শিরোনাম
ফজলুর রহমান | ১৭:১৬, মে ১২, ২০২০
কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন "চিরসুখীজন ভ্রমে কি কখন/ ব্যথিতবেদন বুঝিতে পারে।/কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে/কভূ আশীবিষে দংশেনি যারে।" ব্যন্ডদল দল মাইলস গানে বলেছে, 'পেয়ে হারানোর বেদনায় পুড়ে চলেছি সারাক্ষণ।'
জীবন এমনই- হারানোর যাতনা দিয়ে প্রাপ্তির দাম চেনায়। বিশ্ন জীবন এখন করোনাময়। প্রায় একই হতশ্রী রূপ বিশ্বময়। এই অচেনা পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আমরা অনুভব করছি কিছু জীবনানন্দের অনুপস্থিতি। তেমন কিছু পয়েন্ট খতিয়ে দেখা যাক।
গণ গায়েবঃ তারকারা গানে গানে আহবান জানাচ্ছেন,' চলো একসাথে দূরে থাকি/বিশ্বাসে কাছাকাছি /দূরে দূরে কাছে থেকে/ দেশটাকে ভালো রাখি।' করোনাকালের অবস্থা আসলে এমনই। ভালো থাকতে হলে দূরে থাকতে হবে। একতাবদ্ধ উপস্থিতিতে এখন শক্তি নেই, বিপদে ভরপুর। বিচ্ছিন্ন অবস্থানেই মুক্তি। গণজমায়েত জাতীয় সব বাতিলের খাতায়। সভা, সেমিনার, বৈঠক, সালিশ, কোর্ট-কাচারি, উপাসনালয়, ক্লাসরুম থেকে খেলার মাঠের গ্যালারি সবখানে হাহাকার চিত্র। একটি বিপুল জনপ্রবাহ যে চাঞ্চল্য আনে সেই প্রাণচাঞ্চল্যের অভাব ব্যাপকভাবে অনুভূত হচ্ছে। মনে হচ্ছে এই নিথর ভয়াল জনপদ আমাদের জগত নয়।
কোথাও নেই করমর্দনঃ করমর্দন বা হ্যান্ডশেক শুভেচ্ছা বিনিময়ের জনপ্রিয় পন্থা। দুজন মানুষের মধ্যে শান্তির প্রতীক হিসেবেও এটি ব্যবহৃত হয়। কারণ হ্যান্ডশেকের সময় দেখানো যায় যে কারো হাতে কোনো অস্ত্র নেই।
একটি ধারণা প্রচলিত রয়েছে এর উৎপত্তি প্রাচীন গ্রিসে। আরেকটি ধারণা হলো হ্যান্ডশেকের রীতি চালু হয়েছে মধ্যযুগীয় ইউরোপে। সামরিক পদমর্যাদার নাইটরা একে অপরের হাত ধরে নাড়তে থাকতেন যাতে কেউ অস্ত্র লুকিয়ে রাখতে না পারে। এর পর থেকে ধীরে ধীরে নানা কারণে এই করমর্দন জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী ক্রিস্টিন লিগার বলেছেন, "মানুষের সঙ্গে মানুষের সংযোগের একটি শারীরিক ভাষা এই হ্যান্ডশেক এবং মানুষ কীভাবে ক্রমশ সামাজিক ও স্পর্শপ্রবণ প্রাণী হয়ে উঠেছে তারই প্রতীক এটি। স্পর্শের গুরুত্ব বোঝাতে এর বিকল্প হিসেবে আমরা কনুই দিয়ে আরেকজনের কনুইতে টোকা দিচ্ছি। কারণ আমরা শারীরিক সংযোগের এই প্রথাকে হারাতে চাই না। "
আসলেই কনুইগিরি কিংবা পা টুকাটুকিতে কি আর হ্যান্ডশেকের সেই স্বাদ পাওয়া যায়!! এখন আর হাতে কেউ হাত রাখে না। হাতখানি ধরো হাতে -এমন করে চলার মিষ্টি সুযোগও নেই।
কোলাকুলিঃ গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডজয়ী মিকো ফন হার্টজেন একবার বলেছিলেন, কোলাকুলিটা কেবল সৌজন্যতা নয় এটি আসলে একটা শক্তি। তিনি কোলাকুলির শক্তি রহস্য তুলে ধরে বলেন ‘‘কোলাকুলিটা শুধু শারীরিক ব্যাপার নয়, এর ফলে তাঁর ভেতর থেকে এমন একটা কিছু বেরিয়ে আসে যা আমাদের মনে স্নেহের বীজ বুনে দেয়৷''
এই কোলাকুলি ভেদাভেদ তাড়ায়। মানুষকে পরস্পরের দিকে কাছে টানে। এই কোলাকুলির স্বর্গীয় সুখটার অভাব এখন টের পাওয়া যাচ্ছে হাড়ে হাড়ে। মুসলমানদের ঈদ মানে কোলাকুলি। এখন সেই কোলাকুলিহীনা ঈদটাও পানসে হবে হয়তো।
কাতার খতমঃ মসজিদে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে ধনী-গরিব, জাত-পাত ভুলে সকলে এক হতেন। এমন কাতারবন্দি দৃশ্য এখন নেই আর। অন্যান্য উপাসনালয়েও দূরত্ব রেখা দৃশ্যমান। স্রষ্টার কাছে সমবেত স্বরে প্রার্থনা করার পরিবেশ নেই এখন। যে যেভাবে পারছেন অপরজন থেকে দূরে থাকছেন।
