শিরোনাম
মোহাম্মদ ওমর ফারুক দেওয়ান | ২৩:১০, মার্চ ১১, ২০২১
মার্চের ১১ তারিখের সংবাদপত্রে দেখা যায় একমাত্র জামাত ও পিপিপি ছাড়া সকল রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী শ্রেণি বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঘোষণাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তারা কালক্ষেপণ না করে দেশের স্থিতিশীলতার জন্য অবিলম্বে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান এর সাথে বৈঠকের জন্য প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ করেন। তবে বঙ্গবন্ধুর ডাকে যে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয় তার নাম ভাঙ্গিয়ে কিছু দুর্বিত্ত চাঁদাবাজী, লুটতরাজ শুরু করে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সেই দুর্বিত্তপনা প্রতিরোধে নির্দেশনাসম্বলিত বিধিবিধান জারি করে। ৯ই মার্চে জাতিসংঘের সেক্রেটারি বাংলাদেশ থেকে তার প্রতিনিধি ও পরিবারবর্গকে সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে যে নির্দেশ দান করেন বঙ্গবন্ধু তার প্রতিবাদ জানান। এদিন স্বাধিকার ও দায়িত্ব নিয়ে এক অর্থবহ বিশ্লেষণধর্মী সম্পাদকীয়ও প্রকাশ করা হয় দৈনিক ইত্তেফাকে। ওইদিন তিনি নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার আহবান জানান।
জাতিসঙ্ঘ সেক্রেটারী জেনারেলের দায়িত্বের ওখানেই শেষ নয়
বাংলার সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে শেখ মুজিব
জনগণের স্বাধীনতা-সংগ্রামের মহানায়ক আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবর রহমান গতকাল (বুধবার) এক বিবৃতিতে বলেন : বাংলা দেশে জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছাই আজ শেষ কথা। বাংলা দেশের জনগণের নামে আমরা যে নির্দেশ দিয়াছি সেক্রেটারিয়েটসহ সরকারী ও আধা-সরকারী অফিস-আদালত, রেলওয়ে ও বন্দরসমূহে তাহা প্রতিপালিত হইতেছে। যাঁহারা মনে করিয়াছিলেন যে, শক্তির দাপটে আমাদের উপর তাঁহাদের মত চাপাইয়া দিবেন, বিশ্বের দরবারে তাঁহাদের চেহারা আজ নগ্ন হইয়া ধরা পড়িয়াছে। বিশ্ব জনমতের কাছে কিংবা পশ্চিম পাকিস্তানের সব-চিন্তাশীল মানুষের কাছে তাঁহারা বাংলার নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষের উপর শক্তির নগ্ন প্রয়োগের যুক্তিকতা প্রমাণে ব্যর্থ হইয়াছেন।
এতদসত্ত্বেও, বিবেকবর্জিত সেই গণবিরোধী শক্তি তাঁহাদের বেপরোয়া পথই সমানে অনুসরণ করিয়া চলিয়াছেন। তাঁহাদের ‘সমর সজ্জা’ সমানে অব্যাহত। পশ্চিম পাকিস্তান হইতে প্রতিদিন সামরিক বাহিনীর লোকজন, অস্ত্রশস্ত্র আনয়ন করা হইতেছে। রাজশাহী ও রংপুরে সান্ধ্য আইন জারি করা হইয়াছে। বিনাশী শক্তির এই সমাবেশ ঘটাইয়াও মনোবাঞ্ছা তাহাদের পূরণ হয় নাই। তাই, ক্ষমতাসীন চক্র এখন বাংলা দেশের অর্থনীতির উপর মারণাঘাত হানিবার চক্রান্তে মাতিয়াছেন। ২৩ বৎসরের ঔপনিবেশিক শোষণের ফলে বিপর্যস্ত অর্থনীতির দেশে জনগণের অর্থনৈতিক দুর্দশার আরও অবনতি ঘটাইবার জন্য প্রতিহিংসা পরায়ণ মনোবৃত্তি লইয়া আজ তাঁহারা এই চক্রান্ত লিপ্ত হইয়াছেন।
