শিরোনাম
মো.কামরুল ইসলাম মোস্তফা, চন্দনাইশ প্রতিনিধি | ২০:৫০, মার্চ ১২, ২০২১
চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারী ৩১শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে নিজেই এখন রোগী। দোহাজারী পৌরসভাসহ চন্দনাইশ-সাতকানিয়া (আংশিক) উপজেলার আট ইউনিয়নের প্রায় তিন লক্ষাধিক মানুষের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতের জন্য ১৯৬৫ সালে ১০ শয্যা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় দোহাজারী হাসপাতাল। চাহিদার উপর ভিত্তি করে পর্যায়ক্রমে ১৯৯০ সালে হাসপাতালটি ৩১ শয্যায় উন্নীত করা হলেও নিয়োগ দেয়া হয়নি প্রয়োজনীয় সংখ্যক জনবল। এ অঞ্চলের মানুষের জন্য চিকিৎসা সেবার একমাত্র ভরসাস্থল হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠার ৫৬ বছরেও প্রয়োজনীয় সংস্কার না করায় এটি এখন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। নির্মাণের পর থেকে সঠিক পরিচর্যা ও দেখভালের অভাবে হাসপাতালটি রূপ নিয়েছে জরাজীর্ণ ভবনে।
সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের চারপাশের দেয়ালে ফাটল ধরেছে। মুল ভবনের অনেকাংশে খসে পড়ছে ছাদের পলেস্তারা। দ্বিতল ভবনের পশ্চিম এবং উত্তর পাশে ছাদের বিশাল আকারের অংশ খসে পড়ে রড বের হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ঝুলে আছে। তাছাড়া ভবনের ভেতরেও ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ার আশংকা করা হচ্ছে। যেকোন মুহুর্তে ভবনটির বিশাল অংশ খসে পড়ে প্রাণহানিসহ বড় ধরণের দূর্ঘটনার আশংকা করা হচ্ছে। এ অবস্থায় অত্যান্ত ঝুঁকিপূর্ণভাবে ভবনটিতে চলছে চিকিৎসা সেবা। এতে
হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা যেমন আতংকে রয়েছেন চিকিৎসকেরাও আতংকের মধ্যে সেবা প্রদান করছেন। হাসপাতালটি ঝুঁকিপূর্ণ হলেও এখানকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বাধ্য হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে।
অপরদিকে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থারও করুন দশা।বাথরুমের পাইপ ফেটে ময়লা-আবর্জনা বেরিয়ে সয়লাব হয়ে পড়েছে ভবনের চারপাশ। মানববর্জ্যের দুর্গন্ধে রোগীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধে আরো অসুস্থ্য হয়ে পড়ছেন।
হাসপাতালটিতে গোদের উপর বিষ ফোঁড়া হলো জনবল সংকট। জনবল সংকটে ব্যাহত হচ্ছে কাঙ্ক্ষিত সেবা। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক, নার্স, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী না থাকায় হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম প্রায় ভেঙ্গে পড়েছে। দোহাজারী পৌরসভার পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন ধোপাছড়ি, হাশিমপুর, সাতবাড়িয়া, বৈলতলী, পুরানগড়, কালিয়াইশ, আমিলাইষ ও খাগরিয়ার মধ্যবর্তীস্থানে হওয়ায় দোহাজারী ৩১শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে রোগীর চাপ বেশি। এসব ইউনিয়ন থেকে আসা রোগীদের চাপ সামলাতে কর্তব্যরত
চিকিৎসকদের হিমশিম পোহাতে হয়।
হাসপাতালটি চট্টগ্রাম -কক্সবাজার মহাসড়কের পাশে হওয়ায় মহাসড়কে কোন সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলে ট্রমা সেন্টার না থাকায় আহত রোগীদেরও ঠাঁই হয় দোহাজারী হাসপাতালে। প্রতিদিন হাসপাতালের বহির্বিভাগে গড়ে ৩শ' জন রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। প্রতিদিন গড়ে ২৫-৩০ জন রোগী ভর্তি হচ্ছেন। নতুন ও পুরোনো মিলে প্রতিদিন ৩১শয্যার বিপরীতে ৭০-৮০ জন রোগী চিকিৎসা নেন। প্রয়োজনের তুলনায় স্বল্প সংখ্যক চিকিৎসক দ্বারা রোগীদের নিয়মিত চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হচ্ছে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, হাসপাতালটিতে ডেন্টাল সার্জনসহ বর্তমানে ৮ জন চিকিৎসক কর্মরত থাকলেও করোনাকালীন সময়ে মেডিসিন কনসালটেন্ট ডা. সাইফুদ্দিন মাহমুদ ও গাইনি কনসালটেন্ট ডা. রেহনুমা তারান্নুম সুমী ও একজন মেডিকেল অফিসারকে করোনা বিশেষায়িত চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ডেপুটেশনে নিয়ে যাওয়ার পর প্রায় একবছর পার হলেও অদ্যাবধি তারা দোহাজারী হাসপাতালে যোগদান করেননি।ফলে বিপুল সংখ্যক রোগীকে চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন হাসপাতালটির চিকিৎসকেরা।
