image

বিদ্যুৎচালিত মোটরই ভরসা, পানীয়জলের তীব্র সংকট বাঁশখালীতে

image

চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় শুষ্ক মৌসুমে পানীয় জলের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে প্রয়োজনের তুলনায় কম বৃষ্টিপাত, ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের তুলনায় স্তরে পানি জমা না থাকা অন্যতম, বোরোচাষের জন্য গভীর ডীপকল বসিয়ে পানি উত্তোলনের ফলে বিভিন্ন উৎপাদক নলকূপ সমূহের পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। যার ফলে বেশীরভাগ নলকূপে পানি উঠছে না। এ কারণে টিউবওয়েল থেকেও মানুষ প্রয়োজনের তুলনায় কম পানি পাচ্ছে। বিশেষ করে বোরোচাষের সময় জমিতে সেচের জন্য মাটির গভীরে বৈদ্যুতিক মোটর এবং সাবমার্সিবল পাম্প চালিয়ে গভীর নলকূপের মাধ্যমে অনেক নিচ থেকে পানি তুলে নেওয়ার কারণে শুষ্ক মৌসুমে এ সমস্যা হচ্ছে।

বাঁশখালী উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিস জানিয়েছেন, 'সমগ্র বাঁশখালীতে ১৯৮৩ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলের সমগ্রদেশে পানি সরবরাহ প্রকল্পের উদ্যোগে সাড়ে ৫ হাজার নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে অধিকাংশ নলকূপ অকেজো হয়ে পড়ায় বাঁশখালীর অধিকাংশ এলাকায় বর্তমানে পানীয় জলের তীব্র সংকট থাকায় সাধারণ জনগণ নানাভাবে সমস্যায় দিনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। উপকূলীয় এলাকার বেশীরভাগ নলকূপ অকেজো হয়ে পড়ায় মোটরচালিত নলকূপের মাধ্যমে পানীয়জলের সংকট দূর করে। ইদানিং বাঁশখালী-দোহাজারী সংযোগ ৩৩ কেবি ভোল্টের লাইন সংস্করণ কাজের কারণে দিনের বেশীরভাগ বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকায় মোটরচালিত যন্ত্রের সাহায্যে যে পানি সংগ্রহ করতো তাও ব্যাহত হচ্ছে। এতে পুরো বাঁশখালী জুড়ে তীব্র পানীয় জলের সংকট দেখা দিয়েছে।'

উপজেলার ছনুয়া, খুদুকখালী, গন্ডামারা, সরল, বাহারছড়া, খানখানাবাদ, পুকুরিয়া, কালীপুর, বৈলছড়ি, কাথরিয়া, সাধনপুর, পুঁইছড়ি, চাম্বল, শেখেরখীল ও শীলকূপ ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকায় বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই। সাগর উপকূলের ইউনিয়নগুলো শুষ্ক মৌসুমে এমনিতেই খাল, বিল ও পুকুরের পানি শুকিয়ে যায়। প্রচন্ড গরম পড়লে উপকূলীয় এলাকার ইউনিয়নগুলোতে পানির জন্য হাহাকার পড়ে যায়। কয়েকটি গ্রাম বা পাড়ায় নলকূপ থাকলেও তার অধিকাংশই অকেজো বা নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। উপকূলীয় এলাকায় একটি নলকূপ বসালে অন্তত ৯ শত থেকে ১২ শত ফুট গভীরে যেতে হয়। গভীরে না গেলে বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যায় না। গভীরে যেতে হলে অনেক টাকা ব্যয় করতে হয়। স্থানীয়রা এ প্রতিবেদককে অভিযোগ করেন- উপকূলীয় এলাকায় শত শত নলকূপ অকেজো হয়ে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে দীর্ঘদিন ধরে, যার দরুণ পানীয়জলের তীব্র সংকটের মুখে পড়ছে জনজীবন। এ সমস্যা প্রতিবছর গ্রীষ্ম মৌসুমে পরিলক্ষিত হয়। গ্রীষ্মের তীব্র তাপদাহে একদিনে জনজীবন চরম দূর্বিসহ অন্যদিকে পানীয়জলের সংকটে জনজীবন চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন।

ছনুয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম. হারুনুর রশিদ বলেন 'আমার এলাকায় কয়েকশ,ত নলকুপ থাকলেও বর্তমানে তার বেশিরভাগ নলকুপে পানি না উঠার কারনে সাধারন জনগন পানীয় জলের সমস্যার মধ্যে রয়েছে । উপকুলীয় এলাকায় লবনাক্ত পানি থাকার কারণে এখানকার জনগনের নলকুপের প্রচুর চাহিদা প্রয়োজন হলে ও সে অনুসারে নলকুপ পাওয়া যায় না সরকারি ভাবে। ব্যক্তিগত ভাবে নলকুপ বসাতে এক লক্ষ থেকে দেড় লক্ষ প্রয়োজন প্রয়োজন পড়ে।' শেখেরখীল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মু. ইয়াছিন বলেন- 'আমার ইউনিয়নের অধিকাংশ জায়গায় কোন নলকুপ নেই। সরকারি ভাবে এবং বিভিন বেসরকারি সংস্থা ও ইপসার মাধ্যমে প্রাপ্ত কিছু নলকূপের সুবিধা জনগণ পেলেও এখানে আরো চাহিদা রয়েছে। শিলকূপ ইউপির চেয়ারম্যান মুহাম্মদ মহসিন বলেন, 'শুষ্ক মৌসুমের ফলে বর্তমানে অধিকাংশ নলকুপে পানি না উঠার কারণে জনগন নানা ভাবে কষ্টের স্বীকার হচ্ছে বিশুদ্ধ পানি নিয়ে। সরকারীভাবে বরাদ্দ আসলেও তা নগন্য। যার ফলে শীলকূপের বেশীরভাগ গ্রামেই পানীয় জলের তীব্র সংকট দেখা দেয়।

