধ্যে কামড়ের চিহ্ন আছে। যা প্রতিহিংসার আলামত। অনেক ক্ষোভ থেকেই তাকে হত্যা করা হয়েছে।

মীরপুর থানাপুলিশ এমন আশংকা করলেও তারা মামলার কোন ক্লু পাচ্ছিলেন না। বরং থানায় নিহত তাপসের চাচাতো ভাইয়েরা সন্দেহের আঙ্গুল তুলছিলেন তাপসের চাকরি করা প্রতিষ্ঠানের দিকে। সহকর্মী সোহেলের সন্দেহের আঙ্গুল তুলছেন তাপসের ব্যবসায়ীক পাটনারের দিকে। কারণ তাপসের লাশ তো মীরপুরেই পাওয়া গেছে। তাপসের ভাই কাউকেই সন্দেহ করতে পারছিলেন না, কারণ তারা থাকনে গ্রামে আর তাপস থাকতো ঢাকায়। সব মিলিয়ে থানাপুলিশ এক ধূম্রজালে। তাপসের ভাইকে সঙ্গে নিয়ে তার বন্ধু ও সহকর্মীরা ২৯ মার্চ ৯৮ ভোররাতে তাপসের গ্রামের বাড়িতে  ফজরের নামাজের পর তার লাশ দাফন করেন।

চলবে.........