image

ঢাকার প্রতিরোধঃ রাজারবাগ

image

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালো রাতে ঢাকা শহরের পিলখানা, রাজারবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বর্বর পাকিস্তানী সৈন্যরা তান্ডব চালায়। ২৫শে মার্চের পরে পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ থাকায় তার খবর আমরা পাইনি। ১৯৭২ সালের ২৬শে মার্চের দৈনিক বাংলা শওকত আনোয়ার লিখিত নিচের প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধ, বিজয় এবং তারপর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার হৃদয়বিদারক ঘটনা আমরা জানতে পারি এই নিবন্ধ থেকে।

ঢাকার প্রতিরোধঃ রাজারবাগ
পঁচিশে মার্চ। উনিশ শো একাত্তর সাল। রাত আনুমানিক সাড়ে নটা। প্রতিদিনের মতই স্বাভাবিক ব্যস্ততা। তবে একটা উৎকণ্ঠা ও আবেগ ছিল না এমন নয়। হঠাৎ টেলিফোনের রিং বেজে উঠলো। যেনো রিং বাজছে না- একটা আর্তনাদ ভেঙ্গে ভেঙ্গে আসছে। টেলিফোনের রিসিভার তুলে নিতেই- 
এটা কি রাজারবাগ?
হ্যাঁ। গার্ড কমান্ডার বলছি। আপনি কে বলছেন?
আমি বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন হাবিলদার। কোন খবর পান নি আপনারা?
না।
আপনারা তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে যান। রাত দশটার মধ্যেই খান সেনারা রাজারবাগ আক্রমণ করবে। আমরাও এখন প্রস্তুত হয়ে পড়েছি। আর সময় নেই। খোদা হাফেজ।
ওপ্রান্তে আর কোন কণ্ঠ নেই। আকস্মিক এই খবরে আমি হতভম্ব, তারপর একটা অস্থিরতা। প্রচন্ড যন্ত্রণা। যন্ত্রণা থেকে শপথের বাণী উচ্চারিত। প্রাণ থাকতে একটি খান সেনাকেও ব্যারাকে ফিরে যেতে দিব না। ম্যাগাজিনের সেন্ট্রিকে বলা হল টেলিফোনের এ খবর পৌছে দিতে, পৌছে দিতে রাজারবাগের পুলিশ লাইনের প্রতিটি মানুষের কাছে। মুহুর্তে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ল খবর। বেরিয়ে এল সকলে। চোখে-মুখে আগুন জ¦লছে। সবাই একত্রিত হল পুলিশ লাইনের ময়দানে। কারো মুখে কথা নেই। শুধু অস্থীর প্রতীক্ষা। এমনি করে আরো কিছুক্ষণ। হঠাৎ প্রচন্ড আবেগে উচ্চারিত হল ‘জয় বাংলা’। রাত্রির নিস্তদ্ধতা কেটে উক্ত আবেগ ছড়িয়ে পড়েছে এখানে-ওখানে, সবখানে।
আবার টেলিফোন। রিং বেজে উঠতেই সচকিত হাতে রিসিভার তুলে নেওয়া হল।
রাজারবাগ?
হ্যাঁ, রাজারবাগ।
নিউ মার্কেট থেকে বলছি। আমি ইপিআর এর একজন হাবিলদার।
কি খবর ভাই?
