মৃত্যুর সঙ্গেই বসবাস করছেন পুরান ঢাকার মানুষ। অধিক টাকার লোভে একশ্রেণির বাড়ি বা ফ্ল্যাট মালিকের কারনে একের পর এক কেমিক্যাল গোডাউন বা কেমিক্যালের দোকানে অগ্নীকান্ডের ঘটনা ঘটলেও শুধু তদন্ত কমিটি আর নানা দফার সুপারিশ মালার জালে আটকে যাচ্ছে পুরান ঢাকার মানুষের জীবন-মৃত্যুর খেলা।
কেমিক্যাল গোডাউনে আগুন লাগার শুরটা ছিলো ২০০৪ সালে। বাংলাদেশ মাঠ এলাকা থেকে একই পরিবারের এক কিশোর ছাড়া ৯ জনের মৃত্যুর ঘটনায় প্রশাসনের টনক না নড়ায় আবার কেমিক্যাল গোডাউনে আগুনের ঘটনা ঘটে ২০১০ সালের ৩ জুন নীমতলীতে।
কেমিক্যাল গোডাউনে লাগা আগুনে ১১৯ জনের প্রাণ কেড়ে নেয়।সারা দেশবাসীকে জাগিয়ে তোলে আবাসিক এলাকায় কেমিক্যাল গোডাউনের মজুদ নিয়ে। তদন্ত কমিটি, পরিবেশবাদী সংগঠন সবাই সোচ্চার হয়ে উঠেন পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন সরিয়ে নেয়ার। সরকারের বিভিন্ন বিভাগের নানান কমিটির সুপারিশমালায় সিদ্ধান্ত হয় পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন সরিয়ে নেয়ার। এরপর পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকায় ৩১টি কেমিক্যালকে অতি বিপদজনক দাহ্য পদার্থ হিসেবে চিহ্নিত করে এই ব্যবসার ট্রেড লাইসেন্স দেয়া বন্ধ করে দেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন।
২০১৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী ঢাকার মেয়র সাঈদ খোকন মিটফোর্ডের এক অনুষ্ঠানে একসঙ্গে ৫টি প্রতিষ্ঠানকে কেমিক্যাল ব্যবসার ট্রেড লাইসেন্স দেন। একদিন পরই আবার গজব নেমে আসে পুরান ঢাকাবাসীর জনজীবনে। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারী রাতে চুড়িহাট্রার গ্যাস সিলিন্ডার লিকেজের আগুন কেমিক্যাল গোডাউনে ছড়িয়ে পড়লে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ৮০ জনের জীবন প্রদিপ কেড়ে নেয় কেমিক্যালের আগুন। আবার প্রশাসনের তোড়জোড় শুরু হয় কেমিক্যাল গোডাউন সরিয়ে নেয়ার।
চুড়িহাট্রার আগুনে স্বজনহারা পরিবারগুলোর শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আবারও পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় আগুনে কেড়ে নিলো ইডেন কলেজ ছাত্রী সহ চারজনের প্রাণ।২২ ফেব্রুয়ারী ভোরে সেহেরী খাওয়ার সময় রাত তিনটার কিছু পরই আগুনের তাপে ঘুৃম ভাঙ্গে ৯/১১ আরমানিটোলার ৬ তলা ভবনের বাসিন্দাদের। ফ্লাটের নীচতলার কেমিক্যাল গোডাউনের আগুন আর কেমিক্যাল মিশ্রিত বিষাক্ত ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে ফ্ল্যাটের মানুষগুলো বিদুৎ বিহীন হয়ে যাওয়া ভবনে নারী, পুরুষ ও শিশুদের আর্তচিৎকারের এলাকায় এক মর্মান্তিক দৃশ্যের অবতারণা হয়।
ফায়ারসার্ভিসের ঢাকা দক্ষিণের প্রায় ১৯টি ইউনিট একযোগে কাজ করে ভোরে আগুন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। আহত অবস্থায় ক্রেনের সাহায্যে ভবণের বাসিন্দাদের নামিয়ে আনলে মিটফোর্ড হাসপাতালে এক তরুণীকে মৃত ঘোষণা করে। এরপর ভবণ থেকে নিরাপত্তা কর্মী রাসেলের লাশ উদ্ধার করা হয়। ফায়ারসার্ভিস কর্মীরা ৬ তলা ভবণের চিলেকোঠা থেকে আরো দুই পুরুষের লাশ উদ্ধার করে।ফায়ারসার্ভিস ও পুলিশের ধারণা এরা বিষাক্ত ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্টে মৃত্যুবরণ করেছে।
