image

আজ, বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ইং

এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম : বঙ্গবন্ধু

মোহাম্মদ ওমর ফারুক দেওয়ান    |    ২২:৫৭, মার্চ ৮, ২০২১

image

৭ই মার্চের ভাষণের বিষয়বস্তু নিয়েই ৮ই মার্চের পত্রিকাগুলোতে আলোড়ন ছিল। প্রধান লিড হিসেবে দৈনিক আজাদ, দৈনিক সংবাদ ও দৈনিক ইত্তেফাকের মধ্যে দৈনিক আজাদের শিরোনামটা চমৎকার লিখেছে। দৈনিক সংবাদের লিড ছিল ৮ কলাম তিন লাইনে। প্রত্যেকটি পত্রিকা মনে হলো বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি শব্দই লিখেছে। সংবাদপত্রগুলো যেন বাংলার অনুভ‚তির সাথে একাকার হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের বক্তৃতার ছবি নিয়ে কিছু কিছু সময় বিতর্ক দেখা যায়। তবে বঙ্গবন্ধুর ডান হাতের তর্জনী (আজাদ, ইত্তেফাক) ও বাম হাতের তর্জনী (সংবাদ) উদীয়মান, পেছনের কর্নার থেকে জনসভাসহ একটি ছবি (সংবাদ), জনতার লাঠিমিছিল (সংবাদ), জনতার ছবি (ইত্তেফাক) ছেপেছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পূর্ণ অংশ এই পরিসরে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে দৈনিক আজাদ প্রায় পূর্ণ অংশটুকুই সংবাদ হিসেবে ছেপেছে। তাই আজ দৈনিক আজাদের লিড নিউজই দেওয়া হলো-

এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম
বিদ্রোহী বাংলা মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান গতকাল সাতই মার্চ জাতির উদ্দেশে শত্রুর হামলা মোকাবেলা করার জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণের উদাত্ত আহবান জানান। বঙ্গ শার্দুল সিংহ গর্জনে ঘোষণা করেন ঃ এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। জেনারেল ইয়াহিয়া কত্তৃক আহূত পঁচিশে মার্চে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান সম্পর্কে বাংলার অবিসম্বাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, “শত শহীদের রক্তের উপর দিয়া পরিষদে যোগদান করা যায় না।”
তবে তিনি বলেন, “সামরিক আইন প্রত্যাহার, সেনা বাহিনী প্রত্যাহার, গণ-হত্যার তদন্ত ও জনগণের প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করা হইলে পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের প্রশ্ন বিবেচনা করা যাইতে পারে, তাহার পূর্বে নয়।”
রমনা রেসকোর্সের উত্তাল জনসমুদ্রকে লক্ষ্য করিয়া ‘বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনের ‘সর্বাধিনায়ক’ শেখ মুজিবর রহমান আরও বলেন, ‘আর যদি একটিও গুলী বর্ষিত হয়, হে আমার সংগ্রামী দেশবাসী-ঘরে যাহা কিছু আছে তাহা দিয়াই শত্রæকে রুখিয়া দাঁড়াও। রাস্তা-ঘাটে গড়িয়া তোল দুর্ভেদ্য ব্যারিকেড। আর বাংলার প্রতি ঘরকে দূর্গে পরিণত কর।”
শেখ মুজিবর রহমান বলেন ঃ আমরা সংখ্যাগুরু, কিন্তু যখনই ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করিয়াছি তখনই আমাদের উপর বর্ষিত হইয়াছে গুলী। ভাইয়ের বুকে ভাইয়ের এই গুলী কেন ? বাংলার সাত কোটি মানুষের ট্যাক্সে অস্ত্র কেনা হয়, সে তো বাংলা দেশে নির্বিচারে গুলী চালানোর জন্য নয়। 
কুড়ি মিনিটকাল স্থায়ী ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন ঃ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন লইয়া আমি আপনাদের সম্মুখে হাজির হইয়াছি। আপনাদের আমি কি বলিব। আপনারা সবই জানেন, সবই বুঝেন। আমরা জীবন দিয়া চেষ্টা করিয়াছি দেশে গণতন্ত্র কায়েম হউক। কিন্তু দুঃখের বিষয় ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, খুলনা প্রভৃতি স্থান আমার ভাইয়ের রক্তে লাল হইয়া গিয়াছে।” শেখ মুজিব বলেন, “এই অবস্থা হইতে বাংলার মানুষ মুক্তি চায়; তাঁহারা বাঁচিতে চায়; আর চায় অধিকার।”
তিনি বলেন, “কি অন্যায় আমরা করিয়াছিলাম ? বাংলার সাত কোটি মানুষ নির্বাচনে আমাদের ভোট দিয়াছে। এখন আমরা দেশের জন্য শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করিব এবং এই দেশকে নূতন করিয়া গড়িয়া তুলিব। আশা ছিল এই পদ্ধতিতেই মানুষ পাইবে মুক্তির আস্বাদ।”
বঙ্গবন্ধু বলেন, “কিন্তু দুঃখের সহিত বলিতে হয়, বিগত ২৩ বৎসরের ইতিহাসÑবাংলার বঞ্চনার ইতিহাস, রক্ত-ঝরানোর ইতিহাস, মা-বোন ও ভাইয়ের আর্তনাদের ইতিহাস।”
তিনি বলেন, “৫৪ সালেও আমরা নির্বাচনে জয়যুক্ত হইয়াছিলাম, কিন্তু ক্ষমতায় যাইতে পারি নাই। আটান্ন সালে আইয়ুব খাঁর মার্শাল ল’ জারী হইল। দশ বৎসর আমাদের গোলাম করিয়া রাখা হইয়াছে। ১৯৬৮ সালে আমাদের ভাগ্যে জুটিল গুলী। ১৯৬৯ সালে আইয়ুবের পতনের পর জেনারেল ইয়াহিয়া ক্ষমতা গ্রহণ করিয়া প্রতিশ্রæতি দিয়াছিলেনÑনির্বাচন ও গণতন্ত্র দিবেন। আমরা এই প্রতিশ্রæতি মানিয়া নিলাম।”
প্রিয় নেতা বলেন, “ইহার পরের ঘটনা আপনারা সবাই জানেন। প্রেসিডেন্টের সহিত দেখা করিয়া আমি ১৫ই ফেব্রæয়ারী পরিষদের অধিবেশন আহবানের প্রস্তাব দিলাম। সংখ্যালঘিষ্ঠ দলের নেতা জনাব ভুট্টো মার্চের প্রথম সপ্তাহের কথা বলিলেন। তাহার কথাই রাখা হইল। তবু আমি তাহা মানিয়া লইলাম। জনাব ভুট্টো পূর্বশর্ত্ত আরোপ করিলেন। জবাবে আমি এমন কি একথাও ঘোষণা করিলাম যে, কেহ ন্যায্য কথা বলিলে তাহা তিনি যদি দলের এক মাত্র সদস্য হন তবুও তাহা বিবেচনা করা হইবে। জনাব ভুট্টো বলিয়াছেন-আলোচনার দরজা বন্ধ হয় নাই। আমি ও মওলানা নুরানী, মওলানা মুফতী মাহমুদ ও অন্যান্য পশ্চিম পাকিস্তানী নেতার সঙ্গে আলোচনা করিলাম। তাঁহাদের বুঝাইলাম-জনতা ৬-দফা ও ১১-দফার উপর আমাকে ভোট দিয়াছে। ইহা পরিবর্ত্তন করার ক্ষমতা আমার নাই।”
শেখ মুজিব বলেন, “এই পরিপ্রেক্ষিতে জনাব ভুট্টো পরিষদে যোগদানের ব্যাপারে বিরূপ মন্তব্য শুরু করিলেন। তিনি বলিলেন ঃ এই জাতীয় পরিষদ কসাইখানা। আমি ‘ডাবল হোষ্টেজ’ হইতে চাই না। অতঃপর শুরু হইল জনাব ভুট্টোর হুমকি। বাংলা দেশে আসিলে মুন্ডু কাটা যাইবে, পেশোয়ার হইতে করাচী পর্যন্ত বন্ধ হইয়া যাইবে ইত্যাদি।
“ইহার পর হঠাৎ পহেলা মার্চ পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করা হইল। ৩৫ জন পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্য এখানে আসিলেনও। কিন্তু তাহাদের ফিরিয়া যাইতে হইল।” শেখ মুজিবর রহমান বলেন, “দোষ দেওয়া হইল বাংলা দেশের উপর।” “বাংলা দেশে ইহার প্রতিবাদ হইল। আমি শান্তিপূর্ণ হরতালের ডাক দিলাম। জনতা এই ডাকে সাড়া দিল।” বঙ্গবন্ধু বলেন, “আর ইহার বিনিময়ে কি পাইলাম ? আমার ট্যাক্সের পয়সায় শত্রæর বিরুদ্ধে লড়াই-এর জন্য যে অস্ত্র কেনা হইয়াছে, সেই অস্ত্রই ব্যবহৃত হইল বাংলার গরীব মানুষের বিরুদ্ধে।” তিনি বলেন, “আমরা সংখ্যা গুরু। কিন্তু যখনই আমরা ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করিয়াছি, আমাদের মালিক আমরা হওয়ার চেষ্টা করিয়াছি-তখনই পাইয়াছি গুলী। আমরা ভাই ভাই। ভাইয়ের বিরুদ্ধে ভাইয়ের এই গুলী কেন ? গুলী তো বহিঃশত্রæ মোকাবেলার জন্য।” সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বলেন, “প্রেসিডেন্ট তাহার বেতার ভাষণে বলিয়াছেন-আমি নাকি প্রতিশ্রæতি দিয়াছিলাম পার্লামেন্টারী নেতৃ-সম্মেলনের বিরোধিতা করিব না।”