আপনারা অস্ত্র হাতে তৈরী হয়ে যান। বুদ্ধির ভুলে আমাদের বেশিরভাগ লোকই নিরস্ত্র। খানসেনারা আমাদের অস্ত্র কেড়ে নিয়েছে। আমরা এখন কর্ডন হয়ে পড়েছি। শুধু আমি পালিয়ে এসেছি কোন রকমে। আপনাদের খবর দিলাম। একজন বাঙালীও খান সেনার হাতে প্রাণে বাঁচিবে না। পিলখানা থেকে সাহায্যের কোন আশা নেই। খোদা সহায়। সময় নেই। ছেড়ে দিলাম।
রাজারবাগের ম্যাগাজিন এর চাবি রেঞ্জ ইনস্পেক্টরের (আরআই) কাছে। তিনি তখন ঢাকার পুলিশ সুপার ভবনে। সেখানে টেলিফোনে যোগাযোগ হল। পুলিশ সুপার সাহেবও সমূহ বিপদের আভাস দিলেন। সকলকে আত্মরক্ষার প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ পাঠালেন। আর জানালেন- রেঞ্জ ইনস্পেক্টর সাহেব যথাশীঘ্র চাবি নিয়ে যাচ্ছেন।
স্পেশাল ফোর্স ৬ প্রাদেশিক পুলিশ ফোর্সের প্রায় আড়াই হাজার জোয়ান। অস্থীর প্রতীক্ষায় মুহুর্ত গুণছেন। প্রতিরোধ আর প্রতিজ্ঞায় দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চেও বাণী উচ্চারিত হল- তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। 
রাত দশটা। রেঞ্জ ইনস্পেক্টর সাহেব ম্যাগাজিনের গেটে উপস্থিত হলেন। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। অনাস্বাদিত অনুভূতি। অনন্য মুহুর্ত। ম্যাগাজিনের দুয়ার খুলে গেল। দ্রুত সবই রাইফেল তুলে নিল হাতে। যে যা পারল গোলাবারুদ নিল। তবু তখনো প্রতিপক্ষের শত্রু সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা ছিলনা কারো। প্রতিরোধ যুদ্ধের কোন নীল নকশাও হাতে নেই। বলা চলে আত্মরক্ষার জন্য প্রতিরোধ। আর প্রতিরোধের জন্য অস্ত্র তুলে নেয়া। অস্ত্র সরবরাহ করতে প্রায় পয়ঁতাল্লিশ মিনিট চলে যায়। শপথ নেয়া হল। পজিশন নেয়ার পূর্ব মুহুর্তে। ‘বাঙালী পুলিশের শরীরে এক বিন্দু রক্ত থাকতে বাংলাকে দাসত্বে পরিণত হতে দেবো না, বাঙালীকে ধ্বংস হতে দেবো না। জয় বাংলা।’
এর আগে অনেককে শহরে ছড়িয়ে পড়তে বলা হল। জনতাকে সাথে নিয়ে ব্যারিকেট তৈরীর জন্য।
এতকিছু ঘটনার মাঝে হঠাৎ খেয়াল হল রাজারবাগে অবাঙালী পুলিশের ব্যারাকের কথা। দ্রুত সেখানে গিয়ে দেখা যায়- সব শুন্য। একজন অবাঙালী পশ্চিম পাকিস্তানী সেপাইও সেখানে নেই। পালিয়েছে। কিন্তু কখন এবং কোথায়? জানা গেল না। সন্ধ্যার পরও তাদেরকে দেখা গিয়েছিল। কয়েকজন আর্মির লোকও এদের মাঝে ঘোরাফেরা করছিল। কিন্তু, সন্দেহ জাগেনি তখনো। পরে শোনা গেছে- পাকিস্তানী পুলিশ সেপাইরা ক্যান্টমেন্টে পালিয়ে গিয়েছিল।
