image

বঙ্গবন্ধুর অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন ও তার ব্যাপকতা

image

ক্ষুধিত, নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষ সাধারণত নিয়ম কানুন মানতে চায় না। কারণ ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়। তাদের কাছে নিয়মের চেয়ে ক্ষুধাটাই বড় হয়ে সামনে আসে। ক্ষুধা আর বঞ্চনার তাড়নায় তারা মারমুখী হয়ে উঠে। কিন্তু ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে তার উল্টোটা হয়েছে। তাদের প্রিয় নেতার ডাকে ওইসব ক্ষুধিত, নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষ বিনাবাক্যে অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন মেনে নেয়। পেটের জ্বালাকে পাথর চাপা দেয়। পৃথিবীর ইতিহাসে ক্ষুধিত, নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষের এমন অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন আর দেখা যায় নি। ১৯৭১ সালের ২০ মার্চ ইত্তেফাকের চতুরঙ্গ উপসম্পাদকীয়তে এমন একটি নিবন্ধ প্রকাশ করা হয় যা অগ্নিঝরা মার্চকে দারুণভাবে তুলে ধরেছে।

জননায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে বাংলা দেশে যে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন গড়ে উঠেছে, বিশ্বের নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাসে তা অভ‚তপূর্ব। কবি জসিম উদ্দীন তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত এক কবিতায় এই অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের সাফল্য ও ব্যাপকতাকে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের চেয়েও বড় বলে মন্তব্য করেছেন। তাঁর মন্তব্যের পাশাপাশি উল্লেখ করা চলে ভারতের সর্বোদয় দলের নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের মন্তব্যটি। সম্প্রতি স্টেটসম্যান পত্রিকায় এক বিবৃতিতে জয়প্রকাশ নারায়ণ বলেছেন : মহাত্মা গান্ধীর পর অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের ব্যাপকতা ও সাফল্য সঠিকভাবে রূপায়িত হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আজকের বাংলা দেশে। জয়প্রকাশ নারায়ণ শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বকে ‘বলিষ্ঠতম নেতৃত্ব’ বলে উল্লেখ করেছেন এবং আজকের বাংলা দেশে সম্পূর্ণ নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে যে আন্দোলন চলেছে তাকে অভিহিত করেছেন ‘বিশ্বের নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাসে অভ‚তপূর্ব আন্দোলন’ বলে।

অশ্রুতপূর্ব যে আন্দোলন আজ বাংলা দেশে চলেছে তার পতাকার নিচে এসে দাঁড়িয়েছেন বাংলা দেশের সব শ্রেণীর মানুষ। আন্দোলনের ভেতর দিয়ে পরিস্কার হয়ে উঠেছে এই সত্য যে, ভয় দেখিয়ে, বেয়নেট উঁচিয়ে রক্তপাত ঘটিয়ে বাংলা দেশ আর শাসন করা যাবে না। বাংলা দেশকে স্বাধিকার দিতেই হবে, নতুবা বঙ্গোপসাগরের উত্তাল গর্জন দিন দিন উত্তালতর হতেই থাকবে।

আজ বাংলা দেশের শাসন ভার মূলত: আওয়ামী লীগের হাতে। আওয়ামী লীগ-প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশই আজ বাংলার মানুষের পথ। নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ বিপ্লব সংগঠনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন বাংলার মানুষ গত সত্তরের ডিসেম্বর মাসে। একাত্তরের মার্চ মাসে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাসে তাঁরা স্থাপন করেছেন আর একটি নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত। অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে তাঁরা গণবিরোধী শাসন-ব্যবস্থা কার্যত: সম্পূর্ণ অচল ও ব্যর্থ করে দিয়েছেন, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নির্বাচিত নেতার নির্দেশিত পথ সর্বতোভাবে মেনে নিয়ে তাঁরা প্রমাণ করেছেন যে, স্বৈরাচারী শক্তির চেয়ে গণশক্তিই প্রবলতর ও কার্যকর। গণশক্তির প্রতি যাঁরা শ্রদ্ধাশীল, গণশক্তির অব্যুদয়কে যাঁরা নতমস্তকে গ্রহণ করেন, আজকের বাংলার জাগ্রত জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন থেকে তাঁরা সমচিত আশ্বাস ও প্রত্যয়ের বাণী লাভ করতে পারেন। জনতার শ্লোগানের আওয়াজ যে উদ্যত রাইফেলের শক্তিকে বিদীর্ণ করে দিতে পারে, বাংলার মানুষের দিকে তাকিয়ে মুক্ত বিশ্ব আজ তা বিশ্বাস করতে পারেন।

আন্দোলনমূখর বাংলা দেশের রাজধানী ঢাকায় বর্তমানে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের। এই আলাপ-আলোচনার কি ফলাফল তা দু’একদিনের ভেতরেই জানা যাবে। ইত্যবসরে আন্দোলন চলছে এবং চলবে। জননায়ক শেখ মুজিবুর রহমান অতি স্পষ্ট ভাষায় বেেলছেন, লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। বাংলার জনগণকে তৈরি থাকতে হবে যে-কোন ত্যাগস্বীকারের জন্যে। ফাল্গুনের উদাসমাখা দিনগুলি গড়িয়ে চৈত্রের গ্রীষ্ম-যন্ত্রণার দিকে। সেই সাথে ব্যাপকতর এবং অধিকতর সংহত হচ্ছে বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন। বাংলার সব শ্রেণীর মানুষের কণ্ঠ থেকে এই উচ্চারণ ভেসে আসে : লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রামের বিরতি নেই, আমাদের সংগ্রাম চলবেই।

