image

আজ, বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ইং

‘আমরাও যদি ঐ ভাষায় কথা বলি, তখন?’-ভুট্টো গং-এর প্রতি শেখ মুজিব

আসুন, পরিষদেই সমাধান খোঁজা হইবে : বঙ্গবন্ধু

মোহাম্মদ ওমর ফারুক দেওয়ান    |    ২০:০০, মার্চ ১, ২০২১

image

২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১। কেমন ছিল সেদিনটি? তার চিত্র পাই ১লা মার্চ, ১৯৭১ সালের পত্রিকা থেকে। অগ্নিঝরা মার্চ বুঝতে হলে নতুন প্রজন্মকে সে সময়ের ঘটনাপ্রবাহ বুঝতে হবে। মার্চ নিয়ে গত ৫০ বছরে অনেক লেখালেখি হয়েছে। আমরা কিছুটা পড়েছি, কিছুটা বুঝেছি, কিছুটা এড়িয়ে গেছি। কিন্তু ইতিহাসের দায় হলো ঘটনার হুবহু তুলে ধরে সে সময়কে নতুন করে উপস্থাপন করা, হৃদয়াঙ্গম করানো। তার কিছুটা প্রয়াস নিয়ে ১৯৯৭১ সালের মার্চ মাসের দৈনিক ইত্তেফাকের কিছু সংবাদ নতুন প্রজন্মের কাছে প্রায় হুবহু তুলে ধরার চেষ্টায় আজ ধারাবাহিকের ১লা মার্চের পত্রিকার সংবাদ তুলে ধরা হলো । 

আসুন, পরিষদেই সমাধান খোঁজা হইবে : আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানী জাতীয় পরিষদ সদস্যগণকে ঢাকায় আসিয়া শাসনতন্ত্র প্রণয়নে অংশগ্রহণের আহবান জানাইয়াছেন। গতকাল (রবিবার) ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রীর সম্বর্ধনাসভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান আশ্বাসদান করেন যে, একজন সদস্যও কোন ন্যায়সঙ্গত প্রস্তাব দিলে তা গ্রহণ করা হইবে।

শেখ মুজিব বর্তমানে জাতীয় পরিষদে আসা বা না আসা নিয়া যে জল্পনা চলিতেছে তৎসম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন, ৮৩ জন্য সদস্য নিয়া আপনি যদি আসিতে না চান, ১৬০ জন সদস্য লইয়া আমরা যদি বলি আমরা যাইব না সেক্ষেত্রে কি হইবে? পূর্বাহ্নে প্রতিশ্রæতিদান প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে, পূর্বাহ্নে কি করিয়া প্রতিশ্রæতি দেওয়া যাইতে পারে? তিনি বলেন, ৬-দফা এক্ষণে জনগণের সম্পত্তি এবং উহা পরিবর্তন বা সংশোধনের কোন অধিকার আমার নাই। তিনি বলেন যে, ৬-দফা ও ১১-দফার ভিত্তিতেই শাসনতন্ত্র রচিত হইবে এবং কেহই উহা রোধ করিতে পারিবে না।

আওয়ামী লীগ প্রধান ক্রমাগত চক্রান্তের কথা উল্লেখ করিয়া বলেন যে, জনগণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর রোধের জন্য চক্রান্ত অব্যাহত রহিয়াছে। তিনি বলেন যে, এই চক্রান্ত অব্যাহত থাকিলে যা ঘটিবে তার জন্য চক্রান্তকারীরাই দায়ী হইবে। শেখ মুজিব দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন, আমরা মরিব কিন্তু কখনও নতি স্বীকার করিব না। 

তিনি বলেন যে, যখনই তিনি বাঙ্গালীদের অধিকারের কথা বলেন তখন তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলা হয়। তিনি বলেন, আমি যখন বাংলা দেশের দুঃখী মানুষের কথা বলি তখন আমার কথায় পশ্চিম পাকিস্তানের দুঃখী মানুষের কথাই প্রতিধ্বনিত হয়।