দ্রুত পজিশন নিল সবাই। পুলিশ লাইনের পুকুর পাড়। নর্দমার খাদে। দালানের আড়ালে। সুবিধে মত সবখানে।  মতিঝিল কলোনি থেকে শান্তিনগর বাজার, শাজাহানপুর থেকে মালীবাগ সিদ্ধেশ্বরী সবখানে। পথের পাশে, দালানের কার্নিশে, দেয়ালেল ধারে। রাইফেল নিয়ে প্রস্তুত। ম্যাগাজিন পাহারা দেয়ার বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হল। রাজারবাগের সব আলো নিভিয়ে দেয়া হল। ‘কালো রাত্রির ঘামে’ ঢাকা পড়ে সমগ্র রাজারবাগ এলাকা। একটি অখন্ড নিস্তদ্ধতা নেমে আসে সবখানে। 
মালীবাগ থেকে গাড়ীর ক্ষীণ আলো দেখা গেল। ধীরে অতি ধীরে এগিয়ে আসছে। একটি নয়, দুটি নয়- প্রায় পঞ্চাশ থেকে ষাটটি গাড়ী এগিয়ে আসছে। সিগনালে সবাইকে প্রস্তুত থাকতে বলা হল। গাড়ী এসে থামলো রাজারবাগ এক নম্বর গেটে। মুখোমুখী পজিশন নিল। হঠাৎ গর্জে উঠলো কামান। রাত্রির নিস্তদ্ধতা ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেল। ভারী মেশিনগানের অস্ত্রে গুলী আসছে। আসছে রাজারবাগের ভেতরে।
এরই ফাঁকে একটি রাইফেলের গুলীর শব্দ। এটি ছিল সংকেত। মুহুর্তে চারদিক থেকে শত শত রাইফেল পাল্টা গর্জে উঠে। শত্রুর উপর গুলী চলে প্রচন্ড ধারায়। ঝাঁকে ঝাঁকে বৃষ্টির মত। 
দ্দরু হয় উভয় পক্ষের যুদ্ধ। একদিকে কামান, ভারী মেশিনগান ও তার সাথে এক পর্যায়ে মর্টার। প্রতিরোধের সপক্ষে রয়েছে শুধু থ্রি নট থ্রি রাইফেল আর শপথের বাণী। খানসেনাদের গাড়ীর ক্ষীণ আলোয় মাঝে মাঝে চোখে পড়ছে আক্রমণকারীদের অনেকে গড়িয়ে পড়ছে। লুচিয়ে পড়ছে রাস্তায়। একে একে খানসেনার ভারী ভারী ট্রাকের চাকা ফেঁসে যায়। প্রবল উৎসাহ প্রতিরোধ নিবেদিত প্রতিটি প্রাণে। প্রতিটি দুর্গে। হতাহতের সংখ্যা তুলনামূলখ অনেক কম। অবশ্য এর মধ্যে বুলেটের আদর মেখে বাংলার কয়েকটি তাজা প্রাণ ঝরে পড়ে। এমনি করে প্রায় দুই ঘন্টা। শত্রæপক্ষের কামান-গোলা হঠাৎ স্তদ্ধ হয়ে যায়। মেশিনগান কিংবা মর্টার থেকেও গুলী আসছে না। তবু প্রতিরোধ দুর্গ থেকে পাল্টা আক্রমণ বন্ধ হয় নি। অব্যাহত থাকে শত্রæ নিধনের পালা। সমবেতভাবে বেরিয়ে আসার অস্থিরতা জাগে। যুদ্ধের প্রাথমিক বিজয় হয়েছে। একটি দুর্লভ অনুভ‚তি সবার মনে। চঞ্চলতা আসে প্রাণে, রক্তে, ধমনীতে। প্রার্থিত পবিত্র বাসনা জাগে রক্তাক্ত হৃদয়ে। রাত আনুমানিক একটা। বিকট শব্দে চকিত হয় সবাই। নতুন শংকা জাগে। প্রতিরোধের প্রবল ইচ্ছায় শক্ত হাতে রাইফেল তুলে ধরে। কি যেনো চারদিক ভেঙ্গেচুওে আসছে। হঠাৎ ধ্বংসের মাতম শুরু হয়ে যায়। এবার ট্যাংক থেকে প্রবল আক্রমণ। মর্টার থেকে অবিরাম শেলিং। ভারী মেশিনগান সমানে চলছে। এক সময়ে অস্ত্রেও গোলা চারদিক থেকে এসে পড়ছে। হল্কার মত। প্রতিরোধ দুর্গে বহু প্রাণ গড়িয়ে পড়ে। গড়িয়ে পড়ে বাংলার শ্যামল মাটিকে লাল করে দিয়ে। রূপান্তরিত হয় সারা শরীরের মেহেদী রংয়ে শাহাদত বরণ করে।
আগুন ধরে যায় ব্যারাকে। আগুন জ¦লছে রাজারবাগে। জ্বলছে আশেপাশে। রাজধানী ঢাকায়। বাংলার শ্যামল বুকে আগুন জ¦লছে।