প্রেসিডেন্টের সহিত আমার টেলিফোনে কথা হইয়াছে ঠিকই। আমি টেলিফোনে বলিয়াছিলাম ঃ আপনি ঢাকয় আসুন, দেখিয়া যান এখানে কিভাবে মানুষ হত্যা করা হইতেছে।” বঙ্গ শার্দুল জিজ্ঞাসা করেন, “কিসের গোল-টেবিল বৈঠক? কাহার সহিত? যাহারা বুকের রক্ত দিয়াছে, তাঁহাদের রক্ত এখনও মুছিয়া যায় নাই !” শেখ মুজিব বলেন, “অতঃপর আমি পল্টনে গেলাম। আপনাদের আহŸান জানাইলাম সব বন্ধ করুন। সবাই আমার কথা মানিয়া লইল। দরিদ্র মানুষের অসুবিধার জন্য হরতাল কিছু কিছু শিথিলও করিলাম। এইভাবে শান্তিপূর্ণ সংগ্রাম চলিতে থাকিল।”
বঙ্গবন্ধু বলেন, “এই পরিপ্রেক্ষিতে সংখ্যাগুরু দলের নেতা হিসাবে আমার সহিত কোন পরামর্শ না করিয়া জনাব ভুট্টোর সহিত পাঁচ ঘন্টা গোপন বৈঠকের পর প্রেসিডেন্ট এক বক্তৃতা দিলেন এবং ২৫শে মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহŸান করিলেন। সব চাইতে দুঃখের বিষয় যাহাদের জন্য এই পরিস্তিতির উদ্ভব হইল, তাহাদের সম্পর্কে কোন কথা না বলিয়া প্রেসিডেন্ট বাংলা দেশের জনগণ ও আওয়ামী লীগের উপর অন্যায় দোষারোপ করিলেন।” বাংলার নেতা বলেন, “বাংলার সাত কোটি মানুষ এই অন্যায় দোষারোপ হইতে মুক্তি চায়। তাই শুরু হয় নূতন সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম-মুক্তির সংগ্রাম।’
শেখ মুজিব বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট অধিবেশন আহŸান করিয়াছেন। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত সামরিক আই প্রত্যাহার করা না হয়, সেনা বাহিনী ছাউনীতে ফিরিয়া না যায়, গণহত্যার তদন্ত শুরু না করা হয় ও জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করা না হয়-তাহার পূর্বে পরিষদের যোগদানের প্রস্তাব বিবেচনা করা সম্ভব নয়। জনগণ আমাকে সেই অধিকার দেয় নাই।” বাংলার সংগ্রামী জনতার সিপাহ সালার শেখ মুজিবর রহমান ঘোষণা করেন, “আমি প্রধান মন্ত্রীত্ব চাই না-অধিকার চাই।”
তিনি বলেন, “আমি পরিষ্কার করিয়া বলিয়া দিতে চাই- আজ হইতে বাংলা দেশের কোর্ট-কাচারী, অফিস আদালত, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকিবে। গরীবের যাহাতে কষ্ট না হয়, সেই জন্য রিক্সা, বেবী ট্যাক্সী, বাস প্রভৃতি যানবাহন চালু থাকিবে। ট্রেন চালু থাকিবে, তবে সেই ট্রেনে জনতাকে হত্যা করার জন্য যদি সেনাবাহিনী পরিবহণের চেষ্টা করা হয় এবং তাহাতে যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটে তাহার জন্য আমরা দায়ী থাকিব না।”
সরকারী, আধা-সরকারী কর্মচারীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “এখন হইতে আমার নির্দেশ পালন করিতে হইবে। আপনারা কেহই অফিসে যাইবেন না। মাসের শেষে একদিন বেতন আনিতে যাইবেন। যদি বেতন দেওয়া না হয়Ñরুখিয়া দাড়াইবেন।” শেখ মুজিব বলেন, “তারপর যদি গুলী চলে- হে আমার বাংলার স্বাধীনচেতা জনগণ, উদ্ধত ফণা তুলিয়া তাহার প্রতিরোধ কর। ঘরে যাহা কিছু আছে, তাহা দিয়াই শত্রæর মোকাবেলা শুরু কর। রাস্তা ঘাট বন্ধ করে দাও। প্রয়োজন হইলে শত্রæদের ভাতে মারিব, পানিতে মারিব।”
সৈনিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “ তোমরা ভাই ব্যারাকে থাকিও। গুলী চালাইতে চেষ্টা করিও না। সাত কোটি বাঙ্গালীকে অস্ত্র দ্বারা দাবাইতে পারিবে না। আমরা মরিতে শিখিয়াছি, কেহই আমাদের জয়যাত্রা ঠেকাইতে পারিবে না।” মিল মালিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “পহেলা হইতে সাতই মার্চ পর্যন্ত এই সাত দিনের বেতন শ্রমিদের ঘরে পৌঁছাইয়া দিবেন।” শেখ মুজিব ঘোষণা করেন, “আজ হইতে খাজনা ট্যাক্স বন্ধ। যতদিন বাংলার মুক্তি না আসে ততদিন এক পয়সাও কাহাকেও দিব না।”
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার উদাত্ত আহŸান জানাইয়া বঙ্গবন্ধু বলেন ঃ আজ আর হিন্দু-মুসলমান, বাঙ্গালী-অবাঙ্গালী নাই; বাংলার মাটিকে যাহারা গ্রহণ করিয়াছে, তাহারাই আমাদের ভাই। গণ-আন্দোলনের সুযোগে যাহারা সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ায়, লুট বা অগ্নিসংযোগে অংশগ্রহণ করে- বুঝিয়া লইতে হইবে তাহারা শত্রæ পক্ষের চর।”
জলদগম্ভীর কন্ঠে সংগ্রাম বাংলার সর্বাধিনায়ক বলেন, “আমি বা আমার সহকর্মীরা আর যদি কোন নির্দেশ দেওয়ার সুযোগ না পাই তবুও আপনার আপনাদের দায়িত্বের কথা মনে রাখিবেন। বুকের রক্ত দিয়া ফাঁসীর মঞ্চ হইতে আমাকে এই রেসকোর্সে ফিরাইয়া আনিয়াছেন, নিজের রক্ত দিয়া সেই রক্ত ঋণ শোধ করিব। “রেডিও-টেলিভিশন ও সবাদপত্রের কর্মচারীদের প্রতি আমার আবেদন, এই গণ-আন্দোলনের খবর যদি যথাযথভাবে প্রচার না করিতে পারেন, তাহা হইলে অসহযোগিতা শুরু করুন।’ তিনি বলেন, ‘ব্যাঙ্ক দুই ঘন্টার জন্য খোলা থাকিবে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে একটি পয়সাও পাচার করিতে দেওয়া চলিবে না। টেলিফোন ও টেলিগ্রামও চলিবে না। তবে অন্য কিছু হইলে বিপদ হইবে।”
“বাংলার মরণবিজয়ী জনতার প্রতি আমার আবেদন, প্রত্যেক গ্রামে, মহল্লায়, ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গঠন কর। ঘরে যাহা কিছু আছে তাহা দিয়াই শত্রæর মোকাবেলা করার প্রস্তুতি গ্রহণ কর। রক্ত দিয়াছি আরও দেব। মনে রাখিবে-এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম-আরও মনে রাখিবে শৃঙ্খলা ছাড়া কোন জাতি জয়লাভ করিতে পারে না।” 
উপসংহারে বাংলার মহানায়ক ঘোষণা করেন, “ হে আমার বাংলার ভাই-বোনেরা ঘরে ঘরে প্রস্তুত হও। অমি রক্ত দিবার জন্য প্রস্তুত।”

