image

বুলিয়িং- ইংরেজিতে- Bullying

image

বুলিয়িং- ইংরেজিতে- Bullying. এর কোনো সঠিক এক শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ নেই খুব সম্ভবত। ভাবানুবাদ দাঁড়ায় কাউকে/কারো কোনো সীমাবদ্ধতা নিয়ে মানসিক/শারীরিক উৎপীড়ন বা হেয় প্রতিপন্ন করা।

এর শুরু হয় পরিবার থেকে। সমাজ ও স্কুলে চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। অনেক সময় মৃত্যুতে শেষ হয়। কিন্তু সবার ভাগ্যে মৃত্যুর শান্তি জোটেনা। আজীবন এর গঞ্জনা ভোগ করতে হয়। গতকাল সোশ্যাল মিডিয়াতে বুলিয়িং এর শিকার এক শিশুর মৃত্যুতে সবাই একটু ভাবছে বিষয়টা নিয়ে।

আমি ছিলাম জন্মগতভাবে হাই মায়োপিক বা কনজেনিটাল মায়োপিক রোগী। অর্থাৎ সোজা বাংলায় আমৃত্যু আমাকে উচ্চ মাইনাস পাওয়ারের চশমা ব্যবহার করতে হবে। আমাদের সময়ে মায়োপিক বাচ্চা খুব কম দেখা যেত, বা থাকলেও বাবা-মার অসচেতনতায় তা ধরা পড়তো না। ফলত স্কুলে আমি একমাত্র চশমা পরিহিত ছাত্র ছিলাম। ফলাফল অনুমেয়।

আমার বাবা-মা এবং আমার বাবা- মা’র উভয় দিকের পরিবার ছিল আমার ক্ষেত্রে অসম্ভব সাপোর্টিভ। কোনোদিন আমার চশমা বা আমার হ্রস্ব দৃষ্টি নিয়ে কোনো কথা শুনতে হয়নি। বরং পিজি হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের তৎকালীন প্রধান, চট্টগ্রামের গর্ব ড. আহমদ শরীফের তত্ত্বাবধানে আমার চোখের চিকিৎসা চলতো। আমার বাবার দৃঢ়তায় তা সম্ভব হয়েছে। স্কুলে লম্বা ছেলেরা পেছনে বসার নিয়ম ছিল। আমার বাবা সব স্কুলে গিয়ে প্রতি ক্লাসে আমার সামনে বসা নিশ্চিত করতেন ব্ল্যাক বোর্ড দেখতে যাতে সুবিধা হয়।

অথচ, আমার পাশের বাড়ির মানুষজন, আমার নিকটাত্মীয় অনেকেই আমাকে 'হানাইয়ে' (চাটগাঁইয়া ভাষায় কানা) বলে ডাকতে শুনেছি। আমার পরিবারের সবাই ওই আত্মীয়গুলোর ওপর খুব বিরক্ত ছিল এই বিষয় নিয়ে।

স্কুল কর্তৃপক্ষের ওপর আমার বাবার কড়াকড়ি ছিল এই বিষয়ে বুলিয়িং যাতে না হয়, আমার বাবা গিয়ে প্রিন্সিপ্যালকে সতর্ক করতেন। তারপরেও দুয়েকজন শিক্ষক শিক্ষিকা মাঝে মাঝে এই নিয়ে বুলিয়িং করে ফেলতেন। আমার কান্না কাটিতে তাঁরা বিব্রত হয়ে অনুশোচনায় ভুগতেন। আমার সহপাঠীরা খুব একটা বুলিয়িং করেনি, এটা সত্য এবং বেশিরভাগই ছিল সাপোরটিভ। তারপরেও কিছু সিনিয়র করে ফেলতো। আমার রেজাল্ট ছিল খুব ভালো। আমি ছিলাম দাপুটে। পাওয়ারফুল ফ্যামিলির ছেলে। ছিলাম ক্লাস ক্যাপ্টেন। পরপর কয়েক বছর ক্যাপ্টেন্সি করায়, কয়েকজন আমার ক্যাপ্টেন্সি নিয়ে চ্যালেঞ্জ করে। আমি সাথে সাথে মধ্যবর্তী ভোট দিয়ে দিয়েছিলাম।বিপুল ভোটে জিতে আবার ক্যাপ্টেন্সি পুনরুদ্ধার। ক্লাসের মেয়েদের সব ভোট ও ছেলেদের অনেক ভোট আমি পেয়েছিলাম।
আমার প্রাইমারি স্কুল ছিল চট্টগ্রাম পিটিআই। এই স্কুলে সব প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ট্রেনিং নিত ও সনদ লাভ করতো। তাই পরিবেশ ছিল খুব উন্নত।