‘সর্বত্র এক ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি করিয়া বিদেশী বিশেষজ্ঞগণকেও তাঁহারা ভীত-সন্ত্রস্ত করিয়া বাংলা দেশ ত্যাগে বাধ্য করিতেছেন। ‘সামরিক সজ্জা’ অব্যাহত রাখিয়া বাংলা বুকে তাঁহারা এক জরুরী অবস্থা কায়েম রাখার প্রয়াসী। ফলতঃ বাংলার বুকে উন্নয়নমূলক যাবতীয় কাজ-কর্ম আজ বন্ধ। এমনকি, বাত্যাদুর্গত এলাকার রিলিফ ও পুনর্বাসনের কাজ-কর্মও স্থগিত হইতে বসিয়াছে। বাত্যাদুর্গতদের জন্য দেশ-বিদেশ হইতে উদার হস্তের যে প্রচুর সাহায্য আসিয়াছে, বারংবার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও আজতক তাহার হিসাব প্রকাশ করা হয় নাই।
‘জাতিসংঘ সেক্রেটারী জেনারেল উ থানত বাংলা দেশ হইতে জাতিসংঘ কর্মচারীদের অপসারণের অনুমতি দিয়াছেন। সামরিক বাহিনীর লোকেরা বাংলা দেশে বসবাসরত বিদেশীদের জীবন ও ধন-সম্পত্তিও কতখানি বিপন্ন করিয়া তুলিয়াছেন এতদ্বারা সেক্রেটারী জেনারেলের এই কার্যক্রমে তাহারই স্বীকৃতি বিবৃত। সেক্রেটারী জেনারেলের বুঝা উচিত যে, কেবল জাতিসংঘ কর্মচারীদের অপসারণ করিলেই এ ব্যাপারে তাঁহার দায়িত্ব শেষ হইয়া যায় না। কেননা, যে হুমকি আজ উদ্যত হইয়াছে, সে হুমকি গণহত্যার হুমকি। সে হুমকি বাংলা দেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের জন্য জাতিসংঘ সনদের সংরক্ষিত মৌলিক মানবাধিকার অস্বীকৃতিরই নামান্তর।
‘মুক্তির লক্ষ্যে পৌঁছিয়া স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসাবে বসবাসের অধিকার অর্জনের জন্য বাংলা দেশের আপামর মানুষ সর্বস্বপণ করিয়া শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সংগ্রাম চালাইয়া যাইতে সঙ্কল্পবদ্ধ। তাঁহাদের এই উচ্চ মনোবল বিশ্বের স্বাধীনতা প্রিয় মানুষ মাত্রেরই প্রেরণার উৎস। বাংলা দেশের মানুষ জানে, ইতিহাসের রায় তাহাদেরই অনুকূলে। ধ্বংসকরী যত অস্ত্রেই সজ্জিত থাকুন না কেন, কোন শক্তিই আর তাহাদিগকে চূড়ান্ত বিজয় হইতে বি ত করিতে পারিবে না।
বেতারে ভাসানীর বক্তৃতা প্রচার না করার নিন্দা
পিকিং ন্যাপ সম্পাদক জনাব মসিহুর রহমান রেডিও পাকিস্তান কতৃক মওলানা ভাসানীর পল্টনের জনসভার কোন খবর প্রচার না করার নিন্দা করিয়াছেন।
স্বাধিকার সংগ্রাম ও দায়িত্ব