সরেজমিনে দেখা যায়- উপজেলার ছনুয়া, শেখেরখীল, গন্ডামারা, শিলকূপ, সরল, কাথরিয়া সহ বেশকিছু উপকূলীয় এলাকায় সন্ধ্যা হলেই গ্রামের বৌ-ঝি'রা লাইন ধরে পানির জন্য। বিদ্যুৎ চালিত যন্ত্রের সাহায্যে লাইন ধরে পানি সংগ্রহের প্রতিযোগীতা চলে প্রতিদিনই। অনেক সময় অঘোষিত বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় পানি সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায় গ্রামের বৌ-ঝি'রা। এভাবে প্রায় এলাকায় সন্ধ্যা নামলেই পানীয়জলের জন্য লম্বা সারিতে দাঁড়াতে দেখা যায় গ্রামের বৌ-ঝিদের। শিলকুপের জালিয়া পাড়া ও শাপলা পাড়ায় যে কয়টি নলকুপ আছে তা অকেজো হয়ে পড়ায় বিগত ৩ বছর যাবৎ পানি সংকটে ভুগছে তারা। এহেন অবস্থায় এলাকায় বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাবে নানা রোগ দেখা দিচ্ছে। মিনজির তালা কাহারঘোনা ও চাম্বলের মুন্সিখীল এলাকায়ও মারাত্মক পানি সংকটের কবলে। ভাদালিয়ার কাননগোখীলে সন্ধ্যা হলেই স্থানীয় মোটর থেকে পানি সংগ্রহের প্রতিযোগীতায় দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে দেখা গেছে স্থানীয়দের।

উপকূলীয় এলাকায় শত শত নলকূপ অকেজো হয়ে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে যার কোন সংস্কার করা হয়নি। মাত্র কয়েকটি নলকুপেই পানীয় জলের অভাব পুরুণ করছে স্থানীয়রা। অনেকদিন ধরে বাঁশখালীবাসীর চাহিদা অনুযায়ী কোনো নলকূপ বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া সরকারিভাবে বরাদ্দ পাওয়া নলকূপে শুষ্ক মৌসুমে পানি পায় না জনগণ। বর্তমানে বাঁশখালী পৌরসভাসহ ১৪টি ইউনিয়নের মানুষ তীব্র পানি সংকটে ভুগছে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের বাশঁখালীর দায়িত্বরত উপ-প্রকৌশলী মু. নাজিম উদ্দিন রাসেল বলেন- 'একদিকে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া, অন্যদিকে বৈদ্যুতিক মোটর এবং সাবমার্সিবল পাম্প চালিয়ে গভীর নলকূপের মাধ্যমে অনেক নিচ থেকে পানি তুলে নেওয়ার কারণে এ সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। বর্তমানে পানির স্তর ৪০-৫০ ফুট নিচে নেমে যাওয়ার ফলে আগের বসানো নলকুপ গুলোতে এ মৌসুমে পানি উঠছেনা। তবে বর্ষাকালে পূনরায় পানি উঠবে।'
তিনি আরো বলেন- ' সমগ্র বাংলাদেশে পানি সরবরাহ প্রকল্পের উদ্যোগে বাঁশখালীতে ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ৩শত ৬৪টি সাবমার্সিবল টিউবওয়েল বসানো হবে। প্রতিটি ইউনিয়নে প্রায় ২৬টি করে নলকূপ স্থাপন করা হবে। আশা করছি দু'এক মাসের মধ্যেই পানীয় জলের সংকট দূর হবে। সরকারী ভাবে সাংসদ মুস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর সহযোগীতায় বিভিন্ন ইউনিয়নে আমরা গত বছর ৮০০-৯৫০ ফুট গভীরে বেশ কয়েকটি নলকূপ স্থাপন করেছি। প্রতিটি নলকূপের ব্যয় প্রায় ২ লক্ষাধিক টাকার উপরে। নলকুপের চাহিদা বেশি হলেও সরবরাহ কম। তবে ২০২৫ সাল পযর্ন্ত সরকারী ভাবে আরো বেশী পরিমান বরাদ্দ আসতে থাকবে।'

এদিকে বাঁশখালীতে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা যে নলকূপ স্থাপনে অবদান রাখে তারা যদি যৌথ পরিকল্পনার মাধ্যমে যেসব এলাকায় পানীয় জলের তীব্র সংকট থাকে সেসব এলাকায় জরুরি ভিত্তিতে নলকূপ স্থাপন করে তাহলে পানীয় জলের সংকট অনেকটা কম হবে বলে জানান স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।