image

বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া দুদিনের আলোচনায় কোন ফল আসে নি, বঙ্গবন্ধুর জবাব আলোচনা চলবে

image

বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া বিগত দুইদিনের আলোচনায় কোন ফল হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। প্রথম কারণ বঙ্গবন্ধুর চেহারার অভিব্যক্তি। দ্বিতীয়ত, তিনি সাংবাদিকদের আশাব্যঞ্জক কোন তথ্য জানাতে পারেন নি। তবে ভূট্টো যে তার নিজ দেশেও কোনঠাসা হয়ে পড়েছেন তা পাকিস্তানের বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদকীয় থেকে স্পষ্ট হয়। তিনি যে পুরো পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব বা মুখপাত্র হিসেবে দাবী করে আসছিলেন, তাও অসার প্রমানিত হয়। পাকিস্তানের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাও ভূট্টোর এহেন দাবির বিরোধিতা ও প্রতিবাদ করেন।

ইয়াহিয়া-মুজিব ২য় দফা বৈঠক
লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকিবে- শেখ মুজিব

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান বর্তমান রাজনৈতিক সংকট সম্পর্কে আলোচনার জন্য গতকাল (বুধবার) ঢাকায় দ্বিতীয় দফা বৈঠকে মিলিত হন। প্রায় এক ঘন্টা স্থায়ী এই বৈঠকশেষে শেখ সাহেব সাংবাদিকদের জানান, আলোচনা শেষ হইয়া যায় নাই। তবে পরবর্তী বৈঠকের সময় ঠিক হয় নাই- ইহা ‘আজও হইতে পারে, আগামীকালও হইতে পারে।’ আলোচনা ফলপ্রসু হইতেছে কিনা তিনি সে সম্পর্কে কোন মন্তব্য প্রকাশে বিরত থাকেন। তিনি বলেন লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকিবে।
হতকাল সকাল ১০টায় ঢাকাস্থ রপ্রসিডেন্ট ভবনে রূদ্ধদ্বারকক্ষে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এবং শেখ সাহেবের মধ্যে আলোচনা শুরু হয় এবং উহা প্রায় একঘন্টা স্থায়ী হয়। আলোচনাকালে সেখানে কোন তৃতীয় ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন না।
দ্বিতীয় দিনের স্বল্পস্থায়ী বৈঠকশেষে প্রেসিডেন্ট ভবন হইতে বাহির হইয়া আসিলে পূর্ব দিনের মতই বিপূলসংখ্যক সাংবাদিক ও আলোকচিত্রশিল্পী শেখ সাহেবকে ঘিরিয়া ধরেন। এই সময় বঙ্গবন্ধুকে গম্ভীর দেখাইতেছিল। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শেখ সাহেব বলেন, “আলোচনা অব্যাহত রহিয়াছে। ইহার চাইতে বেশি আর কিছু বলার নাই।” তিনি বলেন, ‘আরও আলোচনা হইতে পারে, তবে বৈঠকের সময় এখনও ঠিক হয় নাই- ইহা আজও হইতে পারে, আগামীকালও হইতে পারে।

লক্ষ্য ইতিমধ্যেই হাসিল হইয়াছে- ভাসানী
১৬ই মার্চ ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে “বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমান এবং পশ্চিম পাকিস্তানে জনাব ভ‚ট্টোর নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের” প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাদি গ্রহণের জন্য পিকিংপন্থী ন্যাপ প্রধান মওলানা ভাসানী প্রেসিডেন্টের প্রতি আহ্বান জানান। জনসভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে ুতনি বলেন, ‘স্বাধীন বাংলার’ লক্ষ্য ইতিমধ্যে হাসিল হইয়াছে। বাংলা দেশের জনগণের ঐক্যে গভীর সন্তোষ প্রকাশ করিয়া তিনি কায়েমী স্বার্থবাদী মহলের সর্বপ্রকার হীন চক্রান্ত বানচাল করিয়া দেওয়ার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।