(সম্পাদকীয়) : জনগণের স্বাধিকার আন্দোলন এমন এক পর্যায় পৌঁছিয়াছে, যেখানে হইতে আর প্রত্যাবর্তন নাই। তাহারা আগাইয়া চলিবেই এবং গণ-আজাদী ও অধিকার ছিনাইয়া আনিবেই। সঙ্কল্প-বদ্ধ এই সংগ্রামী জনতাকে স্তব্ধ করিয়া দিবার ক্ষমতা পৃথিবীতে কাহারও নাই, যদি না, খোদা-না-খাস্তা, কোন প্রাপ্ত পদক্ষেপ দ্বারা আমরা নিজেরাই নিজেদের সর্বনাশ করিয়া বসি। ইতিহাসে অবশ্য দৃষ্টান্তের অভাব নাই যে, এজেন্ট-প্রভোকেটররূপী ঘরশত্রæ বিভীষণেরা অথবা অরাজকতা-উচ্ছৃঙ্খলতাবাদীরা সংগ্রামী জনতার মধ্যে অনুপ্রবেশ করিয়া কোটি কোটি মানুষের অপ্রতিরোধ্য আন্দোলনকে বিপথগামী করিয়াছে এবং তাহাদের সুনিশ্চিত জয়কে ব্যর্থতামÐিত করিয়াছে। অনেক সময় এরূপও দেখা গিয়াছে যে, বাস্তব অবস্থার সহিত সামঞ্জস্যবিহীন অসংযত পদচারণাও অভাবিত সর্বনাশ এবং অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করিয়াছে।
আমরা সাধারণ মানুষ যেভাবে দেখি বা চিন্তা করি, সংগ্রামের অধিনায়কের দৃষ্টি বা চিন্তা উহা হইতে কিছু ভিন্ন হওয়াও বিচিত্র নয়। আমরা ভাবাবেগ দ্বারা চালিত হইতে পারি। কিন্তু অধিনায়কের ভাবাবেগের ¯্রােতে ভাসিয়া গেলে চলে না। যিনি সর্বাধিনায়ক তিনি দূর পর্যন্ত দৃষ্টিপাত করিয়া বা বহুকিছুর বিচার-বিশ্লেষণ করিয়া প্রযোজনবোধে হয়ত ‘এক পা আগাইয়া দুইপা পিছাইবার’ (লেনিনের বিখ্যাত উক্তি ‘ওয়ান ষ্টেপ ফরওয়ার্ড, টু ষ্টেপস ব্যাকওয়ার্ড’ স্মার্তব্য) নির্দেশ দিতে বাধ্য হন। কিন্তু কখনও কখনও এরূপ দেখা যায় যে, আন্দোলন বানচাল করার জন্য নিয়োজিত উস্কানিদাতারা অধিনায়কের সেই নির্দেশকে দুর্বল, দক্ষিণপন্থী, শোধনবাদী, আপোষকামী, প্রতিক্রিয়াশীল প্রভৃতি আখ্যা প্রদান করতঃ আন্দোলনটিকেই বিপর্যস্ত করিতে তৎপর হইয়া উঠে। সেইসঙ্গে দুষ্কৃতিকারী সমাজশত্রæ ও স্বভাবদুর্বৃত্তরাও যদি আসরে নামে, তবে ত আর কথাই নাই। একটা আসন্ন ও অবশ্যম্ভাবী বিজয়কে ভন্ডুল করিয়া দিয়া তাহারা মুক্তি পাগল মানুষকে কঠিনতর সঙ্কট ও দুঃখ-দুর্ভোগেরই শিকার করিয়া তোলে। তাই যুদ্ধ জয়ের জন্য বিরাট আমি বা বিপুল জঙ্গী জনতার যেমন দরকার, তেমনি দরকার সিপাহশালারের নির্দেশ ও নেতৃত্ব বিনা প্রশ্নে ও নিঃসংশয়ে তাহাদের মানিয়া চলা। ইহার এতটুকু ব্যতায় বিপর্যয়ের কারণ ঘটাইতে পারে।
তৎসহ আরও প্রয়োজন হইতেছে ঘরশত্রুর অনুপ্রবেশ ও সমাজশত্রæদের দুষ্কর্মের বিরুদ্ধে সদাসতর্কতা। সর্বাত্মক সংগ্রামের পথে যে জনগণ সর্বস্ব-পণ করিয়া নামিয়া আসিয়াছে, সমাজশত্রæ বা ঘরশত্রæদের দুষ্কৃতির দরুন তাহাদরে নিজেদেরই যদি উদ্বেগ-আতঙ্কগ্রস্ত থাকিতে হয় এবং কোন মহলের নীতি প্রদর্শন ও জবরদস্তি মধ্যে সর্বক্ষণ নিরাপত্তার আশঙ্কা লইয়া বাস করিতে হয়, তবে পরিণতি কিরূপ দাঁড়াইতে পারে তাহা সহজেই অনুমেয়। জনগণ এতকাল ধরিয়া আন্দোলন ও সংগ্রাম করিয়া আসিয়াছে গণ-আজাদীর জন্য, মৌল অধিকার অর্জনের জন্য, শোষণ, অবিচার ও অত্যাচারের ভাষার সার্বক্ষণিক ভীতি হইতে চিরমুক্তির জন্য। সেই সংগ্রাম আজ শেষ পর্যায়ে আসিয়া পৌঁছিয়াছে; জয় ইহার আসন্ন ও অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু উহাকে বিনষ্ট করিবার জন্য উপরোক্ত কোন মহল যদি সুযোগ গ্রহণ করিতে পারে, তবে তাহার চেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় আর কি হইতে পারে?