পরিষদের যাওয়ার প্রশ্ন বিবেচনা করিতে পারি যদি-
(ক) অবিলম্বে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করা হয়, (খ) সমস্ত সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরাইয়া নেওয়া হয়, (গ) নিরস্ত্র গণহত্যার তদন্ত করা হয় এবং (ঘ) নির্বাচিত গণ-প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়।বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে সমবেত লক্ষ লক্ষ মুক্তি-সেনানীর বজ্রনির্ঘোষ সংগ্রামী ধ্বনির তুর্যনাদের মধ্যে জলদগম্ভীর স্বরে উপরোক্ত ঘোষণা করেন। প্রেসিডেন্টের উদ্দেশে শেখ সাহেব বলেনÑ‘আপনি ২৫শে মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকিয়াছেন। আগে আমার এইসব দাবী মানিতে হইবেÑতারপর বিবেচনা করিব, অধিবেশনে যোগ দিব কিনা।’ এই দাবী পূরণ ছাড়া পরিষদে যাওয়ার অধিকার বাংলার জনগণ আমাকে দেয় নাই।.....(ইত্তেফাক)।

আজ থেকে আমার নির্দেশ
(১)    বাংলার মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ রাখুন। (২) সমগ্র বাংলা দেশের সেক্রেটারীয়েট- সরকারী ও আধা সরকারী অফিস, সুপ্রীম কোর্ট, হাইকোর্ট এবং অন্যান্য কোর্টে হরতাল করুন। (কোথাও শিথিল করা হইলে জানান হইবে)। (৩) রিকশা, বেবী, বাস-ট্যাক্সী  প্রভৃতি এবং রেলগাড়ী ও বন্দরসমূহ চালু রাখুন; কিন্তু জনগণের উপর জুলুম চালাইবার উদ্দেশে সশস্ত্র বাহিনীর চলাচলের কাজে রেলওয়ে ও বন্দর কর্মচারিগণ সহযোগিতা করিবেন না এবং সেক্ষেত্রে তাহাদের চলাচলের ব্যাপারে কোন কিছু ঘটিলে আমি দায়ী হইব না। (৪) বেতার, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রসেবীরা আমাদের বিবৃতি বক্তৃতার পূর্ণ বিবরণ প্রদান করিবেন এবং গণ-আন্দোলনের কোন খবর গায়েব  করিবেন না। যদি তাহাতে বাধা দেওয়া হয়, তাহা হইলে এইসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বাঙ্গালীরা কাজে যোগ দিবেন না। (৫) শুধু লোকাল এবং আন্তঃজেলা ট্রাঙ্ক-টেলিফোন যোগাযোগ অব্যাহত রাখুন। (৬) স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখুন। (৭) সকল গৃৃহশীর্ষে প্রতিদিন কালো পতাকা উড্ডীন রাখুন। (৮) ব্যাঙ্কসমূহ প্রতিদিন দুই ঘণ্টা খোলা রাখুন; কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও যেন পাচার না হয়। (৯) অন্যান্য ক্ষেত্রে আজ হইতে হরতাল প্রত্যাহৃত হইল। কিন্তু অবস্থার প্রেক্ষিতে যেকোন সময় আবার আংশিক বা সর্বাত্মক হরতাল ঘোষণা করা হইতে পারে, তজ্জন্য প্রস্তুত থাকুন। (১০) স্থানীয় আওয়ামী লীগ শাখার নেতৃত্বে অবিলম্বে বাংলার প্রত্যেকটি ইউনিয়ন, মহল্লা, থানা, মহকুমা ও জেলা পর্যায়ে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করুন।......। (ইত্তেফাক)।