আগুন লাগা মুসা ম্যানশনের প্রতিবেশী ও প্রত্যক্ষর্শীরা জানান, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত। বিকট শব্দে বৈদ্যুতিক তার ছিড়ে গেলে কেমিক্যাল গোডাউনে আগুন ধরে যায়। বিদুৎ না থাকায় অন্ধকার ভবণ থেকে বাসিন্দাদের আর্তচিৎকার তারা শুনতে পান। এরপর ফায়ারসার্ভিস কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে ও ক্রনের সাহায্যে বাসিন্দাদের নামিয়ে আনে।
৬ তলা ভবনটিতে ২য় তলা থেকে আাবাসিক ফ্ল্যাট। এ ভবনে ১৮ টি পরিবার বসবাস করতো বলে জানা গেছে। শুক্রবার ভোর রাত ৩টা মিনিটের সময় পুরান ঢাকার ৯/১১ আরমানিটোলায় অবস্থিত হাজি মুসা ম্যানশন নামের ৬তলা ভবনের নিচ তলায় কেমিক্যালের গোডাউনে আগুনের সুত্রপাত।
সংবাদ পেয়ে অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধারকাজে অংশ নেয় সদরঘাট, সিদ্দিকবাজার, মোহাম্মদপুর ও খিলগাঁও, সিদ্দিকবাজার সদর দপ্তর এবং হাজারীবাগ ফায়ার স্টেশন। হেড কোয়ার্টারের লাইটিং ইউনিট, টিটিএল, ক্রাউট কন্ট্রোল ইউনিট, অ্যাম্বুলেন্স, মিডিয়া সেলসহ বিভিন্ন ফায়ার স্টেশনের মোট ১৯টি ইউনিট এতে অংশগ্রহণ করে।
অগ্নিনির্বাপণের পাশাপাশি আহত অবস্থায় ১৪ জনকে উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে ঢাকা মিটফোর্ট হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়। ঐ ভবনের নিরাপত্তা কর্মীর ১টি লাশ উদ্ধার করে ব্যাগে সংরক্ষণ করে পুলিশের নিকট হস্তান্তর করেন ও বাকি একজন চিকিসাধীন অবস্থায় মিটফোর্ট হসপিটালে মারা যায় এবং ঐ ভবনের ৩ তলা থেকে একটি পোষা টিয়া পাখি উদ্ধার করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ সাজ্জাদ হোসাইন উক্ত অপারেশনাল কাজে উপস্থিত হয়ে নির্দেশনা প্রদান করেন এবং গণমাধ্যম থেকে আসা সংবাদকর্মীদের অগ্নিকান্ডের তথ্য ও আহত-নিহতদের উদ্ধারের বিষয়ে ব্রিফ করেন।
এসময় অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) মোঃ হাবিবুর রহমান, পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লে. কর্ণেল জিল্লুর রহমান, পরিচালক (প্রশিক্ষণ, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) লে. কর্ণেল এস এম জুলফিকার রহমান, অধিদপ্তরের উপপরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ); ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক; ঢাকার সহকারী পরিচালক; ঢাকা জোন প্রধান, মিডিয়া সেলের স্টেশন অফিসারসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
মিটফোর্ড হাসপাতালে ১৮জনকে আহত অবস্থায় নিয়ে আসা হয়। এর মধ্যে ৪জন ফায়ারসার্ভিস কর্মী। আহত অবস্হায় নিয়ে আসাদের মধ্যে ইডেন কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী সুমাইয়া আক্তার(২২)কে জরুরি বিভাগের চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। মিটফোর্ড হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া ফায়ারসার্ভিস কর্মীরা হলেন গিয়াসউদ্দিন (৪৫), বিসুপদ মিস্ত্রি (৪০), লিটন(৩০), ফরহাদ রহমান(৩৮)।
মিটফোর্ড হাসপাতালে আরো যারা আহত অবস্থায় চিকিৎসা নিয়েছেন এরা হলেন আব্দুল কাদের(৪০), বিল্লাল হোসেন(৫০), মোঃফারুক(৫৫), আসমা সিদ্দীকা(৪৫), ইউসুফ মোল্লা(৬০), মোঃবাবুল(৫০), হাজীমোঃইব্রাহিম(৫০), সুফিয়া(৫০), মুনা(৩০), আশিকুর রহমান(৫০), জুনায়েদ(১১), আকাশ(২২), দেলোয়ার(৫৮)। আহতদের বেশীর ভাগেরই শ্বাসকষ্ট সমস্যা। এদের কেউ প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছেন আবার অনেককেই শেখ হাসিনা বার্ন ইনিস্টিউটে রেফার করা হয়েছে।
Developed By Muktodhara Technology Limited