'আমি' সবার ভিতরের কর্তা। 'আমি' সকলের মাঝে থাকা সত্তা। 'আমি নিত্য'। 'আমি' সত্য। 'আমি' একক। 'আমি' অদ্বিতীয়।
কিন্তু 'কে আমি' তার কতটুকু জানি!
এই আমার আমিকে চেনার তাগিদ দিয়েছিলেন সক্রেটিস। বলেছেন— Know Thyself, ‘নিজেকে জানো’। এতটুকু কথা আলোড়ন তুলেছিল তাঁর কালে এবং এখনো এই জানা বেশ প্রাসঙ্গিক। সক্রেটিসের মূল কথাটা হলো-‘টু নো দাইসেলফ ইজ দ্য বিগিনিং অব উইজডম।' এই এফোরিজমের মানে, নিজেকে জানার মধ্য দিয়ে বিশেষ জ্ঞান পাওয়া শুরু হয়।
এরপর আরো আধুনিক চিন্তাবিদ দেকার্তে বললেন—‘আমি ভাবি তাই আমি আছি।’ এমন শুনে অন্য একদল তর্ক তুললো— না, বরং ‘আমি আছি তাই ভাবি।’ সবমূলে আসলে একটা 'আমি'।
জানা বা সাধনার মূলে প্রথম যে প্রশ্নটি আসে সেটি হলো-আমি কে? এই 'আমি'-কে জানার আগ্রহ সেই অনেককাল থেকেই।
সুফি দরবেশ ইমাম হাসান বসরী বলেছেন “যে নিজেকে জেনেছে, সে প্রভুকে জেনেছে”।
সাধক হাছন রাজা বলে গেছেন,' 'বিচার করি চাইয়া দেখি, সকলেই আমি।'
আরেক সাধক লালন সাঁই বললেন—"আমি কী তাই জানলে সাধনসিদ্ধ হয়।"
লালন শাহ একই কথা একটু ভিন্নভাবে বলেছেন, “আত্মতত্ব যে জেনেছে, দিব্যজ্ঞানী সেই হয়েছে"।
সাধক কালাশা ফকীর বলেছেন, “আমি করি আমার আমার, আমি বা কার, করো বিচার”। অর্থাৎ আমি নামের যে সত্তাকে ঘিরে আমাদের এত আয়োজন, সেই আমি কে? আমি কে তা আগে জানতে হবে। নিজেকে জানলেই অপরকে জানা হয়ে যায়। সকলকে জানা যায়।
আর এক সূফী সাধকের ভাষায়, “যা কিছু আছে এই বিশ্ব ভ্রহ্মান্ডে, তার সবই বিরাজে মানব কাণ্ডে!” অর্থাৎ মহাবিশ্বে যা কিছুর অস্তিত্ব আছে, তার সব কিছুরই প্রতিচ্ছবি মানব দেহে বিরাজ করে। শুধু দেখা ও উপলব্ধি করার মত অন্তর্চক্ষু ও মন থাকা চাই।
এই 'আমি' এর তালাশ পাওয়া কতোটা সহজ বা কঠিন?
দিলরুবা খান তালাশ খুঁজতে পাগল মনে গেয়েছেন "আমি বা কে আমার মনটা বা কে?
আজও পারলাম না আমার মনকে চিনিতে।" আর বিদ্রোহী কবি নজরুল কি নিজেকে চিনেই বলে ফেলেছেন-"আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ!"