ঢাকা বেতার বন্ধ
ঢাকা বেতারে আওয়ামী লীগ- প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা রীলে না করার প্রতিবাদে এবং বাংলার সংগ্রামী জনতার প্রচন্ড দাবীর মুখে ঢাকা বেতারের কর্মরত সকল বাঙ্গালী কর্মচারীর সহযোগিতা না করার দরুন গতকাল (রবিবার) বিকাল হইতে ঢাকা বেতার কেন্দ্র বন্ধ হইয়া গিয়াছে। ঢাকা বেতার কেন্দ্র বন্ধ হওয়ার তিন ঘণ্টা পর অর্থাৎ সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় বেতার ভবনের আঙ্গিনায় একটি হাত বোমা নিক্ষিপ্ত হয়। 
একটি চলমান জীপ হইতে উক্ত হাত বোমা নিক্ষিপ্ত হয়। বোমা বিস্ফোরণের ফলে কোন জানমালের ক্ষতি হয় নাই বলিয়া সংশ্লিষ্ট মহল হইতে জানা গিয়াছে। 
আওয়ামী লীগ-প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের রেসকোর্স ময়দানের ভাষণ রীলে করার জন্য গত কয়েকদিন যাবৎ বিভিন্ন মহল হইতে জোর দাবী উঠে এবং শেষ পর্যন্ত ঢাকা বেতার কর্তৃপক্ষ তাঁহার এই গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ রীলে করার সিদ্ধান্ত বেতার মারফত ঘোষণা করিলেও শেষ মুহূর্তে উহা করা হয় নাই।.....(ইত্তেফাক)।