আওয়ামী লীগ-প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান তাঁহার ভাষণে জাতীয় পরিষদের পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্যগণকে পরিষদের আসন্ন অধিবেশনে যোগদানের জন্য আহবান জানান। পশ্চিম পাকিস্তানের কোন কোন সদস্য বা নেতা শাসনতন্ত্র প্রণয়নে তাঁহাদের প্রস্তাব গ্রহণ করার আশ্বাস দান করিলে অধিবেশনে যোগদান করিবেন বলিয়া যে উক্তি করিয়াছেন তাহার জবাবে আওয়ামী লীগ-প্রধান বলেন, যদি কোন সদস্য ন্যায়সঙ্গত প্রস্তাব দেন তবে তাহা গ্রহণ করা হইবে। তিনি বলেন, শাসনতন্ত্র রচনার জন্য ১২০ দিন সময় রহিয়াছে। আসুন, আলোচনায় বসুন, একদিনে না হইলে দিনের পর দিন আলোচনা করা যাইবে। ৬-দফার বিষয় উল্লেখ করিয়া শেখ সাহেব বলেন, ৬-দফার প্রশ্নে বাংলার ৭ কোটি মানুষ রায় ঘোষণা করিয়াছেন। ৬-দফা এখন আওয়ামী লীগ বা শেখ মুজিবের একার সম্পত্তি নয়। ৬-দফা এখন জনগণের সম্পত্তি। অনুষ্ঠানে যোগদানকারী অতিথি এবং মে র চারপাশে দন্ডায়মান জনতার তুমুল করতালির মধ্যে শেখ সাহেব দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন যে, ৬-দফার কোন রদ-বদলের ক্ষমতা এখন আর আওয়ামী লীগের নাই। তিনি আরও বলেন যে, ৬-দফার মাধ্যমে এক পাকিস্তান থাকিবে এবং এই পাকিস্তানে বাংলা দেশও থাকিবে, পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান, সিন্ধু এবং সীমান্ত প্রদেশও থাকিবে। থাকিবে না শুধু এক অ ল কর্তৃক অপর অ লকে শোষণের অবাধ অধিকার।

পশ্চিম পাকিস্তানের কোন কোন নেতা কর্তৃক বিভিন্ন অজুহাতে পরিষদে যোগদানের অস্বীকৃতির উল্লেখ করিয়া তিনি বলেন, একটি বাতিক (মিষ্টিরিয়া) সৃষ্টি করিয়া পশ্চিম পাকিস্তানের সদস্যগণকে ঢাকায় আসিতে দেওয়া হইতেছে না। তিনি এই বাতিকের পরিণতির ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করিয়া বলেন, ৮৩ জন সদস্য লইয়া যদি আপনারা না আসেন এবং ফলে বাংলা দেশের সদস্যগণও যদি পশ্চিম পাকিস্তান যাইতে অস্বীকার করেন তখন কি অবস্থা হইবে? তিনি বলেন, আমাকে আর বিচ্ছিন্নতাবাদী বলিতে পারিবেন না।