অথচ স্রষ্টা নিজেই বিভিন্নভাবে বার্তা দিয়েছেন কাতারে কাতারে শামিল হয়ে প্রার্থনায় বসতে। মানুষের পাশে থাকতে। বিচ্ছিন্ন না হতে। হাজার হাজার বছরের লালিত এই গণসংহতি এখন আর মিলছে না।
অসামাজিকতার রাজত্বঃ Human Phycology’র Culture এর দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, পৃথিবীর সেই শুরু থেকে মানুষ সাধারণত সঙ্গবদ্ধ ভাবে জীবন-যাপনে অভ্যস্ত। পাহাড়ের গুহায়, বনে-জঙ্গলে, লোকালয়ে যেখানেই হোক না কেন মানুষ তার আত্মীয়, সঙ্গী-দল-গোষ্ঠী ইত্যাদির সাথে একত্রে বসবাস করে জীবন সংগ্রাম চালিয়ে এসেছে। যা আজকের আধুনিক বিশ্ব গড়ে ওঠার ক্রমান্বিত স্টেজেও যথারীতি প্রবাহমান। একটি পরিবার, গোষ্ঠী-গোত্র, সমাজ, রাষ্ট্রের সাফল্যের অন্যতম কারণ হলো এই সামাজিক একতা।
একটি সামাজিক শৃঙ্খলতার মাধ্যমে ব্যক্তির মাঝে সততা, নির্ভীকতা, বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা, ন্যায়-নীতি, শিষ্টাচার, সামাজিকতা, রাজনীতি ইত্যাদির সুউচ্চ শিক্ষণ গড়ে ওঠে। যা একটি বিকাশমান জাতি গঠনে বিশেষ ভুমিকা রেখে জাতির সভ্যতা- ঐতিহ্যকে বিকাশমান করে। কিন্তু করোনা ভাইরাসের মহামারীতে সেই সামাজিকতা আজ ভেঙে ব্যক্তি বা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিবারে পরিণত হচ্ছে। ফলে পারিবারিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক তথা আর্থ-সামাজিক পারস্পরিক স্নেহ-মমতা, ভালোবাসা, বিশ্বাস-ভক্তি, শ্রদ্ধা, শৃঙ্খলা বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
মানুষ মাত্রই সামাজিক জীব। সমাজেই মানুষের আসল প্রকাশ। সেই সামাজিকতার চিরন্তন আবেদনের অনুপস্থিতি এখন খুব বেশি ধরা পড়ছে।
বাইরে বারণঃ ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া ধানের শীষের উপর শিশির বিন্দু দেখার আক্ষেপ করেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিশ্বকবি দুয়ারের বাইরে বের হবার আহবান জানিয়েছেন নানাভাবে। যেমন-"ওরে গৃহবাসী/ খোল্, দ্বার খোল্, লাগল যে দোল।/স্থলে জলে বনতলে লাগল যে দোল। দ্বার খোল্, দ্বার খোল্॥" বিদ্রোহ ও প্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলাম তো কেবল দরজার বাইরে পা রেখে তুষ্ট হননি, এই জগতটাকেও হাতের মুঠোয় ভরতে চেয়ে বলেছেন,"থাকব না কো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে।"
দরদ ভরা কন্ঠে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গেয়েছেন-
"এই মেঘলা দিনে একলা/ঘরে থাকে না তো মন/
কাছে যাব কবে পাব/ওগো তোমার নিমন্ত্রণ।।"
তবে এইসব গান-কবিতা এখন বনবাসে। বাংলাদেশ তথা সমগ্র বিশ্বের মানুষ প্রানঘাতী করোনা মহামারির ভয়াল থাবা থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য এখন অনির্দিষ্ট কালের জন্য ঘরে আবদ্ধ জীবন কাটাচ্ছেন। বিশেষজ্ঞ ও মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, এ পরিস্থিতিতে বেশির ভাগ মানুষ বিভিন্ন কারনে মানসিক চাপের মধ্যে দিনাতিপাত করছেন। এই চাপমুক্তির জন্য বাহির পানে তাকানো জরুরি। এই বাইরের জীবনের অভাব সবার মাঝে পরিলক্ষিত হচ্ছে গত কয়েক মাসে।
আড্ডায় নিষেধাজ্ঞাঃ আগে ট্রাকের পিছনে যে লেখাটা দেখা যায়,আজ সেটা মানুষের পিছনে লেখার সময় এসেছে-"দূরত্ব বজায় রাখুন"। এমন পরিস্থিতিতে কি জমিয়ে আড্ডা হয়! হয় না। আড্ডাকে বলা হয় সৃজনশীল কাজ। যে মানুষ সারাক্ষণ দৌড়ায় তার মাঝে সৃজনশীলতার সুযোগ কম। একটু আলসেমি আড্ডা নতুন আইডিয়া আনে। যা জীবনের মোড়ও ঘুরিয়ে দিতে পারে। তেমন কার্যকর আড্ডাগুলো বড় মিস্ হচ্ছে এখন। ডিজিটাল আড্ডা তো বদ্ধ ঘরে ফ্যানের বাতাস। প্রকৃতির সুবাতাসের মতো মন জুড়ায় কেবল মুখোমুখি আড্ডা।