একটি দুর্ভাগ্যজনক ভাষণ
(সম্পাদকীয়)প্রেসিডেন্ট আগামী ২৫শে মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আরম্ভের কথা ঘোষণা করিয়াছেন। কিন্তু ইহা ঘোষণা করিতে গিয়া তিনি তাঁহার গত পরশুর বেতার ভাষণে এমন কতকগুলি উক্তি করিয়াছেন, যাহাকে আমরা দুর্ভাগ্যজক না-বলিয়া পারি না। সাড়ে বার মিনিটের বেতারবক্তৃতায় প্রায় আগা-গোড়াই বাঙলার নেতৃত্ব এবং স্বাধিকার-সংগ্রামী জনতার প্রতি বিরূপ মন্তব্য করা হইয়াছে, তাহা দুঃখজনক। ইহা তাঁহার চিরাচরিত সুর নয়, এক ভিন্ন সুর।
আমরা ব্যথিত হইয়াছি। আমরা মর্মাহত হইয়াছি। কারণ বাংলার মানুষেরা যাঁহার আন্তরিকতায় এত বিশ্বাস করিয়া প্রতিটি ক্ষেত্রে পূর্ণতম সহযোগিতা প্রদান করিয়া আসিয়াছে, মার্চের পয়লা তারিখ হইতে তাঁহার সুরের আকস্মিক পরিবর্তন এবং সর্বশেষ ৬ই মার্চের ভাষণে উহারই তিক্ততার বহিঃপ্রকাশ তারা কস্মিনকালেও প্রত্যাশা করে নাই।....(ইত্তেফাক)।

