image

১৯৭১ সালের মার্চ মাসের পরিস্থিতি নিয়ে বিদেশি গণমাধ্যম

image

পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাস ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে কীভাবে এবং কত দূর পটপরিবর্তন হচ্ছিল তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সাপ্তাহিক ‘নিউজ উইক’ একটি প্রতিবেদন ছাপে ১৫ই মার্চ তারিখে। বিদেশের কাছে বাংলাদেশের অস্থীতিশীল বার্তার অনেকখানী ওই প্রতিবেদনে পৌছে যায়। প্রতিবেদনটি দৈনিক সংবাদ ১৭ মার্চ নিম্নোক্ত শিরোনামে পরিবেশন করে-
নিউজ উইক এর দৃষ্টিতে পাকিস্তানের পরিস্থিতি
পাকিস্তানের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অচলাবস্থার বিবরণ দান প্রসঙ্গে মার্কিন সংবাদ সাপ্তাহিক ‘নিউজ উইক’ পত্রিকার সর্বশেষ সংখ্যায় বলা হইয়াছে যে, পাকিস্তানের যে সব মানুষ একদিন ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের ফলে তাহার জাতির জন্মকে ঈশ্বরের করুণার বিস্ময়কর ফল হিসাবে গভীর শ্রদ্ধার ভাব মনে পোষণ করিত আজ সেই সব মানুষই আবার তাহাদের জাতির সেই জন্মক্ষণের কথা স্মরণ করিতেছে।
জাতির অভ‚্যদয়ের জন্য আগে তাহারা ভক্তিভরে শুকরিয়া আদায় করিত। কিন্তু আজ তাহাদের সেই ভাব-প্রবণতা সম্পূর্ণ ভিন্ন খাতে অর্থাৎ বিদ্বেষ ও অসন্তোষের পথে পরিচালিত হইতেছে। সেই দিনের সেই আবেগপ্রবণ মানুষ আজ মনে করিতেছে যে, পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলের মধ্যে এক সহ¯্রাধিক মাইল বিস্তৃত বিদেশী ভ‚মির ব্যবধান রাখিয়া মুসলমান হিসাবে শুধুমাত্র ধর্মীয় মিল এবং হিন্দু প্রভাবিত ভারতের সহিত শত্রæতা ব্যতীত অন্য সর্বক্ষেত্র গরমিলের মধ্যেই বিভক্ত একটি জাতির সৃষ্টির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হইয়াছিল। এ বিক্ষোভের কারণ বোধগম্য। কারণ যে, দুর্বল যোগসূত্র দুই সুদূরবর্তী অংশ পাকিস্তানকে তাহার জীবনের প্রথম তেইশ বৎসরকাল সংযুক্ত রাখিয়াছে পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবী ও পূর্বাঞ্চলের বাঙ্গালীদের মধ্যে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিদ্বন্দিতার মুখে তাহা দ্রুত ক্ষয় পাইতেছে। গত সপ্তাহেই জনৈক পাকিস্তানী প্রশাসক বিষন্নভাবে বলেন, “বহুদিন হইতেছে আমরা বুঝিয়াছি যে, আজ হউক, কাল হউক এই প্রশ্নে একটি গভীর সঙ্কটের মোকাবেলা আমাদের করিতেই হইবে। কিন্তু এই সঙ্কট যেভাবে আমাদের ধাক্কা দিয়াছে তাহার আকস্মিকতায় বিহ্বল হইয়া আমরা দেখিতেছি যে, ইতিহাসের কঠিনতম চ্যালেঞ্জ আমাদের ছিন্ন ভিন্ন করিয়া দিতেছে এবং এই চ্যালেঞ্জ যে মোকাবেলা করা যাইবে সেরূপ কোন প্রকার লক্ষণও দেখা যাইতেছে না।”
প্রকৃতপক্ষে গত সপ্তাহে যে সমস্ত লক্ষণ স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে সেগুলি পাকিস্তানী ফেডারেল ঐক্যের ভাঙ্গনের প্রতিই অঙ্গুলী নির্দেশ করিতেছে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান ফেডারেল ব্যবস্থাধীনে এক অখন্ড রাষ্ট্রের মধ্যে সহাবস্থান করিতে পারিবে কিনা শেষ বারের মত সে চেষ্টা করিয়া দেখার জন্য ঢাকায় নব-নির্বাচিত গণ-পরিষদের যে অধিবেশন আহুত হইয়াছিল, শেষ মুহুর্তে আকস্মিকভাবেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তাহার স্থগিত ঘোষণা করিলেন। পূর্ব বাংলার বাংলা ভাষাভাষী মানুষ স্বভাবতই: ইয়াহিয়ার এই ব্যবস্থাকে পাঞ্জাবী বিশ^াসঘাতকতার আর একটি উদাহারণ হিসেবে গণ্য করিল। ইহার যে প্রতিক্রিয়া দেখা দিল তাহা ত্বরিত ও অশান্তিময়। এক সপ্তাহব্যাপী হরতাল ঢাকা ও পূর্ব বাংলার নগরীসমূহের জীবনযাত্রাই স্তদ্ধ করিয়া দিল। অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ কঠোর ভাবাপন্নরা বাঁশের লাঠির অস্ত্রে সজ্জিত হইয়া ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিতে দিতে সমস্ত রাস্তা প্রদক্ষিণ করিতে শুরু করে।
ইহার পর পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থানকারী ইসলামাবাদ সরকার যখন পাল্টা ব্যবস্থা হিসাবে কঠোর সামরিক আইনের বাঁধনে পূর্ব পাকিস্তানকে বাঁধিলেন তখন তাহা কাহাকেও বিস্মিত করে নাই। সন্ধ্যা হইতে সকাল পর্যন্ত জারী করা সান্ধ্য আইন রক্ষা এবং বিক্ষোভকারীদের সৃষ্ট রাস্তার সব ব্যারিকেড ভাঙ্গিবার জন্য সৈন্য ও পুলিশবাহী লরীসমূহ ঢাকার রাজপথ প্রকম্পিত করিয়া তোলে। সপ্তাহকালের মধ্যে বিক্ষুব্ধ জনতা ও পাকিস্তানী সৈন্যদলের মধ্যে সংঘর্ষে যত লোক নিহত হইল, বেসরকারী হিসাবে তাহার সংখ্যা ১৩০। আরও হাজার হাজার লোক আহত হইল তাহদের মধ্যে দুইজন বাঙ্গালী পুলিশও ছিল। এই দুইজন পুলিশ নাকি তাহাদের  স্বদেশবাসী বিক্ষোভকারীদের উপর গুবির্ষণ করিতে অস্বীকার করায় পাঞ্জাবী অফিসার পরিচালিত সৈন্যদলের গুলীর শিকারে পরিণত হয়। 