ছাত্রলীগ ও ‘ডাকসু’-নেতৃবৃন্দ ইতিমধ্যে’ সমাজশত্রæ’ ও ‘দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে এক কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করিয়াছেন। যাহারা ‘সংগ্রাম কমিটির’ নাম করিয়া পাবিøকের মোটরগাড়ী, ট্রাক, জীপ, মোটর বাইক জোর করিয়া লইয়া গিয়া উহার সাহায্যে ক্রাইম ও ‘সমাজবিরোধী কর্ম করিতেছে, অথবা যাহারা উক্ত কমিটির নামে ভুয়া দস্তখত করিয়া পেট্টোল পাম্প হইতে তৈল বা কোথাও হইতে টাকা পয়সা আদায় করিতে চেষ্টা করিতেছে, তাহাদিগকে সঙ্গে সঙ্গে ধরিয়া লইয়া যাইতে’ বা পুলিসে সোপর্দ করিতে জনসাধারণের নিকট ‘ডাকসু’ ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ অনুরোধ জানাইয়াছেন। তাঁহাদের এই সময়োচিত সতর্কবাণী অভিনন্দনযোগ্য। বিবিধ অপরাধমূলক ঘটনার পাশাপাশি ইদানীং একশ্রেণীর লোকের আন্দোলনের নামে নানা প্রক্রিয়ায় নাগরিকদের নিকট হইতে অর্থ ‘সংগ্রহের’ কথাও শোনা যাইতেছে। সত্যিকার আদর্শবাদী সংগ্রামীরা ইহা করা ত দূরের কথা, এরূপ অনাচারের প্রতি পরোক্ষ সমর্থনও দান করিতে পারেন না। ছাত্র-নেতৃবর্গের উল্লিখিত হুঁশিয়ারিই তাহার প্রমাণ। আদর্শবাদী সংগ্রামীরা জানেন যে, যেখানে বিশৃঙ্খলার শুরু, সেখানে সংগ্রামের শেষ। তাই তাঁহারা সময়োচিত সতর্কবাণী উচ্চারণ করিয়াছেন এবং সতর্কবাণী প্রচার করিয়াই সন্তুষ্ট না-থাকিয়া নিজেরা শান্তি-শৃঙ্খলার সপক্ষে ও অরাজকতা-উচ্ছৃঙ্খলতার বিরুদ্ধে সারা বাংলা দেশের শহরে নগরে, পল্লী ও মহল্লার সুদৃঢ় প্রতিরোধ গড়িয়া তুলিতেছেন। মুক্তি-সংগ্রামের সর্বাধিনায়ক শেখ মুজিবও তাঁহার বিভিন্ন ভাষণে, বিশেষতঃ ৭ই মার্চের ‘অর্ডার-অব দি-ডে’তে ‘আন্দোলন বানচাল করার কার্যে নিযুক্ত ছদ্মবেশী শত্রু ও দুষ্কৃতিকারী, সমাজ-বিরোধীদের’ মোকাবিলায় প্রতিটি মানুষকে সদা-সতর্ক থাকিয়ায় ডাক দিয়াছেন। ‘দুষ্কৃতিকারীরা আমাদের মধ্যে ঢুকিয়া পড়িয়াছে’ বলিয়া তিনি যাহাদের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়াছেন, তাহারা লুঠতরাজ ও সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা ছাড়াও আপাতদৃষ্টিতে সংগ্রামের পরিপোষক কোন কার্যক্রম দ্বারা অরাজকতা সৃষ্টির প্রয়াস পাইতে পারে। সেই অরাজকতার লক্ষ্য হইল নৈরাজ্য প্রতিষ্ঠাÑযাহা গণ-আজাদী ও স্বাধিকার হইতে স্বতন্ত্র। মনে রাখিতে হইবে, জনগণের এই রক্তদান দীর্ঘ এক যুগের স্বৈরতন্ত্রের স্থলে নৈরাজ্য স্থাপনের জন্য নয়, সর্বক্ষেত্রে সত্যিকার আজাদী, সুবিচার ও ‘আইনের শাসন’ স্থাপনের জন্যই এই মহাসংগ্রাম। মানুষের শাস্তি, স্বস্তি-অধিকার ও নিরাপত্তা হরণের জন্য যে-কেহ হাত বাড়াইবে বা শক্তির দম্ভ দেখাইবে, জনগণ আর তাহা কস্মিনকালেও বরদাশত করিবে না, এই পরম সত্যটি যেন আমরা কোনক্রমেই ভুলিয়া না-যাই।
বাংলার মানুষের প্রকৃত অবস্থা বিশ্ববাসীর সামনে তুলিয়া ধরুন
বিদেশী সাংবাদিকদের প্রতি শেখ মুজিবের আহবান
আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান গতকাল (মঙ্গলবার) ঢাকায় বলেন, ৭ কোটি বাঙালী আজ তাহাদের অধিকার সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন এবং যে কোন মূল্যে তাহারা এই অধিকার আদায়ের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। গতকাল আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান তাঁহার ধানমন্ডীস্থ বাসভবনে লন্ডন টাইমস পত্রিকার প্রতিনিধির সহিত আলোচনায় উপরোক্ত উক্তি করেন।
তিনি উক্ত সাংবাদিককে জানান, এ পর্যন্ত বাঙালীরা বহু রক্ত দিয়াছে। এবার বাঙালীরা এই রক্ত দেওয়ার পালা শেস করিতে চায়। বর্তমান গণবিক্ষোভের কারণ ব্যাখ্যা করিয়া আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান জানান, ৭ কোটি বাঙালী আজ তাহাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি চায়। এ ব্যাপারে তাহারা কোন আপোষ করিতে রাজী নহে। তিনি আরও বলেন, গত ২৩ বৎসর যাবৎ বাংলা দেশকে শোসক ও শাসক শ্রেণী কলোনী হিসাবে ব্যবহার করিয়া আসিতেছে। বাঙালীরা আজ শাসন ও শোসণের অবসান চায়।
তিনি বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজিপতি ও শিল্পপতিদের বাজার রক্ষার জন্যই বাংলা দেশের তাঁত শিল্প ও অন্যান্য কুটির শিল্প ধ্বংস করিয়া দেওয়া হইয়াছে। খাদ্য সমস্যাসহ বাংলা দেশের কোন উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষমতা বাঙালীদের হাতে নাই বলিয়া উল্লেখ করিয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, এদেশের জনসাধারণ আজ অমানুষিক ও দুর্বিসহ জীবন যাপন করিতেছে।
‘স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ’ সদস্যদের যুক্ত বিবৃতি
গতকল্য বুধবার স্বাধীন বাংলা দেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে রেজাউল হক মোস্তান প্রেরিত ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশ, “স্বাধীন বাংলা দেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের” সদস্য নুরে আলম, শাজাহান সিরাজ, আ. স. ম. আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন নিন্মোক্ত যুক্ত বিবৃতি প্রদান করিয়াছেন :
“(ক) আমরা জানিতে পারিলাম ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে ভয় দেখাইয়া সংগ্রাম পরিষদের নাম ভাঙ্গাইয়া জনগণের নিকট হইতে অর্থ সংগ্রহ করা হইতেছে। এভাবে কেহ অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করিলে জনসাধারণকে এ ব্যাপারে সাথে সাথে জহুরুল হক (ইকবাল হল) হলে খবর দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা যাইতেছে।
(খ) রাত্রে স্বেচ্ছাসেবকেরা বিভিন্ন গাড়ি তল্লাশী করার সময় সাংবাদিক, নিরীহ জনসাধারণ এবং সংগ্রাম পরিষদের পরিচয়পত্র দেওয়ার সাথে সাথে ছাড়িয়া দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করা যাইতেছে।
(গ) আমাদের আবেদন, কোন বাঙালী সৈন্য, ইপিআর, পুলিস, আই. বি. সি. আই. ডি. যেন পাকিস্তান উপনিবেশবাদী সরকারের সাথে সহযোগিতা না করেন।