রাত তখন তিনটা। প্রায় সকাল হয়ে এলো। মুক্তিপাগল ... শক্তি। অবস্থা অনুমান করে সবাই তাদের পোশাক খুলে ফেলছে। এখন প্রাণ রক্ষার পালা। রাতের অন্ধকারে যে যেখানে পারল আত্মগোপনের চেষ্টা করল। রাজারবাগের সীমানা অতিক্রম করে আবাসিক এলাকায় ছুটে যাচ্ছে সুযোগ বুঝে। তখন দাউ দাউ করে জ¦লছে রাজারবাগ। চারদিক আগুনের শিখায় আলোকিত। আর মাঝে মাঝে ক্রলিং করে পুলিশ ভাইয়েরা বেরিয়ে যাচ্ছে। বেরিয়ে যাচ্ছে রাজারবাগ ছেড়ে। অনেকের চোখে অশ্রু চিকচিক করছে। আবার অনেকে আতংকে ভীত-সন্ত্রস্ত। অনেকে আশ্রয় নিল পুলিশ স্টাফ কোয়ার্টারে। কিন্তু শত্রুপক্ষের আক্রমণ সমানে চলছে। জীবনের মায়া ত্যাগ করছে সবাই। শুধু আল্লাহকে স্মরণ করছে মনে মনে। 
ভোর পাঁচটা। রক্তস্নাত সুর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ল এখানে ওখানে। ছড়িয়ে পড়ল রাজারবাগের অঙ্গনে। শত শত বাংলার প্রাণ সেই সুর্যের আলোয় শুয়ে আছে।
ট্রাকগুলো মৃত খানসেনাদের লাশ বোঝাই করে চলে গেল। আর বাঙালী পুলিশের লাশ টেনে হেঁছড়ে স্তুপিকৃত করা হল। এখানে সেখানে। পেট্রল ঢেলে সে লাশে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। তখনো জীবিত কয়েকজন আহত বাঙালী পুলিশকে ধরে এনে নিক্ষেপ করল সেই জ্বলন্ত আগুনে। আর্তনাদ এল বুক কাঁপিয়ে। 
প্রমত্ত উল্লাসে তখনো গুলী চালাচ্ছে খানসেনারা। অবিরাম একতরফা। এ গুলীর যেনো আর শেষ নেই। গোলা-বারুদের গন্ধে বাতাস ভরে গেছে। বমি আসতে চায় সেই গন্ধে। একটি মুহুর্ত একটি ঘন্টা। কাটতে চায় না। তবু রুদ্ধশ্বাসে কাটাতে হবে সময়। ভবিষ্যত অনিশ্চিত। জীবন অনিশ্চিত।
বেলা আনুমানিক সাড়ে আটটা। রাজারবাগের নির্বত কক্ষে কানের কাছে একটি ট্রানজিস্টার। ঢাকা স্টেশন বন্ধ। কলকাতা, করাচী বা অন্য কোন স্টেশন ধরা যায় কিনা। তারই সযত্ন প্রচেষ্টা। এর জন্য জীবনের ঝুঁকি আছে প্রতি মুহুর্তে। হঠাৎ একটি কণ্ঠ। অপ্রত্যাশিত, অবিস্মরণীয়-
‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি। বত্রিশ মিটার ব্যান্ডে প্রচারিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আত্মগোপন করেছেন। তিনি বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। ----। স্টেশনে অপেক্ষা করুন----
এতো শুধু শব্দের সিঁড়ি ভেঙ্গে কতকগুলো কথা নয়। এ যেনো সাগরের কল্লোল। সমুদ্রের আহ্বান। আহ্বানে সাড়া এলো একটি মনে। সাড়া জাগে সাড়ে সাত কোটি আকাঙ্খিত প্রাণে। ঘুমন্ত শক্তি জেগে উঠে প্রচন্ড বাসনায়। স্বাধীনতার বাণী ছড়িয়ে যায় রাজারবাগের একটি নিভৃত ঘর থেকে অনেক ঘরে। ছড়িয়ে যায় সন্তর্পনে জনতার মাঝে। ঘরে ঘরে দুর্গে দুর্গে প্রত্যন্ত এলাকায়। সে আগুন ছড়িয়ে পড়ে সবখানে।

লেখকঃ মোহাম্মদ ওমর ফারুক দেওয়ান, প্রকল্প পরিচালক, গণযোগাযোগ অধিদপ্তর।