সীমাহীন বঞ্চনা বাঙ্গলিীদের বিচ্ছেদের পথে ঠেলিয়াছে
বাঙ্গালীদের মধ্যে যে তীব্র হতাশা বিদ্যমান এবং যে নৈরাশ্য এক্ষণে প্রচন্ড আকারে ধারণ করিয়া পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্নতার পথে ঠেলিয়া দিতেছে বলিয়া প্রতীয়মান হইতেছে উহাই অনেককে বিহ্বল করিয়া তুলিয়াছে। পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসারগণও এ কথা অস্বীকার করিতে পারেন নাই যে, পাঁচ কোটি লোকের বাসভ‚মি পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় সাত কোটি লোক অধ্যুষিত পূর্বাঞ্চল রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উভয় ক্ষেত্রেই ক্রমাগত তাহার ন্যায্য প্রাপ্য হইতে বঞ্চিত হইয়াছে। উদাহারণস্বরূপ বলা যায়, বিগত তেইশ বৎসরে কেন্দ্রীয় বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থের চার পঞ্চমাংশের কাছাকাছি পশ্চিমাঞ্চলে ব্যয় করা হইয়াছে। মোটামোটি হিসাবে দেখা যায় যে, পাকিস্তানের প্রশাসনিক অফিসারদের মধ্যে শতকরা ৮৫ জন এবং সামরিক অফিসারদের মধ্যে শতকরা ৯০ জনই পশ্চিম পাকিস্তানের বাসিন্ধা। এখানেই শেষ না, সাম্প্রতিককালে পশ্চিম পাকিস্তানে মাথাপিছু আয় যেখানে শতকরা ৪২ ভাগ বৃদ্ধি পাইয়াছে, পূর্বাঞ্চলে সেখানে আয়ের হার বৃদ্ধি পাইয়াছে মাত্র শতকরা ১৭ ভাগ।
পূর্বাঞ্চলে পুঞ্জিভ‚ত ক্রোধ একটানা দীর্ঘ ১২ বৎসরের সামরিক একনায়কত্বের পর গত বৎসরের শেষে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রথম অবাধ জাতীয় নির্বাচনের মধ্যে চরম বহি:প্রকাশ ঘটে। ভাবিলে বিস্মিত হইতে হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানে শতকরা ৯৮টি ভোট পড়ে আওয়ামী লীগ দলীয় বাক্সে। আওয়ামী লীগ প্রধান হইতেছেন বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী অগ্নিপুরুষ সেই শেখ মুজিবুর রহমান যিনি তাঁহার গুণমুগ্ধদের কাছে ‘মুজিব’ বলিয়া পরিচিত। ছয় দফা কর্মসূচীর উপর ভিত্তি করিয়া শেখ মুজিব নির্বাচনে অসামান্য সাফল্য অর্জন করেন। পররাষ্ট্রনীতি এবং জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে নামমাত্র কর্র্তৃত্ব ছাড়িয়া দিয়া এবং প্রতিটি প্রদেশের প্রকৃত স্বায়ত্তশাসন সুনিশ্চিত করিয়া ছয় দফা কর্মসূচী, ফলত: পাকিস্তানী ঐক্যকে এক নিখিল কনফেডারেশনে রূপান্তরিত করিবে বলিয়া আশঙ্কা করা হইতেছে। নতুন জাতীয় পরিষদে সুবিধাজনক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে এই ফেডারেল ইউনিয়নের ইতিহাসে এইবারই সর্ব প্রথম শেখ মুজিব পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য অভীষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার সুযোগ আনিয়া দিয়াছেন। এই সকল ঘটনাপ্রবাহ পশ্চিম পাকিস্তানে অনেকখানী আতঙ্ক ও উদ্বেগের সৃষ্টি করিয়াছে। পিপল্স পার্টি, বামপন্থী নেতা ও মোহজাল সৃষ্টিকারী