(ঘ) বাংলা দেশের প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিককে স্বাধীনতা সংগ্রামের কাজে নিয়োজিত প্রতিটি মুক্তি সেনাকে সকল প্রকার সাহায্য করার জন্য অনুরোধ করিতেছি। কোন বাঙালী বা বাঙালী প্রতিষ্ঠান স্বাধীনতা সংগ্রামের কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করিতে চাহিলে তাহাকে চরমভাবে শাস্তি দেওয়া হইবে।
(ঙ) আমরা জানিতে পারিলাম যে, পাকিস্তানী ও বিদেশী বিমানে আসন খালী থাকা সত্বেও বাঙালীদের বাংলা দেশে আসিতে দেওয়া হইতেছে না। আমরা ইহা জানিতে পারিলাম যে, পাকিস্তান সরকারের সামরিক বাহিনীর সক্রিয় সাহায্য ও সহযোগিতায় সামরিক বাহিনীর গাড়ি দ্বারা বাংলা দেশে বসবাসকারী অবাঙালীদের বাসা বাড়ি হইতে তুলিয়া নিয়া পাকিস্তানে পাঠানো হইতেছে। এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে ‘দুস্থ’ অবাঙালীদের বিনা ভাড়ায় পাঠাইবার জন্য “পাস” দেওয়ার নিয়মও প্রবর্তিত হইয়াছে। আমরা পরিস্কার জানাইয়া দিতেছি, পাকিস্তান সরকার যদি বাঙালীদের বাংলা দেশে আসিতে না দেন তবে আমরাও ইয়ারপোর্ট রোডে তদন্ত করিয়া কোন অবাঙালীকে পাকিস্তান যাইতে দিব না।”
প্রেসিডেন্টের প্রতি দৌলতানার আহবান
অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানে গিয়া শেখ মুজিবের সঙ্গে আলাপ করুন
কাউন্সিল মুসলীম লীগের সভাপতি মিয়া মমতাজ মোহাম্মদ খান দৌলতানা গতকাল লাহোরে বলেন যে, প্রেসিডেন্টের অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানে গিয়া ভুল বুঝাবুঝির অবসান ঘটাইবার উদ্দেশ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের সহিত সাক্ষাৎ করা উচিত। তিনি বলেন যে, প্রেসিডেন্ট ইতিমধ্যে যেমন জনাব জুলফিকার আলী ভ‚ট্টোর সহিত আলোচনা করিয়াছেন, ঠিক সেভাবেই তাঁর শেখ মুজিবের সহিত সকল ব্যাপারে বিস্তারিত ও অন্তরঙ্গভাবে আলোচনা করা উচিত।
নিউইয়র্ক প্রবাসী বাঙালী ছাত্রদের বিক্ষোভ
পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতে জাতিসঙ্ঘের হস্তক্ষেপ কামনা
নিউইয়র্ক প্রবাসী পূর্ব পাকিস্তানী ছাত্ররা গতকাল জাতিসংঘের সদর দপ্তরের সম্মুখে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। তাঁহারা নিরস্ত্র পূর্ব পাকিস্তানীদের হত্যার প্রতিবাদে এবং এ বিষয়ে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের দাবীতে বিভিন্ন ধ্বনি দেন। পরে বিক্ষোভকারীদের নেতা জনাব আহমদ জাতিসংঘের সেক্রেপারী জেনারেল উ থানতের নিকট স্মারকলিপি পেশ করেন।
ওয়ালী খান বলেন
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি প্রধান খান আবদুল ওয়ালী খান গতরাত্রে সাংবাদিকদের সহিত আলোচনাকালে বলেন, “যদি আমরা পরিষদে না যাই, তবে বুঝিতে হইবে আমরা পরোক্ষভাবে ঐসকল শক্তিকেই সমর্থন করিতেছি, যাহারা নির্বাচিত গণ-পরিষদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করিতে চাহে না।”
তিনি গতরাত্রে পেশোয়ারের উদ্দেশে করাচী ত্যাগকালে আরও বলেন, “ক্ষমতা যাহাতে হস্তান্তর করা যায়, সে জন্য প্রথম আমাদের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের চেষ্টা করিতে হইবে।