যা হোক, জগতে যত প্রকার জ্ঞান আছে তার মধ্যে সর্বোত্তম জ্ঞান হলো নিজেকে চেনা। যে একবার সঠিক ভাবে নিজেকে চিনতে পারে, তার জন্য জগতের আর কোনো জ্ঞান বাকি থাকেনা।
তাই সবার আগে নিজেকে চেনার বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। নিজের মাপ ও মান বুঝতে হবে। ‘নিজে ঠিক তো জগৎ ঠিক’ -এই প্রবাদের মতই নিজের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে এগিয়ে যেতে হবে।
সত্যিকারের জ্ঞানী হওয়ার পথে এগুনো সম্ভব তখনই, যখন আমি জানবো যে আমি কি জানি আর জানি না।
সক্রেটিস বক্তৃতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হচ্ছে: ‘জ্ঞানেই পুণ্য’। এই নীতি অনুযায়ী ভালোকে জানা মানেই ভালো কাজ করা। মানুষ খারাপ কাজ করে শুধুমাত্র তার অজ্ঞতার জন্য। যদি জ্ঞানেই পুন্য লাভ হয়, ভালোকেই জানার অর্থ যদি হয় ভালো কাজ করা, তা হলে একজন লোক তখনই কুকর্মে থাকবে যখন সে ভালোকে জানতে ব্যর্থ হবে। এখানেই সক্রেটিস সেই বিখ্যাত উক্তিটি করেন: ‘কেউ স্বেচ্ছায় কুকর্ম করে না।’ ভালো কে জানার পর কেউ স্বেচ্ছায় মন্দ বেছে নেয় না। কিন্তু আমরা প্রায়শই বলি –“জেনেশুনে অন্যয় কাজটি করলাম।” অথবা চাইলেই ভালো কাজটি করতে পারতাম। সক্রেটিসের বিবেচনায় এটা একেবারেই অসম্ভব; যদি কেউ সত্যিই কেউ ‘ভালো’ কে জানে তা হলে সে ভালো কাজটিই করবে ।
মানুষের জন্য কী ভালো এবং কিসে মানুষের সুখ, তার জীবনযাপন পদ্ধতি কী হওয়া উচিত এবং কীভাবে সে সেটা আয়ত্ত করবে তা জানার জন্য প্রথমে মানবচরিত্র বুঝতে হবে। মানুষ যদি তা বোঝার চেষ্টা না করে, যদি কোনো দিন না জানে কোনটি তার জন্য ভালো তাহলে সুখী হওয়ার সমস্ত চেষ্টাই ব্যর্থ হবে। এ ধরনের জীবনকে সক্রেটিস অপরীক্ষিত জীবন বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর অন্যতম বিখ্যাত উক্তি: “অপরীক্ষিত জীবন ভালো জীবন নয়।”
এক ধরনের জানা এরকম যে, প্রত্যেকে তার মাঝে যেসব গুণ আছে, তার কাজ করার ক্ষমতা আছে তা বুঝে নিতে পারা। এই জানা এমন- আপনার ঘনিষ্ঠ কেউ, মা বাবাও নিশ্চিত কিছু বলতে পারবেন না আপনার নিজের এই জানা সম্পর্কে, যতটুকু আত্মবিশ্বাস নিয়ে আপনি আপনার নিজের কাজের ক্ষমতা বোঝেন, অন্য কেউ অতো নিশ্চিত হতে পারে না।
আধুনিক কগ্নিটিভ সায়েন্সও যেন ‘নো দাইসেলফ’-এর কাছাকাছি কিছু বলছে। বলছে, যদি মানুষটি দেখে, তার ব্রেন তাকে অবিরত বোকা বানাচ্ছে, তাইলে বুঝতে হবে সে বাস্তবতা বুঝবার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মজার ব্যাপার হলেও সত্য যে, বোকা হতে হতে সে বাস্তবতা চেনার দিকে যাচ্ছে।
শরীরের সকল শক্তির মৌল চেতনা, যেটি ‘মেট্রিক্স অব অল ম্যাটার’, এই চেতনা, যে-চেতনাকে একটা ইন্টেলিজেন্ট মাইন্ড নিয়ন্ত্রণ করছে বলে মনে করতেন বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্লাংক। সেই চেতনাকে, সেই রুহকে, সেই স্পিরিট-কে, সেই আত্মাকে কতটুকু বুঝতে পেরেছে মানুষ? এই আত্মরূপকে জানার কোনো উপায় কি মানুষের কাছে আছে?