ভ্রমণ বন্ধঃ মানুষ চির যাযাবর । মানুষের রক্তে রয়েছে ভ্রমণের নেশা । অজানাকে জানার অদেখাকে দেখার কৌতুহল মানুষের চিরন্তন। বিশাল এই পৃথিবীর চারিদিকে কত কি দেখার, জানার রয়েছে, কত রহস্য রয়েছে লুকিয়ে । সেই অপরিচয়ের দুস্তর মহাসমুদ্রের অদৃশ্য তরঙ্গ প্রতিনিয়ত আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকে । সেই অজানাকে জানবার জন্যে আমাদের অসীম আগ্রহ, অনন্ত উৎকণ্ঠা । এই দুর্নিবার আকর্ষণে আমরা রুদ্ধ দুয়ার খুলে বের হয়ে পড়ি অজানার সন্ধানে । এখন সেই ভ্রমণের অভাব খুব অনুভূত হচ্ছে এখন।
সহপাঠ/সহশিক্ষা সংক্ষিপ্তঃ সহপাঠে প্রতিযোগিতা থাকে। বিনিময়ে বিনিময়ে সমৃদ্ধ হওয়া যায়। আচার-আচরণে পরিপক্বতার ছাপ আসে। সহ-শিক্ষা পাঠক্রমিক কার্য বলতে সাধারণভাবে পুঁথিগত বিষয়ের বাইরে জ্ঞানার্জনের প্রক্রিয়াসমূহকে বোঝায়। এই প্রক্রিয়া শিক্ষার্থীর মানসিক বিকাশের সাথে সাথে সামগ্রিক জীবন ও সৃজনশীলতার বিকাশে পূর্ণ সহযোগিতা করে। এ ধরনের কার্যাবলী শ্রেণীকক্ষের পঠন পাঠনের একঘেঁয়েমী ও অবসন্নতা দূর করে এবং সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশে সহায়তা করে। ছাত্র-ছাত্রীদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঘটায় ও তাদেরকে মূল্যবোধে উজ্জীবিত করে। অধিকন্তু প্রতিষ্ঠানের সহ-পাঠক্রমিক কার্যাবলীতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের প্রতিষ্ঠানের প্রতি আনুগত্য বৃদ্ধি পায় এবং দেশ ও সমাজ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। সহপাঠক্রমিক কার্যাবলী হিসেবে বিদ্যালয়ে বিভিন্ন ধরণের শরীরচর্চামূলক কাজ, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, দেয়ালিকা, লেখালেখি, বিজ্ঞান মেলা,বইমেলা, কবিতা লেখা, গল্প লেখা, ছবি আঁকা ইত্যাদি শিক্ষামূলক অনেক কাজের বেশ গুরুত্ব থাকে। এছাড়া বিভিন্ন জাতীয় ও ধর্মীয় দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বর্তমানে ক্লাসের পাশাপাশি সব বন্ধ। জোড়াতালির অনলাইন কার্যক্রমে সেই চেনা পরিবেশ নেই। প্রাণহীন বিচ্ছিন্ন ব্যবস্থায় টিকতে হচ্ছে। সবার মনে তাই প্রশ্ন- সেই দিনগুলি কই? আবার কবে আসবে ফিরে।
সবখানে সংশয়ঃ সংশয় থাকা ভালো। কোন কিছু এক বাক্যে সকলে মেনে নিলে এই দুনিয়ায় এতো রূপবৈচিত্র্য আসতো না। একঘেয়ে হতো। সভ্যতার উন্নতিও হতো না। নতুন সৃষ্টিও পেতাম না। কিন্তু এ কেমন সংশয় এনে দিলো করোনা! উঠতে বসতে সংশয়। কখন কি যে হয়! কিভাবে হয়, হলে কি হয়, কি হবে ইত্যাদি!!
সন্দেহের দোলাচালে জীবন। অস্থির অবস্থায় কাটছে মাসের পর মাস। লকডাউনে সকলে কেবল পড়েই যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথকে "সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান।/সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ।/মুক্ত করো ভয়, আপনা-মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়।" তবে না মিলেছে মুক্তি। না কেটেছে ভয়।
সংশয়ে সব সংকল্প সদা টলে যাচ্ছে। ভয়মুক্ত স্বাভাবিক জীবনকে খুব মিস করছে জগতবাসী।
লেখক : সহকারী রেজিস্ট্রার, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)।
Developed By Muktodhara Technology Limited