পশ্চিম পাকিস্তানের কোন একজন নেতা কর্তৃক ঢাকা অধিবেশনকে ‘কসাইখানা’ বলিয়া অভিহিত করায় শেখ সাহেব ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, যে সমস্ত অপমানজনক উক্তি আমরা শুনিতেছি তাহা খুবই দুঃখজনক  এবং ভবিষ্যতের জন্য আতঙ্কজনক। গত ২৩ বৎসরে কোন বাঙ্গালী তো পরিষদকে ‘কসাইখানা’ বলে নাই। আমিও জাতীয় পরিষদের সদস্য ছিলাম। আমরাও টাকা-পয়সা খরচ করিয়া করাচী গিয়াছি, মাসের পর মাস থাকিয়াছি। কিন্তু আমরা তো কোনদিন পশ্চিম পাকিস্তানে যাইতে অস্বীকার করি নাই। কিংবা পশ্চিম পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত অধিবেশনকে ‘কসাইখানা’ বলি নাই। যাহারা ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের একনায়কত্ব’ মানিতে চাহেন না, তাহারাই ‘সংখ্যালঘিষ্ঠের একনায়কত্ব’ মানাইতে চাহিতেছেন বলিয়া উল্লেখ করিয়া তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক নীতি মানিবেন না কেন? তিনি আরও বলেন, আমরা বাংলা দেশের জন্য যাহা চাই, পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান এবং সীমান্তের জন্যও তাহাই চাই। কিন্তু আপনারা তাহা নিতে চাহেন না কেন? এতদিন আপনারা কেন্দ্রীয় সরকারের সবকিছু ভোগ দখল করিয়াছেন। কিন্তু আর শোষণ করা যাইবে না। তিনি বলেন, আমরা বাংলার দুঃখী মানুষের কথা বলার সময় পশ্চিম পাকিস্তানের দুঃখী মানুষের কথাও বলিয়া থাকি। তবু আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হইয়া থাকে যে, আমরা কেবল বাঙ্গালীর কথা বলি। তিনি বলেন, আমারা পাকিস্তানে সংখ্যায় বেশী। কাজেই বাঙ্গালীর কথা বলিলে পাকিস্তানের কথাই বলা হইয়া থাকে।

জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের ব্যাপারে পশ্চিম পাকিস্তানের কোন কোন দল বা নেতা যে তালবাহানা শুরু করিয়াছেন তাহার উল্লেখ করিয়া আওয়ামী লীগ-প্রধান বলেন, “আসব, আসব না”- এই ধরনের অনেক খেলা চলিতেছে। তিনি চক্রান্তের রাজনীতির পরিণতি সম্পর্কে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করিয়া বলেন, বাংলা দেশকে বাজার সৃষ্টি করার প্রয়াসের বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে যদি কিছু ঘটে তাহা হইলে ইহার জন্য শাসকগোষ্ঠীই দায়ী হইবে।

এইদিন আরও কিছু সংবাদ সার্বিক পরিস্থিতি বুঝতে আমাদের সাহায্য করবে। এর মধ্যে কয়েকটি তুলে ধরা হল:-

‘পশ্চিম পাকিস্তানে মহিলা আসনে নির্বাচন স্থগিত’
নির্বাচন অনুষ্ঠানের নির্ধারিত দিনে পশ্চিম পাকিস্তানের বিপুল সংখ্যক সদস্যের উপস্থিতি সম্পর্কে অনিশ্চয়তার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন গতরাত্রে জাতীয় পরিষদের পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য সংরক্ষিত মহিলাদের ৬টি আসনের নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করিয়াছেন। তবে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সংরক্ষিত মহিলা আসনগুলিতে নির্ধারিত তারিখেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে...

‘মুজিব-আহসান সাক্ষাৎকার’
আওয়ামী লীগ-প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান গতকাল (রবিবার) বিকালে গভর্ণর হাউজে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর ভাইস এ্যাডমিরাল এস. এম. আহসানের সঙ্গে একঘণ্টাব্যাপী এক অনির্ধারিত সাক্ষাৎকারে মিলিত হন।

‘বর্তমান সংকট বাংলার নির্বাচনী রায় নস্যাতের প্রয়াস-মওদুদীর তারবার্তার জবাবে শেখ মুজিব’
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান গতকাল (রবিবার) বর্তমান রাজনৈতিক সংকটকে ‘৬-দফার পক্ষে বাংলা দেশের নির্বাচনী রায়কে বানচাল করার সচেতন প্রয়াস’ এর প্রকাশ বলিয়া মন্তব্য করেন। জামাত প্রধান সৈয়দ আবুল আলা মওদুদীর এক তারবার্তার জবাবে প্রেরিত তারবার্তায় আওয়ামী লীগ প্রধান তাঁহাকে ধন্যবাদ জানাইয়া বলেন, এই সংকট উত্তরণের জন্য প্রত্যেক নেতাকে কথা-বার্তায় সতর্ক এবং জনগণের ইচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত। 

শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে, তিনি রাজনৈতিক দলগুলির কর্মসূচীর সমালোচনা ছাড়া কখনও কাহারও ব্যক্তিগত নিন্দায় লিপ্ত হন নাই এবং প্রত্যেক নাগরিকই যে কোন দলের কর্মসূচীর সমালোচনার অধিকারী। তারবার্তার উপসংহারে বলেন, আপনার দল আমার ও আমার দলের স্বদেশ প্রেমের প্রতি যে কটাক্ষ করিয়াছে, আর কোন নিন্দাবাদই তদপেক্ষা বড় হইতে পারে না।

‘গণতন্ত্র ও পাকিস্তানের স্বার্থবিরোধী’
নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য হাজী মওলা বক্স আজ করাচীতে এক বিবৃতিতে দুঃখ প্রকাশ করিয়া বলেন যে, কতিপয় রাজনৈতিক দল ও উহাদের নেতৃবৃন্দ আসন্ন জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগদান না করার আভাস দিয়াছেন। তিনি বলেন, এ ধরণের কাজ গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও পাকিস্তানের স্বার্থের পরিপন্থী হইবে।

‘পি.পি.পি. নেতার সর্বশেষ-’
পিপল্স পাটির চেয়ারম্যান জনাব জুলফিকার আলী ভূট্টো গতকাল (রবিবার) লাহোরের এক জনসভায় দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে দলীয় নীতি ও ভূমিকার সর্বশেষ ব্যাখ্যা দান প্রসঙ্গে ঘোষণা করেন যে-বর্তমান পরিস্থিতিতে তাঁহার দল জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করিবে না। তবে উদ্বোধনী অধিবেশন পিছাইয়া দিলে বা ১২০ দিনের মেয়াদ বাতিল করিলে তিনি পরিষদে যোগদান করিবেন। পিপল্স পার্টির সদস্যদের অংশগ্রহণ ভিন্ন অধিবেশন বসিলে খাইবার হইতে করাচী পর্যন্ত আন্দোলন শুরু করিবেন।

‘খসড়া শাসনতন্ত্র বিবেচনা অব্যাহত’
৬-দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্রের খসড়া বিবেচনার জন্য আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী পার্টি কর্তৃক গঠিত ৩০ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির অধিবেশন গতকাল (রবিবার) সকালে শুরু হয় এবং গভীর রাত্রি পর্যন্ত পূর্বাণী হোটেলে সভা অব্যাহত থাকে। 

লেখক : মোহাম্মদ ওমর ফারুক দেওয়ান, পরিচালক, প্রেস ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ।


প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও মর্যাদা : প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ

ঘুরে আসুন সাজেক, খেয়াল রাখবেন কিছু বিষয়ে

নারী ও শিশু নির্যাতন: সভ্য সমাজের বর্বর বার্তা


image
image

রিলেটেড নিউজ

Los Angeles

১৮:০৯, মে ১২, ২০২২

বজ্রপাত হচ্ছে-সাবধান হই


Los Angeles

১২:২৮, অক্টোবর ৭, ২০২১

“কয় জন ভালো নয়, সয় জন ভালো হয়”


Los Angeles

০০:৫৯, সেপ্টেম্বর ২১, ২০২১

বাংলাদেশের ফুটবলের কলংকিত দিন ১৯৮২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর !


Los Angeles

১১:৩৪, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২১

প্রকৃতিতে নয়, কেবল কাগজের নোটেই আছে ‘জাতীয় পাখি দোয়েল‘


Los Angeles

২২:১২, সেপ্টেম্বর ১, ২০২১

ফুটবলের মরা গাঙে কি আবার জোয়ার আসবে ?


Los Angeles

২৩:০৮, আগস্ট ১৫, ২০২১

শাসক নয় বঙ্গবন্ধু আপাদমস্তক সেবক ছিলেন


Los Angeles

১৮:৫৭, আগস্ট ১৩, ২০২১

আড্ডা যেন এক উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়


Los Angeles

০০:০৪, আগস্ট ৮, ২০২১

বাইরে মুক্তির কল্লোল ও বন্দী একটি পরিবার


image
image