এছাড়া ১৩ জন নার্সের স্থলে কর্মরত আছেন ৭ জন। ৪ জনের স্থলে ওয়ার্ড বয় রয়েছেন ২ জন, পরিচ্ছন্নতা কর্মী আছেন ২ জন। ১৬শয্যার পুরুষ ও ১৫শয্যার মহিলা ওয়ার্ডে ২জন ওয়ার্ড বয় এবং ২জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী রয়েছেন। যা প্রয়োজনের তুলনায় কম। আরও ২ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী দরকার বলে জানান চিকিৎসকেরা।
সেকমো, ফার্মাসিস্ট, স্টোর কিপার ও কম্পিউটার অপারটরের পদ থাকলেও তা শূণ্যই রয়ে গেছে।ভারপ্রাপ্ত দিয়েই চালানো হচ্ছে কর্মকাণ্ড।
টেকনিশিয়ান না থাকায় হাসপাতালের পুরাতন এক্সরে মেশিনটিও তেমন ব্যবহার হয়না।
ডেন্টাল মেশিনটি নষ্ট হয়ে পড়ে আছে গত ছয় বছর। ডেন্টাল সার্জন থাকলেও নেই এসিস্যান্টের পদ।
অ্যাম্বুলেন্স চালকের পদ না থাকায় দীর্ঘ তিন বছর তালাবদ্ধ গ্যারেজে থাকার পর গত ২০১৯ সালের জুলাই মাসে পুনরায় চালু হওয়া অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে রোগী আনা নেয়া করে হচ্ছে আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত চালক দিয়ে।
দ্রুততম সময়ে পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগের মাধ্যমে কাংখিত সেবাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি জরুরি ভিত্তিতে বর্তমান দ্বিতল ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে ১শ শয্যার নতুন ভবন নির্মাণ করার দাবি জানান স্থানীয়রা।
এব্যাপারে দোহাজারী হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডাঃ মোহাম্মদ আবু তৈয়্যব বলেন, "ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ার বিষয়টি ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে অবহিত করা হয়েছে।"
জনবল সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, "৩১শয্যার হাসপাতাল হলেও গড়ে প্রতিদিন রোগী ভর্তি থাকেন ৬০-৭০ জন। অপ্রতুল জনবল নিয়ে বিপুল সংখ্যক রোগীকে চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। জনবল ও শয্যা সংকটের বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।"
এব্যাপারে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে চন্দনাইশ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ মোঃ শাহীন হোসাইন চৌধুরী বলেন, "দোহাজারী ও পার্শ্ববর্তী ৪-৫ টি ইউনিয়নের রোগীরা দোহাজারী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন। এজন্য হাসপাতালটিতে রোগীর চাপ বেশি। ৩১শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে যেরকম অবকাঠামো এবং জনবল থাকা প্রয়োজন তা আছে। তবে করোনা সংকটের কারণে কয়েকজন চিকিৎসককে করোনা বিশেষায়িত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ায় চিকিৎসক স্বল্পতা দেখা দিয়েছে।
সাব সেন্টার থেকে একজন সেকমোকে ডেপুটেশনে এনে দোহাজারী হাসপাতালের জরুরি বিভাগে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
বেশিরভাগ হাসপাতালেই তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী সংকট বিদ্যমান উল্লেখ করে তিনি বলেন, "আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে কয়েকজনকে নিয়োগ প্রদান করে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে রোগীদেরকে কাংখিত সেবা প্রদানে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাচ্ছি।"
এব্যাপারে চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডাঃ সেখ ফজলে রাব্বির সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, "দোহাজারী হাসপাতালের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের বিষয়টি ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরকে অবহিত করেছি। আবারও তাদের সাথে কথা বলবো এব্যাপারে।"
জনবল সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, "জনবলের জন্য ঢাকায় নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে। চিকিৎসক ও নার্স যা আছে তা দিয়ে আপাতত চলে। তবে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর জনবল আমাদের খুবই কম। যেহেতু নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে, আশা করি কয়েকদিনের মধ্যেই আমরা কিছু জনবল পাবো।"
দোহাজারী ৩১ শয্যা হাসপাতাল এখন নিজেই রোগী
Developed By Muktodhara Technology Limited