সত্যিই নিজেকে যে জানে না তার পক্ষে আসলে অন্যকে এবং তার পারিপার্শিক অবস্থাকে জানা কঠিন হয়ে পড়ে। আসলে প্রতিটি মানুষেরই কিছু না কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। উপরন্তু প্রতিটি মানুষেরই নানাভাবে পরিশুদ্ধির উপায় আছে। এসব মানলেই কেবল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। তাই প্রতিদিন এমন কিছু কথা আছে যা নিজেকে বলার চেষ্টা করতে হবে।
আর সেসব কথাগুলো কী হতে পারে তার কয়েকটি চিহ্নিত করে প্রকাশ করেছে নামকরা মিডিয়া 'বিজনেস ইনসাইডার'। এসব নিয়েই নিচে আলোচনা করা হলো :
আমি দয়ালু হবো : আপনার সব সময় যে সবার চেয়ে স্মার্ট হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। তার বদলে যখনই সম্ভব হবে দয়ালু হতে হবে। আপনি যখন অন্যদের প্রতি দয়ালু হয়ে উঠবেন তখন অন্যরাও আপনার প্রতি বহুগুণ দয়ালু হয়ে উঠবে।
কখনোই অতিরিক্ত ব্যস্ত হবো না : সফল ব্যক্তিরা কখনোই অতিরিক্ত ব্যস্ত থাকেন না। তারা সর্বদা নিজের কাজকে গুছিয়ে রাখেন এবং নিজের সহকর্মী, বন্ধু ও পরিবারকে যথাযথভাবে সময় দেন।
যা বলতে চাই তা পরিষ্কার করে বলব : অনেকেই মনে যে কথা থাকে বাস্তবে তা প্রকাশ করেন না। এ কারণে বহু মানুষের সঙ্গে সঠিকভাবে যোগাযোগে সমস্যা হয় এবং সম্পর্কে জটিলতা তৈরি হয়। কিন্তু আমরা যদি যা বলতে চাই তা পরিষ্কার করে বলি তাহলে এ জটিলতা এড়ানো যায়।
আমি অদম্য ও ধৈর্যশীল : সাফল্যের জন্য দীর্ঘদিন কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। এক্ষেত্রে ধৈর্য ধরে দীর্ঘদিন চেষ্টা করে যেতে হয়। এক্ষেত্রে দমে গেলে কখনোই সাফল্য পাওয়া যায় না।
আমি সব সময় শিক্ষার্থী : জীবনের সব পর্যায়েই শিক্ষার গুরুত্ব রয়েছে। তাই আপনি যে পর্যায়েই থাকুন না কেন, সব সময় শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী থাকতে হবে।
অন্যের ওপর খবরদারি করব না : আপনি যদি অন্যকে পরামর্শ দিতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করে ফেলেন তাহলে সংযত হোন। আপনার বন্ধুত্বপূর্ণ পরামর্শ যদি খবরদারিতে পরিণত হয় তাহলে তা ত্যাগ করুন।
অন্যের সমালোচনা করব না : সমালোচনা যদি প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে তাহলে ভিন্ন কথা। কিন্তু অপ্রয়োজনে সমালোচনা করলে তা অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করে।
আমি ভুলকে সাদরে গ্রহণ করব : জীবনে চলার পথে ভুল হতেই পারে। কিন্তু এ ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে তারপর সামনে এগিয়ে যাওয়া জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
যে প্রতিশ্রুতি রাখতে পারব না, তা করব না : প্রতিশ্রুতি দেওয়ার চেয়ে রক্ষা করা কঠিন। আমরা অনেকেই এমন সব প্রতিশ্রুতি করি, যা পরবর্তীতে রক্ষা করতে পারি না। এ ধরনের প্রতিশ্রুতি অন্যের বিশ্বাস নষ্ট করে। তাই যে প্রতিশ্রুতি রাখতে পারব না তা কখনোই দেব না।
আমার চরিত্রই আমাকে প্রকাশ করবে : প্রত্যেকেরই নিজের চরিত্র রক্ষা করা অত্যন্ত কঠিন। আপনি যদি নিজের চরিত্র ঠিক রাখেন তাহলে অন্যরাই আপনার গুণগান গাইবে এবং আপনার বিষয়ে তথ্য জানাবে। তাই চরিত্র ঠিক রাখার বিষয়টি প্রতিনিয়ত মনে রাখা উচিত।
লেখক : ফজলুর রহমান, প্রাবন্ধিক এবং সহকারী রেজিস্ট্রার, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)।
Developed By Muktodhara Technology Limited