আন্দোলনকে স্বীয় চরিত্রে অক্ষুন্ন  এবং লক্ষ্যমুখী রেখে দেশের জীবন-প্রবাহের স্বাভাবিক তৎপরতা অবশ্যই যথাসম্ভব চালিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। প্রথমত: আন্দোলকে প্রবাহমান এবং সুশৃংখল রাখার স্বার্থেই যাতে সামাজিক নিরাপত্তা যথাযথ বজায় থাকে তজ্জন্য কায়েমী গোষ্ঠীর ধারক-বাহক এবং গুন্ডা-তস্কর শ্রেণীর বিপক্সে জনগণকে সদা সজাগ ও সক্রিয় থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত: বর্তমান আন্দোলন-মুখরতার মধ্যেও দেশের উন্নয়ন-তৎপরতা যাতে যথাসম্ভব চালু রাখা সম্ভব হয়, যাতে জাতীয়তাবাদী চেতনা ও আদর্শ উজ্জীবন করার মাধ্যমে দেশের উৎপাদন তৎপরতা বর্ধিত হতে পারে, তজ্জন্য বাংলার সংগ্রামী জনগণকে ঐকান্তিক ও কর্ম-কুশল হতে হবে।

একদিকে স্বাধিকার আন্দোলনকে প্রবাহমান ও অব্যাহত রাখা, অন্যদিকে সামাজিক নিরাপত্তা বজায়ের উদ্দেশ্যে জননেতা শেখ মুজিবুর রহমান দেশের প্রতিটি অঞ্চলে প্রতিটি মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম-কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন। নেতার নির্দেশ পালিত হয়েছে। খবর পাওয়া যায়, সারা দেশের ইউনিয়ন এবং মহল্লা ভিত্তিতে সংগ্রাম-কমিটি গঠিত হয়েছে এবং স্থানীয় শান্তিরক্ষক ও আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবীদের সহায়তায় সংগ্রাম কমিটির সদস্যরা স্ব স্ব মহল্লায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা অটুট রাখার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।
এই ব্যাপারে নবনির্বাচিত জাতীয় এবং প্রাদেশিক পরিসদ সদস্যদের সুস্পষ্ট ভ‚মিকা রয়েছে বলে আমরা মনে করি। স্ব স্ব এলাকার জনগণের অসুবিধা ও সমস্যা দূরীকরণে তাঁরা নিশ্চিতই কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে সচেষ্ট হতে পারেন। সামাজিক নিরাপত্তা, শান্তি-শৃংখলা-রক্ষা, উন্নয়ন প্রকল্প, উৎপাদন-তৎপরতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ‘কমপ্লেকসিটি’ বা জটিলতা দেখা দিরে জনগণের আস্থাশীল ও নির্বাচিত ব্যক্তি হিসাবে সেই জটিরতা নিরসনে পরিষদ সদস্যবর্গই স্ব স্ব এলাকার কাজ চালিয়ে যেতে পারেন। ইউনিয়ন এবং মহল্লা সংগ্রাম পরিষদগুলির ‘গাইড লাইন’ দেওয়ার ব্যাপারে তাঁরা কাজ করতে পারেন বৈধ সংস্থা হিসাবে। বাংলার আন্দোলনের সর্বাধিনায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিটি নির্দেশ যাতে দেশের জীবন-প্রবাহের প্রতিটি ধারায় সচল হতে পারে, পলিসদ সদস্যরা সে ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। এইভাবে দেশের বহমান, আন্দোলনকে একদিকে কায়েমী স্বার্থের ধারক-বাহক ও গুন্ডা-তস্কর শ্রেণীর তৎপরতা থেকে সর্বতোভাবে মুক্ত রাখা যায়, অন্যদিকে দেশের উন্নয়ন-উৎপাদন তৎপরতাকে চালু রাখা যায় তার স্বাভাবিক কার্যক্রমে। দেশের সংগ্রামী জনগণ বর্তমান আন্দোলনে সদা সজাগ, সদা সক্রিয়। দেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিবর্গ যদি এই সজাগ-সচেতন সংগ্রামী জনগণের পাশে এসে দাঁড়িয়ে প্রকৃতই সেবকের ভ‚মিকা গ্রহণ করেন তাহলে আন্দোলনের প্রবাহমানতার জন্যে তা হবে খুবই কার্যকর। 

বাংলা দেশ এক অভ‚তপূর্ব জাতীয়তাবাদী চেতনায় আজ জেগে উঠেছে। এই চেতনাকে যথাযথ রূপ দিতে হবে কর্মে। স্বাধিকার অর্জনের যে চ্যালেঞ্জ আজ বাঙালী জাতি গ্রহণ করেছে এবং যে চ্যালেঞ্জ নিয়ে সেই জাতি আজ এগিয়ে চলেছে, সেই চ্যালেঞ্জ জিততে হলে বাঙ্গালীর বর্তমান অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনকে স্ব-চরিত্রে অক্ষুন্ন রাখতে হবে, অব্যাহত রাখতে হবে এবং এর প্রাণশক্তিকে আরো বাড়াতে হবে নতুন উদ্দীপনায়। একথা ভুলে গেলে চলবে না।

লেখকঃ মোহাম্মদ মের ফারুক দেওয়ান, পরিচালক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)।