জুলফিকার আলী ভ‚ট্টোর নেতৃত্বে ডিসেম্বরের নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তানে বিজয়ীল মর্যাদা অর্জন করে। কিন্তু আওয়ামী লীগের হাতে সংসদীয় পরাজয় বরণ করিয়া লওয়ার পরিবর্তে জনাব ভ‚ট্টো তাঁহার দলীয় নির্বাচিত সদস্যবর্গকে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে অংশগ্রহণে বিরত থাকিবার নির্দেশ দেন। প্রসঙ্গত: উল্লেখযোগ্য, আওয়ামী লীগ ১৬৭ আসন লাভ করিয়াছে, পক্ষান্তরে পিপল্স পার্টি পাইয়াছে ৮২টি আসন। ইহার ফলে কোনরূপ আপোষে অসম্মত প্রতিদ্ব›দ্বী ও রাজনৈতিক ভ‚মিকায় তীক্ষè মেধার অধিকারী দুই নেতার মাঝখানে পড়িয়া বৃটিশ ধারার সৈনিক ইয়াহিয়া খান বিব্রত হইয়া পড়েন। পরিশেষে ইয়াহিয়া খান অবস্থার সহিত তাল মিলানোই যুক্তিযুক্ত বলিয়া বিবেচনা করিলেন এবং শেষ পর্যন্ত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করিয়া অচলাবস্থা অবসানের শেষ প্রচেষ্টা হিসাবে তিনি পাকিস্তানের প্রতিনিধিস্থানীয় নেতৃবৃন্দের এক সম্মেলন আহ্বান করিলেন। কিন্তু শেখ মুজিব ইয়াহিয়ার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করিলেন এবং সপ্তাহশেষে এমন একটি ঘোষণা প্রচারে উদ্যত হইলেন যাহার অর্থ পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতারই নামান্তর। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া চলতি মাসের শেষ দিকে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন পুনঃ অনুষ্ঠানের ঘোষণা করিয়াছেন এবং এই মর্মে হুশিয়ারি জারী করিয়াছেন যে, পাকিস্তানের সংহতি ও নিরাপত্তার খাতিরে সেনাবাহিনীকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়া হইবে। দেশকে রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতার হাত হইতে রক্ষা করিবার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রয়াস সত্তে¡ও পর্যবেক্ষকমহল মনে করিতেছেন যে, পরিস্থিতি ইতিমধ্যেই পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের আয়ত্তের বাহিরে চলিয়া গিয়াছে এবং সঙ্কীর্ণ মনোভাবভবিষ্যৎ ঘটনাপ্রবাহের গতি নির্ধারণ করিতে পারে। নিউজ উইকের প্রতিনিধি লোরেন জেনকিনসের নিকট জনৈক পাশ্চাত্য কূটনীতিবিদ মন্তব্য করিয়াছেন যে, “পূর্ব এবং পশ্চিমাঞ্চল বিচ্ছিন্ন হইয়া যাইবে ইহা কোন প্রশ্ন নয়” বরং পরিস্থিতি হঠাৎ এতদূর গড়াইয়াছে যে, পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল কি পরবর্তী সপ্তাহে কিংবা আগামী মাসে এক অথবা দুই বৎসর পর বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িবে ইহাই প্রশ্ন। উক্ত পত্রিকায় আরও মত প্রকাশ করা হয় যে, দুর্ভাগ্যবশত: এই বিচ্ছিন্নতা বিলম্বিত না হইয়া শীঘ্র ঘটার সম্ভাবনাই বেশী। -নিউজউইক ১৫ই মার্চ, ১৯৭১।

লেখকঃ মোহাম্মদ ওমর ফারুক দেওয়ান, প্রকল্প পরিচালক, গণযোগাযোগ অধিদপ্তর।