হাই স্কুলে খুব একটা ঝামেলা হয়নি, আশ্চর্যজনকভাবে। ধানমণ্ডি গভ. বয়েজ হাই স্কুল ও নাসিরাবাদ গভ. বয়েজ হাই স্কুল। দুটো স্কুল নিরুপদ্রপ কেটেছে। কলেজে যাওয়ার পর আমি ব্যাপক বুলিয়িং এর শিকার হই। সরকারি কমার্স কলেজ। কিন্তু, পরিবেশ তত উন্নত না হওয়ায় আমি কলেজের বুলিয়িং গ্রূপকে এভয়েড করা শুরু করি। যদিও আমার কনফিডেন্স লেভেল ছিল অটুট।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ। বিশ্ববিদ্যালয়েও বুলিয়িং চলতে থাকে। কিন্তু, আমি ইগনোর করতে শিখে গিয়েছি। ফলে, তাদের তেমন সুযোগ ও সাহস হয়নি। সাথে ছিল আমার বন্ধু বান্ধবী ও সিনিয়র জুনিয়রদের বিশাল সাপোর্ট। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেই লেভেলে চলাফেরা করেছি, তা অনেকেই শুধু স্বপ্ন দেখত। দাপটের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে কর্ম জীবনে প্রবেশ।

এখানেও রেহাই নেই। বার বছর চাকরি জীবনে সামনে কম্পিউটার নিয়েই কেটেছে। চোখের সমস্যার কারণে, অনেক সহকর্মীর উপহাসের স্বীকার হয়েছি। যেহেতু কম্পিউটার মনিটর অন্যদের তুলনায় কাছে রেখে দেখতে হতো, আর ফন্ট সাইজ তুলনামূলক বড় ছিল, ফলে অনেকেই এটা নিয়ে উপহাস করতো। আমি তাদের পাত্তাই দিতাম না। বলতাম, পরীক্ষা দিয়ে সিনিয়র পোস্টে ঢুকেছি। কারো লবিংয়ে না। আগে আমার সমান যোগ্যতা অর্জন করে আসো। এখানেও সহকর্মীদের সাপোর্ট ও ভালোবাসায় সিক্ত হলাম। কিন্তু, আমার কনফিডেন্স আমি হারাইনি। আর কনফিডেন্সের ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছে, আমার বাবা-মা।

বুলিয়িং প্রতিরোধে পরিবারের সাপোর্ট/সহায়তা খুব জরুরি। অথচ, অনেক পরিবারই বুলিয়িং এর উর্বর ক্ষেত্র হয়ে যায় অনেক সময়। সব সন্তান সমান হয়না। সবার যোগ্যতাও সমান হয়না। আর জন্মগত বা প্রাকৃতিক বা অতিপ্রাকৃতিক অযোগ্যতায় তো কারো হাত নেই।

পরম করুণাময় সবাইকে বোঝার সক্ষমতা দিন। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম নিরাপদ হোক।

লেখক : সাইফুল আবেদীন, আইনজীবি, চট্টগ্রাম জর্জ কোর্ট।