দৈনিক আজাদে নিচের শিরোনামগুলোও ছিল-
প্রদেশের নয়া গভর্নর, জেনারেল টিক্কা খানের ঢাকা উপস্থিতি
ক্ষমতা হস্তান্তর না করা পর্যন্ত অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলন চলিবে
লাহোরের জনসমাবেশে নূর খান, পূর্ব পাকিস্তানের সাথে একাত্মতা
অধ্যাপক মোজাফফর বলেন, শেখ মুজিবের দাবী নূন্যতম ও সঙ্গত হইয়াছে
ওয়ালী ন্যাপের সভায় স্বাধিকারের সংগ্রাম অব্যাহত রাখার ডাক
দৈনিক সংবাদের আরেকটি শিরোনাম ছিল-সাংবাদিক সম্মেলনে আসগর খান, শেখ মুজিবের গৃহীত সকল ব্যবস্থাই যুক্তিসঙ্গত হইয়াছে।

লেখক : মোহাম্মদ ওমর ফারুক দেওয়ান, পরিচালক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)।


ঢাকার রাজপথে স্বাধিকারকামী জনতার দৃপ্ত পদচারণা কন্ঠে কন্ঠে ক্ষুব্ধ গর্জন, প্রাণে প্রাণে সংগ্রামী শপথ

ঢাকার উত্তপ্ত রাজপথ, নানা জল্পনা-কল্পনা ও রাজনৈতিক ধোঁয়াশায় কাটে ৬ই মার্চ

দেশে যদি বিপ্লবের প্রয়োজন দেখা দেয়, তবে সে বিপ্লবের ডাক আমিই দিব, আমিও কম বিপ্লবী নই: বঙ্গবন্ধু

দানবের সঙ্গে সংগ্রামের জন্য যেকোন পরিণতিকে মাথা পাতিয়া বরণের জন্য আমরা প্রস্তুত : বঙ্গবন্ধু

৩ হইতে ৬ মার্চ প্রতিদিন সকাল ৬টা হইতে দুপুর ২টা পর্যন্ত সমগ্র প্রদেশে হরতাল পালন করুন : বঙ্গবন্ধু

২ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সাংবাদিক সম্মেলন

আসুন, পরিষদেই সমাধান খোঁজা হইবে : বঙ্গবন্ধু

প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও মর্যাদা : প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ

ঘুরে আসুন সাজেক, খেয়াল রাখবেন কিছু বিষয়ে

নারী ও শিশু নির্যাতন: সভ্য সমাজের বর্বর বার্তা


image
image

রিলেটেড নিউজ

Los Angeles

১৮:০৯, মে ১২, ২০২২

বজ্রপাত হচ্ছে-সাবধান হই


Los Angeles

১২:২৮, অক্টোবর ৭, ২০২১

“কয় জন ভালো নয়, সয় জন ভালো হয়”


Los Angeles

০০:৫৯, সেপ্টেম্বর ২১, ২০২১

বাংলাদেশের ফুটবলের কলংকিত দিন ১৯৮২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর !


Los Angeles

১১:৩৪, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২১

প্রকৃতিতে নয়, কেবল কাগজের নোটেই আছে ‘জাতীয় পাখি দোয়েল‘


Los Angeles

২২:১২, সেপ্টেম্বর ১, ২০২১

ফুটবলের মরা গাঙে কি আবার জোয়ার আসবে ?


Los Angeles

২৩:০৮, আগস্ট ১৫, ২০২১

শাসক নয় বঙ্গবন্ধু আপাদমস্তক সেবক ছিলেন


Los Angeles

১৮:৫৭, আগস্ট ১৩, ২০২১

আড্ডা যেন এক উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়


Los Angeles

০০:০৪, আগস্ট ৮, ২০২১

বাইরে মুক্তির কল্লোল ও বন্দী একটি পরিবার


image
image