আগামী ২৩শে মার্চ ‘প্রতিরোধ দিবস’ পালনের আহ্বান
‘স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ কর্তৃক কর্মসূচী ঘোষণা

‘স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের’ সদস্য জনাব নুরে আলম সিদ্দিকী, জনাব শাজাহান সিরাজ, জনাব আ. স. ম আবদুর রব, জনাব আবদুল কুদ্দুস মাখন আগামী ২৩শে মার্চ ‘প্রতিরোধ দিবস’ পালন উপলক্ষে বাংলা দেশের প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রী, কৃষক-শ্রমিকসহ প্রতিটি নর-নারীকে নিম্নোক্ত কর্মসূচী বাস্তবায়িত করার আহ্বান জানাইয়াছেনঃ 
সকাল ৬টায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারী-বেসরকারী কার্যালয়, দোকানপাট, যানবাহন, বাসগৃহ ও ছাত্রলীগ কার্যালয়ে ‘স্বাধীন বাংলার’ পতাকা উত্তোলন, সকাল ৬টায় প্রভাত ফেরী, শহীদানদের মাজারে ও শহীদ মিনারে পুষ্পার্পণ, সকাল ৯টায় জয়বাংলা বাহিনীর কুচকাওয়াজ; বিকাল ৩টায় (ঢাকা শহরের জন্য) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্র জনসভা।..

সবার চোখ ঢাকার দিকে
(সম্পাদকীয়) : অবশেষে প্রেসিডেন্ট ঢাকায় আসিয়াছেন এবং নবভাবে আকীর্ণ, বাংলা-নামফলকে শোভিত “প্রেসিডেন্টভবনে’ বহুপ্রত্যাশিত মুচিব-ইয়াহিয়া সাক্ষাৎকার ও আলোচনা গত মঙ্গলবার হইতে আরম্ভ হইয়াছে। সারা দেশের এবং বিদেশেরও দৃষ্টি আজ এই কেন্দ্রবিন্দুতে নিবন্ধ। প্রেসিডেন্ট ভবনের নামের ফলক পরিবর্তন যদি মনের ফলক পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করে, যদি উহা বাস্তব অবস্থার সহিত বর্তমান শাসন-কর্তৃপক্ষের নীতি ও কার্যক্রম খাপ খাওয়াইয়া লইবার সদিচ্ছার পরিচায়ক হইয়া থাকে, তবে তো তাহা খুবই সুখের বিষয়। ‘আয়ওয়ানে সদর’ হইতে ১লা ও ৬ই মার্চ যে সুর শোনা গিয়াছিল সে সুর যদি আর শ্রæত না হয় সত্যসত্যই যদি কর্তৃপক্ষের হৃদয়ের পরিবর্তন হইয়া থাকে, তবে উহা সকলেরই পরম সৌভাগ্য। কিন্তু তৎপরিবর্তে যদি ‘মন না রাঙিয়ে বসন রাঙানোর’ প্রহসনে পর্যবসিত হয়, তবে তাহার চেয়ে ট্রাজিক ও বিয়োগান্তক, বোধ করি, আর কিছু হইবে না। প্রার্থনা করি, সেরূপ প্রহসন যেন অনুষ্ঠিত না হয়।-----।

পশ্চিমা নেতৃত্ব ৬-দফা মানে না, তাই আজ এক দফা-
খুলনার জনসভায় জাতীয় লীগ প্রধান আতাউর রহমানের বক্তৃতা