শেখ মুজিবের চারিটি শর্তের প্রতি পঃ পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দের নীতিগত সমর্থন দান
আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের জন্য যে চারিটি পূর্ব শর্ত আরোপ করিয়াছেন, আজ লাহোরে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন নেতার এক সভায় তাহার প্রতি নীতিগতভাবে পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করা হয়। সভায় যোগদানকারী নেতাদের মধ্যে প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতা, অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ কর্মচারী, সুপ্রীম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিসহ বিশিষ্ট আইনবেত্তা, বিভিন্ন স্তরের খ্যাতনামা উলেমা এবং বিশিষ্ট সাংবাদিকগণ রহিয়াছেন।
শেখ মুজিবের প্রস্তাবে পাঞ্জাব, সিন্ধু, সীমান্ত ও বেলুচিস্তানেরও আশার প্রতিফলন ঘটিয়াছে-বেজেঞ্জো
নব-নির্বাচিত এম. এন. এ. এবং পশ্চিম পাকিস্তান ন্যাপের সেক্রেটারী জেনারেল মীর গউস বখ্শ বেজেঞ্জো করাচীতে এক বিবৃতিতে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠানের পক্ষে অনুকূল পরিস্থিতি গড়িয়া তোলার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন যে, আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তাবসমূহ দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ রূপ পরিগ্রহ করিয়াছে। তিনি বলেন যে, শেখ মুজিবের প্রস্তাবসমূহে শুধু পীর্ব পাকিস্তানীই নহে বরং সিন্ধু, সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান এবং পাঞ্জাবের জনগণের আশা-আকাংক্ষারও প্রতিফলন ঘটিয়াছে।
লেখকঃ মোহাম্মদ ওমর ফারুক দেওয়ান, পরিচালক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)
পূর্বাঞ্চলে যে ‘ভয়াবহ অবস্থা’ চলিতেছে, পশ্চিম পাকিস্তানের লোকেরা তাহা জানে না
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের শর্ত মানিয়া লও
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম : বঙ্গবন্ধু
ঢাকার রাজপথে স্বাধিকারকামী জনতার দৃপ্ত পদচারণা কন্ঠে কন্ঠে ক্ষুব্ধ গর্জন, প্রাণে প্রাণে সংগ্রামী শপথ
ঢাকার উত্তপ্ত রাজপথ, নানা জল্পনা-কল্পনা ও রাজনৈতিক ধোঁয়াশায় কাটে ৬ই মার্চ
দেশে যদি বিপ্লবের প্রয়োজন দেখা দেয়, তবে সে বিপ্লবের ডাক আমিই দিব, আমিও কম বিপ্লবী নই: বঙ্গবন্ধু
দানবের সঙ্গে সংগ্রামের জন্য যেকোন পরিণতিকে মাথা পাতিয়া বরণের জন্য আমরা প্রস্তুত : বঙ্গবন্ধু
৩ হইতে ৬ মার্চ প্রতিদিন সকাল ৬টা হইতে দুপুর ২টা পর্যন্ত সমগ্র প্রদেশে হরতাল পালন করুন : বঙ্গবন্ধু
২ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সাংবাদিক সম্মেলন
আসুন, পরিষদেই সমাধান খোঁজা হইবে : বঙ্গবন্ধু
প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও মর্যাদা : প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ
ঘুরে আসুন সাজেক, খেয়াল রাখবেন কিছু বিষয়ে
নারী ও শিশু নির্যাতন: সভ্য সমাজের বর্বর বার্তা
Developed By Muktodhara Technology Limited