বাংলা জাতীয় লীগ প্রধান জনাব আতাউর রহমান খান বাংলা দেশে অবিলম্বে স্বাধীন জাতীয় সরকার গঠনের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আহ্বান জানাইয়াছেন। তিনি ১৫ই মার্চ বিকালে (যা ১৮ই মার্চ ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয়) খুলনার মঞদি হাদিস পার্কে খুলনা জেলা আওযামী লীগ আয়োজিত জনসভায় বক্তৃতা দানকালে বলেন যে, বাংলা দেশের প্রতিটি মানুষ শেখ মুজিবের পিছনে একতাবদ্ধ। ইহা ছাড়া রেডিও পাকিস্তান, ইপিআর, পুলিস, সেক্রেটারিয়েট প্রভৃতিও সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা প্রদান করিতেছে। এমতাবস্থায় বাংলা দেশের স্বাধীনতা ঘোষণার ব্যাপারে ইতস্ততঃ করার কোন কারণই থাকিতে পারে না বলিয়া জাতীয় লীগ প্রধান উল্লেখ করেন এবং বলেন, তিনি শান্তিপূর্ণভাবে বাংলা দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতি অনুরোধ জানাইতেছেন।

ভূট্টো নমশুদ্র নন-
১৫ মার্চ জুলফিকার আলী ভূট্টো করাচীর নিশতার পার্কে বিলাপের সুরে চিৎকার করিয়া বলেন, ‘আমি নমশুদ্র নই।’ আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান জনাব ভূট্টোর প্রেরিত তারবার্তার জবাব না করায় তিনি উপরোক্ত খেদ প্রকাশ করেন। শেখ মুজিবকে উদ্দেশ করিয়া জনাব ভূট্টো বলেন, ‘আপনি আমাকে অবহেলা করেন নাই। সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণকে আপনি অবহেলা করিয়াছেন। এখানকার জনগণকে আপনি অবহেলা করিতে পারেন না। আমি একজন জনপ্রতিনিধি- আমি নমশুদ্র নই এবং আমি যে, গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়াছিলাম তাহা কোন ব্যক্তিগত ব্যাপার ছিল না। উহা পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের অনুভূতিরই বহি:প্রকাশ মাত্র।’

পঃ পাকিস্তানের উর্দু পত্রিকার দৃষ্টিতে ভূট্টোর ভূমিকা
পশ্চিম পাকিস্তানের স্থানীয় উর্দু দৈনিক পত্রিকাগুলির নিবন্দে জনাব ভ‚ট্টোর নয়া প্রস্তাবের তীব্র নিন্দা করা হয়। দৈনিক জং পত্রিকায় বলা হয় যে, জনাব ভূট্টোর প্রস্তাব অবাস্তব ও গণতান্ত্রিক বিধানের পরিপন্থী। ইহাতে বলা হয় যে, আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বিধায় সেই দলের নিকটই ক্ষমতা হস্তান্তর করা উচিত। ইহাতে আরও বলা হয় যে, পিপল্স পার্টি মাত্র দুইটি প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করিয়াছে, সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধির দাবী করিতে পারেন না। ক্ষমতার দ্বৈত নিয়ন্ত্রণ দেশের ঐক্য ও সংহতির জন্য মঙ্গলজনক নয়।
দৈনিক ‘নওয়া-ই-ওয়াক্তের’ সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয় যে, ভূট্টোর প্রস্তাব মারাত্মক ও বিস্ময়কর। দেশপ্রেমের মূল্যবোধের প্রতি ইহা জনাব ভূট্টোর নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করে। দৈনিক ‘জাওয়াদান’ পত্রিকায় বলা হয় যে, তাঁহার প্রস্তাবে একথাই প্রমাণ করিয়াছে যে, জাতীয় স্বার্থের প্রতি তাঁহার কোন মমত্ববোধ নাই। ভূট্টোর একমাত্র উদ্দেশ্য ক্ষমতা লাভ করা। সম্পাদকীয় নিবন্ধে আরও বলা হয় যে, ভূট্টো সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তানের মুখপাত্র হইতে পারেন না। ভূট্টোর প্রস্তার ন্যায়বিচার ও গণতান্ত্রিক বিধানের পরিপন্থী। জনসাধারণ এই প্রস্তাব সমর্থন করে না।

লেখকঃ মোহাম্মদ ওমর ফারুক দেওয়ান, পরিচালক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)